ব্রকলি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং ব্রেইনের জন্য ভালো।

এটা সত্য যে ব্রকলির স্বাদ ভিন্ন, সচরাচর এটা সবাই পছন্দ করবে না। কিন্তু ব্রকলি হল ভিটামিন, খনিজ, ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমূহে ভরপুর একটি পাওয়ার হাউস।

যখন আমরা আমাদের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত সবুজ শাকসবজি সম্পর্কে চিন্তা করি, তখন ব্রকলি আমাদের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত সবজির তালিকায় প্রথমে চলে আসে এর পুষ্টিগুণের জন্য।

দেখতে ফুলকপির মতো কিন্তু এটির রং গাঢ় সবুজ। ব্রকলির এই গাঢ় সবুজ রং এর পুষ্টিগুন হাজার গুনে বাড়িয়ে দেয়। ব্রকলি সাধারণত দুই রঙের হয়ে থাকে গাঢ় সবুজ আর বেগুনী রঙের।

ব্রকলি সাধারণত সিদ্ধ করে এবং বিভিন্ন ভাবে রান্না করে খাওয়া হয়ে থাকে। অনেকে কাঁচাও খেয়ে থাকেন।

ব্রকলি (broccoli) যদিও একটি বিদেশি সবজি, কিন্তু আমাদের দেশে এখন এই সবজিটি বেশ সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। এটি হজম শক্তি বাড়ায়, কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেম এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

১ কাপ ব্রকলিতে ১ কাপ ভাতের সমান প্রোটিন আছে কিন্তু ১ কাপ ভাতে যতোটা ক্যালরি থাকে তার থেকে অর্ধেক পরিমাণে ক্যালরি ব্রকলিতে থাকে। এতে Phytonutrients থাকায় হৃদরোগ এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

ব্রকলিতে থেকে উচ্চমাত্রার ভিটামিন “সি” পাওয়া যায়। দিনে মাত্র ১০০ গ্রাম ব্রকলি শরীরে প্রতিদিনের ভিটামিন “সি” এর চাহিদার ১৫০% পূরণ করতে পারে। ব্রকলিতে ফাইটোকেমিক্যালস এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসও রয়েছে।

ফাইটোকেমিক্যাল এমন একটি রাসায়নিক যা রঙ এবং গন্ধ ধারণ করে। এই ফাইটোকেমিক্যালস ইমিউন সিস্টেমের জন্য ভাল। আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর ক্যান্সার রিসার্চ অনুসারে, ব্রকলির অসংখ্য স্বাস্থ্যকর সুবিধা রয়েছে।

ব্রকলির পুষ্টি উপাদান

ব্রকলির অন্যতম বড় সুবিধা হল এর পুষ্টি উপাদান। এটিতে ভিটামিন “সি”, ভিটামিন “এ”, ভিটামিন “কে”, ভিটামিন বি৯, পটাশিয়াম, ফসফরাস এবং উচ্চমাত্রায় ফাইবার রয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু উপাদান নিচে দেওয়া হলো-

  • কার্বোহাইড্রেট: ৬ গ্রাম
  • প্রোটিন: ২.৬ গ্রাম
  • ফ্যাট: ০.৩ গ্রাম
  • ফাইবার: ২.৩ গ্রাম
  • ভিটামিন “সি”: ১৩৫% (RDI)
  • ভিটামিন “এ” : ১১% (RDI)
  • ফসফরাস:৬%(RDI)
  • ভিটামিন “কে”: ১১৬% (RDI)
  • ভিটামিন “B9″(ফোলেট): ১৪% (RDI)
  • পটাসিয়াম:৮%(RDI)

ব্রকলি উপকারীতা

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ব্রকলি রাখা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। জেনে নিন ব্রকলি আমাদের শরীরের জন্য কতোটা উপকারী-

কয়েক প্রকারের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে:

উচ্চ পরিমাণে ক্রুসিফেরাস শাকসবজি খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকির বিশেষ করে ফুসফুস এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কম থাকে।

ক্রুসিফেরাস শাকসবজি যেমন-ব্রকলি, ব্রকলিতে বিভিন্ন জৈব উপাদান আছে যা বয়সের সাথে সাথে হওয়া রোগের কারণে কোষের যে ক্ষতি হয় তা কমাতে পারে।

এছাড়া ক্রুসিফেরাস শাকসবজির মধ্যে রয়েছে ফুলকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউট, শালগম, বাঁধাকপি, সরিষা শাক, মূলা এবং ওলকপি।

কয়েকটি ছোট গবেষণায় দেখা গেছে যে, ক্রুসিফেরাস শাকসবজি কয়েক ধরনের ক্যান্সারের হাত রক্ষা করতে পারে। যেমন-

সূর্যের হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে:

ত্বকের ক্যান্সার দিনে দিনে বেড়ে চলেছে কারণ বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর নষ্ট হয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব বাড়ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে ব্রকলিতে বিদ্যমান জৈব ক্রিয়াশীল যৌগ অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের ত্বককে সুরক্ষিত রাখতে পারে।

গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ভালো:

গর্ভবতী মায়ের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার অতি প্রয়োজনীয়। গর্ভাবস্থায় গর্ভের বাচ্চা এবং মা উভয়েরই প্রচুর ভিটামিন, খনিজ এবং প্রোটিনের প্রয়োজন হয়। ব্রকলিতে প্রচুর পরিমাণের ভিটামিন “বি”আছে যা, ফোলেট নামে পরিচিত।

গর্ভের বাচ্চার মস্তিষ্কের বিকাশ গঠনের জন্য ফোলেট খুব দরকারি। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন ব্রকলির মতো ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া গর্ভকালীন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

হাড়ের সুস্থ্যতা বজায় রাখে:

গবেষণায় দেখা গেছে ব্রকলিতে থাকা সালফোর‍্যাফেইন অস্টিওআর্থ্রাইটিস (osteoarthritis) রোধ করতে পারে। ব্রকলি ভাইটামিন “কে” এবং ক্যালসিয়াম এর শক্তিশালী উৎস। শক্ত ও সুস্থ্য হাড়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি পুষ্টি উপাদান।

এছাড়াও এতে ফসফরাস, দস্তা, ভিটামিন “এ” এবং “সি” রয়েছে, যা সুস্থ্য হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয়। একটি টেস্ট-টিউব সমীক্ষা ইঙ্গিত দেয় যে, ব্রকলিতে পাওয়া সালফারফেন অস্টিওআর্থারাইটিস প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।

দাঁতের জন্য ভালো:

দাঁত আমাদের শরীরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। তাই দাঁতের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরী। আর এই ব্রকলি আমাদের দাঁতের যত্ন নিতে সাহায্য করতে পারে।

ব্রকলিতে প্রচুর পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যার মধ্যে কিছু পুষ্টি উপাদান মুখের ভিতরের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে এবং দাঁতের রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।

ব্রকলি হল ভিটামিন “সি” এবং ক্যালসিয়ামের একটি ভাল উৎস। ভিটামিন “সি” এবং ক্যালসিয়াম দুটি পুষ্টি উপাদান পিরিয়ডোন্টাল রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। ব্রকলিতে পাওয়া ফ্ল্যাভোনয়েড ক্যাম্পফেরলও পিরিয়ডোন্টাইটিস প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

এছাড়া সালফোরাফেইন মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। কিছু গবেষণা দাবি করেছে যে কাঁচা ব্রকলি খেলে দাঁত সাদা করতে সহায়তা করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য ভিটামিন “সি” খুবই প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। এই ভিটামিন “সি” ব্রকলি থেকে প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায়।

গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে, ভিটামিন “সি” বিভিন্ন অসুস্থ্যতা প্রতিরোধ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

প্রতিদিন ১০০-২০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন “সি” খেলে তা যে কোন সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে পারে।

সাধারণত, আমরা সবসময় ভিটামিন “সি” কমলা বা স্ট্রবেরি থেকে খুঁজি, তবে ব্রকলি থেকেও আমরা ভিটামিন “সি” পেতে পারি।

রান্না করা অর্ধকাপ ব্রকলি থেকে আমরা ৮৪% ভিটামিন “সি” পেতে পারি।

বয়সের ছাপ কমায়:

আমাদের বয়স ছাপ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (oxidative stress) অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ।

যদিও বয়স বৃদ্ধি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্বাস্থ্যকর ডায়েটের মাধ্যমে বার্ধ্যক্যজনিত রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করা যায়।

এছাড়াও আরও কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রকলির বায়ো-এক্টিভ-কম্পাউন্ড সালফোর‍্যাফেইন বয়োঃবৃদ্ধির গতি কমাতে পারে।

ব্রেনের জন্য ভালো:

ব্রকলিতে বিদ্যমান কিছু পুষ্টি উপাদান এবং জৈব ক্রিয়াশীল যৌগ আমাদের মানসিক অবক্ষয় হ্রাস করে এবং ব্রেইনের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এটি আমাদের নার্ভের টিস্যু ফাংশন ও ভালো রাখে।

৯৬০ জন বয়স্ক লোকের উপর এক পরীক্ষায় দেখা গেছে গাঢ় সবুজ শাকসবজি যেমন ব্রকলি বয়সের সাথে সাথে মানুষের মানসিক যে অবক্ষয় হয় তা রোধ করতে পারে।

হজম শক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূর করে:

ব্রকলি, ফাইবার এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ – তাই এটি কোষ্ঠকাঠিন্যতা এবং হজম শক্তি উন্নত করতে পারে। ফাইবার- এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার ব্রকলি অন্ত্রের ফাংশন বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে।

সাম্প্রতিক একটি মানব গবেষণায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যারা ব্রকলি খেয়েছিল তাদের পাচন ক্রিয়া অন্যদের তুলনায় ভালো ছিল।

হার্টের জন্য ভালো:

বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি হার্টের রোগ, যা কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই যেকোনো সময় কেড়ে নেয় জীবন।

প্রতি বছর সারাবিশ্বে হার্টের রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে প্রায় ২ কোটি মানুষ। ব্রকলি আমাদের হার্টের জন্য খুবই ভালো

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রকলি খাওয়ার ফলে কিছু মানুষের ট্রাইগ্লিসারাইড ও খারাপ কোলেস্টেরল (LDL cholesterol) কমে গেছে এবং ভাল কোলেস্টেরল (HDL cholesterol) বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়া আরও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রকলিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইবার হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমায়। ব্রকলির মতো যেকোনো ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খেলে হার্টের রোগের ঝুঁকি কমে যাবে।

সুগার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে:

বর্তমানে গবেষণা করলে দেখা যায় যে, প্রতেকটি ঘরে অন্তত একজন করে সুগারে আক্রান্ত রোগী আছে। এটি এমন একটি রোগ যা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।

সুগার বেড়ে গেলে যেমন সমস্যা আবার একেবারে কমে গেলেও কিন্তু বিপদ। তাই দরকার নিয়ন্ত্রনে রাখা।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ পরিমাণে ডায়াটারি ফাইবার রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।

ব্রকলি ফাইবারের একটি ভালো উৎস। ব্রকলিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইবার রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, টাইপ-2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ইনসুলিনের প্রতিরোধের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে রোজ ব্রকলি গ্রহণ করার কারণে।

ব্রকলির অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী:

ব্রকলি অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের জন্য বিখ্যাত। ব্রকলিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট মানব স্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষকতা হতে পারে।

অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এমন একটি অণু যা, ফ্রি র‌্যাডিক্যাল হতে কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ব্রকলিতে আছে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোর‍্যাফানিন (glucoraphanin) নামে এক প্রকারের উপাদান রয়েছে যা, হজমের সময় সালফোরাফেন (sulforaphane) একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে রূপান্তরিত হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, সালফোরাফেন ব্লাড সুগার ও কোলেস্টেরল কমায় এবং বিভিন্ন রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। এছাড়া ব্রকলিতে লুটিন (lutein) ও জেক্সানথিন (zeaxanthin) রয়েছে যা, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং আপনার চোখের সেলুলার ক্ষতি রোধ করে।

পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার মধ্যে দিয়ে আমরা একটি স্বাস্থ্যকর জীব্ন পেতে পাড়ি। তাই আমাদের উচিৎ সবসময় স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। এই স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে ব্রকলি সর্বোত্তম স্থান অর্জন করতে পারে। তাই কম বেশি আমাদের ব্রকলি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে।