খিচুড়ি সহজপাচ্য, শক্তিদায়ক এবং ফাইবার ও এন্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ।

সারাদিন বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়। বাইরে বেরোনোর উপায় নেই। কখনো দুই-তিন দিন ধরে একটানা বা মুষলধারে বৃষ্টি। এমন অলস দিনে মন চায় খিচুড়ি খেতে।

টানা শৈত্য প্রবাহ চলছে কয়েকদিন ধরে। বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করছে না। এমন ক্লান্ত দিনেও খিচুড়ির সাথে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে হয়।

বৃষ্টিস্নাত দিনে ভোজনরসিক বাঙালি খিচুড়ি খাবেনা সেটা যেমন বিশ্বাস হয় না তেমনি খিচুড়ির সাথে ইলিশ মাছ ভাঁজা, বেগুন ভাঁজা, কষা মাংস হলে অমৃতের সমান মনে হয়।

এছাড়া অনেক রকম সবজি দিয়ে খিচুড়ি বা মাংস দিয়ে ভূনা খিচুড়ি, সাথে একটু জলপাই বা আমের আচার ও সালাদ। একেবারে জমে ক্ষীর। কোনো কথা হবে না।

খিচুড়ি একটি ভাত জাতীয় খাবার যা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। প্রধানত চাল এবং মুগডাল ও মসুর ডাল দিয়ে সাধারণ খিচুড়ি ভাত রান্না করা হয়।

তবে এখন সবজি, বজরা সহ অন্যান্য ডালের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। শেষে ঘি-ও দেওয়া হয়।

অঞ্চলভেদে খিচুড়ির বিভিন্ন আঞ্চলিকরূপ পরিলক্ষিত হয়। যেমন: অল্প মসলায় ও অল্প ঝালে নরম খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি, মাংস খিচুড়ি, নিরামিষ খিচুড়ি ইত্যাদি।

খিচুড়ি একটি সহজপাচ্য খাবার তাই শিশুকে প্রথম কঠিন খাবার হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। হিন্দুদের মধ্যে যারা উপবাসকালে কোনপ্রকার শস্যাদি গ্রহণ করতে চান না তারা এসময়ে সাবুদানা খিচুড়ি খেয়ে থাকেন।

ধারণা করা হয় বাংলা খিচুড়ি শব্দটি সংস্কৃত খিচ্চা থেকে এসেছে। অঞ্চলভেদে শব্দটির তৃতীয় ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ ও ব্যবহারে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাঙালি পরিমন্ডলে খিচুড়ি উচ্চারণ করা হলেও কোথাও কোথাও খিচুরি বলতে শোনা যায়। হিন্দীভাষীরা ড় এবং উর্দুভাষীরা র ব্যবহার করে থাকেন খিচুড়ি উচ্চারণে।

বাঙালির তালিকায় রয়েছে, মুগ ডালের খিচুড়ি, সবজি খিচুড়ি, মুসুর ডালের খিচুড়ি, গমের খিচুড়ি, সাবুর খিচুড়ি, মাংসের খিচুড়ি, ডিমের খিচুড়ি, মাছের খিচুড়ি, ভুনা খিচুড়ি।

খিচুড়ি:

উৎপত্তিস্থল: বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান

অঞ্চল বা রাজ্য: বঙ্গ, গুজরাট, পাঞ্জাব

প্রধান উপকরণ: চাল, বিভিন্ন রকম ডাল, হলুদ গুড়া, মরিচ গুড়া, ধনিয়া গুড়া, আলু, সবজি, মাংস(গরু, খাসি, মুরগির মাংস), পিঁয়াজ ।

ভিন্নতা: ভুনা খিচুড়ি, নরম খিচুড়ি, সবজি খিচুড়ি, নিরামিষ খিচুড়ি

খিচুড়ির উপকারীতা বা স্বাস্থ্যসুবিধা:

এক থালা খিচুড়িতে প্রায় ১৭৭ ক্যালরি শক্তি, ৩২.৩ গ্রাম শর্করা, ৮.৪ গ্রাম প্রোটিন, ১.৫ গ্রাম চর্বি থাকে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি, আয়রন এবং ফাইবার বা আঁশ রয়েছে।

সহজপাচ্য:

বেশ সহজপাচ্য এবং শক্তিদায়ক বলে অসুস্থ এবং দুর্বল মানুষকে খিচুড়ি খেতে দেওয়া হয়। বাচ্চাদের পেটে সহজে শক্ত খাবার হজম হয় না বলে তাদেরকে খুব নরম খিচুড়ি বিভিন্ন সবজি ও অল্প মশলা দিয়ে রান্না করে খেতে দেওয়া হয়।

দ্রুত শক্তি যোগায়:

খিচুড়ির প্রধান উপাদান চাল, ডাল ও আলু। এগুলো কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার ও প্রোটিন সমৃদ্ধ। কার্বোহাইড্রেট দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। ফাইবার পাচনতন্ত্রকে ঠিক রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্যের ভয় থাকে না।

ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পূর্ণ:

যেহেতু একেক ধরনের খিচুড়ি তৈরিতে একেক ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয় তাই ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির কারণে বিভিন্ন ধরনের উপকারী ভূমিকা পালন করে। ওটস খিচুড়িতে উপস্থিত ফাইবার, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট দেহে উপস্থিত টক্সিক উপাদানদের বের করে দেয়।

সবজি খিচুড়িতে প্রচুর মাত্রায় ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং বেশ কিছু খনিজ থাজে যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। মুগ ডালের খিচুড়ি দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখায় ওজন কমাতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করে। কাওনের খিচুড়ি প্লোটিন, ফাইবার, ফসফরাস এবং অ্যামাইনো অ্যাসিডে পরিপূর্ণ। সাবুদানা খিচুড়িতে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়ামসহ একাধিক খনিজ রয়েছে।

হজম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো:

তদতিরিক্ত, এটি হজমের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে কারণ মুগ ডালের ব্যবহার অন্ত্রের বুটিরেট নামে একটি ফ্যাটি অ্যাসিড তৈরি করতে সাহায্য করে যা অন্ত্রের দেয়ালগুলির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। পাচনতন্ত্রকে বিষমুক্ত করে। পাচনতন্ত্রকে শান্ত করার পাশাপাশি খিচড়ির উপাদানগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শক্তি উন্নত করে।

মুগ ডালের খিচড়িতে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স থাকে যা রক্তে গ্লুকোজ এবং ফ্যাট এর স্তর হ্রাস করতে সহায়তা করে যা রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে এবং ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।

ভিক্টোরিয়ান যুগে দেশে ফেরত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের হাত ধরে তা ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য মনসামঙ্গলে শিব পার্বতীকে ডাবের পানি দিয়ে মুগডালের খিচুড়ি রান্নার ফরমায়েশ দিচ্ছেন।

কোনো কিছু তালগোল পাকিয়ে গেলে বাংলায় তাকে ‘জগাখিচুড়ি’ দশা বলে। বাস্তবে জগাখিচুড়ি বলে এক রকমের খিচুড়ি আছে। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের নিত্যদিন খিচুড়ি বিতরণ করা হয়। ‘জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি’ লোকমুখে সংক্ষেপে হয়েছে ‘জগাখিচুড়ি।  আর বাঙালীর কথ্যরীতিতে তা তালগোল পাকানোর প্রতিশব্দ হিসেবে পরিণত হয়েছে।

সূত্রঃ

উইকিপিডিয়া, indianexpress.com