মধু খেলে ওজন কমে। মধুর আরও উপকারীতা জেনে নিন।

“মধু” শব্দটির সাথে ফুল, ফুলের অমৃত সুধা, মৌমাছি, মৌমাছির গুঞ্জন ও মৌচাক যেন সমার্থক। মধুকে divine medicine ( সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ঔষধ ) বলা হয়। হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ঔষুধ হিসাবে মধু ব্যবহার হয়ে আসছে।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মধুর সাথে ঔষধি গাছ, লতাপাতা, শেকড় ও নানা প্রকারের মশলা মিশিয়ে বিভিন্ন রোগে ঔষুধ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন একটু মধু খাওয়া আয়ুর্বেদ সমর্থন করে।

প্রকৃতির অলংকার ছোট্ট পরিশ্রমী মৌমাছি নিজের মুখ দিয়ে ফুলের বুক চিরে রস সংগ্রহ করে এনে আপন মুখের যাদু মিশিয়ে তিলে তিলে মৌচাকে মধু তৈরি করে।

অতি মিষ্টি মধু এইজন্য মনে হয় অন্য সকল প্রকার মিষ্টি থেকে আলাদা।

মধু কি বা মধু কাকে বলে?

সহজ কথায়, মধু একটি অতি মিষ্টি খাদ্য যেটা মৌমাছি তৈরি করে ফুলের নেকটার থেকে।

সোনালী বা গাঢ় বাদামী রঙের ঘন তরলটিতে জীবন রক্ষাকারী সকল প্রয়োজনীয় উপাদান বিদ্যমান যেমনঃ এনজাইম, পানি, ভিটামিন, মিনারেলস, এন্টি-অক্সিডেন্ট (ব্রেইন ফাঙ্কশন উন্নত করে ) ইত্যাদি।

এটি এমন একটা খাদ্য যেটা সহজে নষ্ট হয় না এবং ফ্রিজেও রাখা লাগে না।

মধু = গ্লুকোজ (শতকরা ৩০ ভাগ ) + ফ্রুক্টোজ (শতকরা ৪০ ভাগ)+ সুক্রোজ (শতকরা ১ ভাগ ) + পানি (শতকরা ২০ভাগ ) + অন্যান্য। গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ তিনটিই ভিন্ন ধরণের সুগার।

চিনি এবং মধুর পার্থক্য কি?

মধু

প্রকৃতি দ্বারা তৈরি মধু। মানুষ তৈরি করে না।
এর GI (গ্লাইসেমিক ইনডেক্স) – ভ্যালু কম। তাই ডায়াবেটিকস দ্রুত বাড়ে না।
মধুতে বিদ্যমান গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ আলাদা থাকে এজন্য সহজে হজম হয়ে যায়। এনজাইমের দরকার হয় না।

চিনি

চিনি মানুষের দ্বারা তৈরি। এটি একটি highly processed প্রোডাক্ট।
এর GI -value বেশি। তাই রক্তে সুগার দ্রুত বেড়ে যায়।
চিনিতে বিদ্যমান গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ একত্রে থাকে। হজমের জন্য পাকস্থলীর এনজাইম নিঃসৃত করা লাগে।

সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো – যে চিনি আমরা খেয়ে থাকি তাতে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ থাকলেও ভিটামিন, মিনারেলস, এনজাইম, উপকারী অ্যাসিড নাই বললেই চলে।

মধুর উপকারিতা

পুষ্টিগুণ ও উপাদেয়তার দিকটি বিবেচনা করে যদি আমরা খাবারের একটি তালিকা করি, সে তালিকার প্রথম সারিতেই থাকবে মধু। নিচে মধু উপকারিতা আলোচনা করা হলো –

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ:

এতে রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এর মধ্যে রয়েছে জৈব অ্যাসিড এবং ফ্লেভোনয়েডস এর মতো ফেনলিক যৌগ।

মজার বিষয় হল, দুটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে মধু আপনার রক্তের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের মান বাড়ায়। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিছু ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিনির চেয়ে ভালো:

টাইপ-2 ডায়াবেটিসের লোকদের মধ্যে মধু হার্টের রোগের বেশ কয়েকটি ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, এটি “খারাপ” LDL কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড এবং প্রদাহ কমিয়ে “ভাল” HDL কোলেস্টেরল বাড়িয়ে তুলতে পারে।

তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি রক্তে শর্করার মাত্রাও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই পরিমাণ মতো খেতে হবে।

রক্তচাপকে সহায়তা করতে পারে:

দীর্ঘ দিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ হার্টের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে দেয়। সব থেকে মজার বিষয় হলো মধু উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করতে পারে। এর কারণ এটিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ রয়েছে যা নিম্ন রক্তচাপের সাথে যুক্ত।

ক্ষত নিরাময়ের প্রচার করে:

প্রাচীন কাল থেকে মধুর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্টের কারণে ক্ষত এবং পোড়া নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

মধু এবং ক্ষতের যত্ন নিয়ে ২৬ টি গবেষণার পর্যালোচনাতে দেখা গেছে যে, ক্ষত নিরাময়ে মধু সবচেয়ে বেশি কার্যকর ছিল।

একটি গবেষণায়, মধু ডায়াবেটিস রোগীদের আলসার ৯৭% নিরাময় করেছে।

হজমের সমস্যা দূর করতে:

হজমের সমস্যা দূর করতে প্রতিদিন সকালে মধু খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। মধু পেটের অম্লভাব কমিয়ে হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

হজমের সমস্যা দূর করার জন্য সকালে খালি পেটে এক চামচ মধু কিন্তু খুবই উপকারী।

হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো:

প্রাকৃতিক মধু ফিনোলস এবং অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এগুলি আপনার হৃদয়ের ধমনীগুলিকে দ্বিধাগ্রস্থ করতে সাহায্য করতে পারে, আপনার হৃদয়ে রক্ত প্রবাহ বাড়িয়ে তুলবে।

এগুলি রক্ত জমাট বাঁধা রোধেও সহায়তা করতে পারে যা হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:

শরীরে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে মধু। কারণ মধুতে আছে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল, ভিটামিন ও এনজাইম যা শরীরকে বিভিন্ন অসুখ বিসুখ থেকে রক্ষা করে।

কোলেস্টেরল উন্নত করতে সহায়তা করে:

উচ্চ LDL কোলেস্টেরলের মাত্রা হার্টের রোগের জন্য দায়ী। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মধু কোলেস্টেরলের মাত্রাকে উন্নত করতে পারে। এটি LDL “খারাপ” কোলেস্টেরল হ্রাস করে।

৫৫ জন রোগীর একটি গবেষণায় মধু ও চিনির সাথে মধুর তুলনা করে দেখা গেছে যে, মধু LDL ৫.৮% হ্রাস করেছে এবং HDL কোলেস্টেরল ৩.৩% বৃদ্ধি করেছে।

হাঁপানির সমস্যা দূর করে:

হাঁপানির সমস্যা দূর করতে মধু একটি কার্যকরী ঔষুধ। আধা গ্রাম গোল মরিচের গুঁড়া + আধা গ্রাম মধু + আদা এক সাথে মিশিয়ে দিনে তিন বার খেলে আপনার হাঁপানির সমস্যা অনেকটা কমে যাবে।

বয়সের ছাপ দূর করে:

এতে রয়েছে হিউম্যাকটেন্ট যৌগ। যা ত্বকের আদ্রতা ধরে রাখার কাজ করে এবং ত্বকের উপরিভাগের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখে।

হিউম্যাকটেন্ট যৌগটি ত্বককে নমনীয় করে তোলে ও বয়সের ছাপ দূর করে। ত্বকের দাগ কমতেও সাহায্য করে।

কাশি কমায়:

যাদের খুস খুসি কাশির সমস্যা আছে ,তাঁরা প্রতিদিন এক চামচ আদার রসের সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। এতে করে কাশি কমবে।

শক্তি বৃদ্ধি করে:

হ্যাঁ মধুতে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি। এই প্রাকৃতিক চিনি শরীরে শক্তি যোগায় এবং শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করে। যাঁরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে, তারা মিষ্টির পরিবর্তে মধু খেতে পারেন।

ওজন কমাতে সাহায্য করে:

প্রতিদিন সকালে এক চামচ মধু খেলে শরীরের বাড়তি ওজন কমবে। তবে অবশ্যই খালি পেটে এক গ্লাস উষ্ণ গরম পানি, লেবুর রস ,মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এতে পাকস্থলী পরিষ্কার থাকবে।

রক্ত পরিষ্কার রাখে:

যদি মধুর সাথে দারুচিনির গুঁড়া মিশিয়ে খাওয়া যায় তাহলে রক্ত নালীর সমস্যা দূর হয় এবং রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমান ১০% কমে যায়।

এতে করে হার্ট এটাকের ঝুকি কমে যায়।

কোষ্টকাঠিন্যতা দূর করে:

এতে রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স। যা ডায়রিয়া ,কোষ্টকাঠিন্য দূর করে।

ঘুম বৃদ্ধি করে:

রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস দুধের সাথে ২চামচ মধু মিশিয়ে খেলে ঘুম বৃদ্ধি পাবে।

দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি করে:

চোখের জন্য মধু খুব ভালো। সকালের খাবারের এক ঘন্টা আগে দুই চামচ মধু গাজরের রসের সাথে মিশিয়ে খেলে দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পাই।

সরাসরি মধু ব্যাথার উপশম হিসাবে কাজ করে। শরীরের কোথাও অল্প পুড়ে গেলে বা অল্প পোড়া ত্বকের চিকিৎসায় মধু ভালো কাজ দেয়।

রেফারেন্স: