হাড় শক্ত ও মজবুত রাখার উপায়।

শক্ত ও মজবুত হাড় স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া, বাড়তি লবণ খাওয়া, শরীরে ভিটামিন ডি-র অভাব ইত্যাদি কারণে হাড়ে সমস্যা হয়।

শরীরকে মজবুত রাখতে হলে সবার আগে নজর দিতে হবে হাড়ের পুষ্টির ওপর।

৩০ বছরের পর থেকেই হাড় ক্ষয় হতে শুরু করে। শৈশব এবং বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের হাড়ের বৃদ্ধি এবং হাড়ের ঘনত্বের বেশির ভাগই ঘটে।

মেয়েরা ১৮ বছর এবং ছেলেরা ২০ বছর বয়সে সর্বাধিক হাড়ের ঘনত্বে পৌঁছায়। আমরা বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের দেহ হাড়ের ঘনত্ব হারাতে থাকে।

তবে সঠিক খাবারের অভ্যাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে এ সমস্যা রোধ করা সম্ভব।

হাড় শক্ত ও মজবুত করার উপায়

হাড় শক্ত ও মজবুত করার উপায়গুলো সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো –

ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন কে:

শক্তিশালী হাড় তৈরির জন্য ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন কে উভয়েই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে, তার মধ্যে একটি হলো, এটি আপনার শরীরকে ক্যালসিয়াম শোষণ করতে সাহায্য করে। এটি ব্লাড লেভেল বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ভিটামিন ডি গ্রহণের প্রবণতা কম তাদের হাড়ের ঘনত্ব কম এবং ভরও কম।

অন্যদিকে, যাদের ভিটামিনি ডি’র লেভেল ভাল, তাদের হাড় মজবুত ও শক্ত বেশি। ডিম, দুধ, কমলার জুস, দই, খাঁটি সোয়া, চীজ, আখরোট এবং সবজি ইত্যাদি থেকে আমরা সহজেই ভিটামিন ডি এবং কে পেতে পারি।

পর্যাপ্ত প্রোটিন:

সুস্থ্য হাড় গঠনের জন্য পর্যাপ্ত প্রোটিন অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে হাড়ের শতকরা ৫০ ভাগই তৈরি হয় প্রোটিন থেকে।

গবেষকরা জানিয়েছেন যে, পর্যাপ্ত প্রোটিনের অভাবে হাড়ের ক্যালসিয়াম শোষণের মাত্রা কমে যায় এবং এর ফলে হাড়ের গঠন ব্যাহত হয় এবং হাড় ভেঙ্গে যায়।

তবে, অতিমাত্রায় ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলে রক্তে এসিডিটি হয়ে হাড় থেকে ক্যালসিয়াস বের হয়ে যাবার ভয় থাকে।

অবশ্য যেসব লোক প্রতিদিন ১০০ গ্রাম পর্যন্ত প্রোটিন জাতীয় খাদ্য এবং তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে তাদরে ক্ষেত্রে এটি ঘটবে না।

যদি আমরা নিয়মিত প্রোটিন যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করি তাহলে বয়সকালে হাড়ের ভর বজায় থাকবে। বিশেষ করে মহিলাদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৮৬ গ্রাম প্রটিন খাওয়া উচিত।

এরচেয়ে কম প্রোটিন গ্রহণ করলে বাহু, মেরুদণ্ড এবং পায়ের হাড় দুর্বল হওয়ার আশংকা থাকে।

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন:

পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখার মাধ্যমে হাড়ের স্বাস্থ্য অটুট রাখতে সাহায্য করে।

ওজন কম হলে যেমন অস্টিওপেনিয়া (osteopenia) বা হাড়ের কম ভর (low bone mass) এবং অস্টিওপরোসিস (osteoporosis) বা ভঙ্গুর হাড় (brittle bones)-এর ঝুঁকি বাড়ে।

তেমনি স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজনও হাড় ক্ষয় এবং ভঙ্গুর হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

অন্যদিকে, কিছু সমীক্ষায় জানা গেছে, শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমলে হাড়ের মান দুর্বল হয় এবং বাড়তি ওজনের চাপের কারণে হাড় ভাঙার ঝুঁকি বাড়ে।

বারবার ওজন কমানো এবং বাড়ানো কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেকখানি ওজন কমানোও হাড়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ক্ষতিকারক।

একটি নিদৃস্ট স্বাভাবিক বা একটু সামান্য বেশি ওজনই হাড়ের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি মানানসই।

এছাড়া বারবার ওজন কমানো এবং পুনরায় ওজন বাড়ানোর চেয়ে বরং নিদৃস্ট ওজন বজায় রাখার মাধ্যমেই হাড়কে শক্ত ও মজবুত রাখতে পারি।

খুব কম ক্যালোরি খাবার এড়িয়ে চলুন:

খাদ্যে অতিমাত্রায় ক্যালরি কমানো কখনই ভাল ধারণা নয়। এর ফলে ধীরে ধীরে আপনার মেটাবলিজম কমে যাবে, খাবার পরও ক্ষুধা থাকবে এবং পেশীভর কমবে, যা আপনার হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে।

কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন এক হাজারেরও কম ক্যালরির খাদ্য গ্রহণ হাড়ের ঘনত্ব কমায় এবং স্থূলতার জন্ম দেয়।

তাই শক্তিশালী হাড় গঠন এবং তা বজায় রাখার জন্য এমন ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যতালিকা অনুসরণ করতে হবে, যাতে প্রতিদিন অন্তত ১২০০ ক্যালরির ব্যবস্থা থাকবে।

আর সাথে প্রচুর প্রোটিন ও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। এছাড়া থাকতে হবে ভিটামিন এবং মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিয়মিত ব্যায়াম:

পুরুষ বা মহিলা যারা নিয়মিত ব্যায়াম করে তাদের হাড় অনেক মজবুত এবং হাড়ের ঘনত্ব অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে।

শক্ত মজবুত, সুস্থ হাড়ের জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভার উত্তোলন বা ভার বহন, যা নতুন হাড় গঠনে সাহায্য করে।

এক গবেষণায় দেখা যায়, ব্যায়াম হাড় গঠনের চূড়ান্ত বছর গুলোতে হাড় গঠনের প্রক্রিয়াকে জোরদার করে। উপরন্তু এ ধরনের ব্যায়াম বৃদ্ধ বয়সে হাড় ক্ষয় রোধ করে।

বয়স্ক পুরুষ বা মহিলা যারা ভার বহনের মত ব্যায়াম করেন তাদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের ব্যায়াম করার কারণে তাদের হাড়ের খনিজ ঘনত্ব, শক্তি এবং আকৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রচুর সবজি রাখতে হবে:

হাড়কে শক্ত ও মজবুত রাখতে হলে শাকসবজি খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। শাকসবজি ভিটামিন সি এর সেরা উৎস, যা হাড় গঠনকারী কোষ উৎপাদন করতে সাহায্য করে।

এছাড়া কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ভিটামিন সি’র এন্টিঅক্সিডেন্ট হাড়ের কোষকে নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে।

তাই প্রতিদিন সবুজ শাকসবজি খাবার অভ্যাসের মধ্যদিয়ে আমাদের হাড় শক্ত ও মজবুত রাখতে পারি।

যেমনঃ পালংশাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, লেটুসপাতা, শালগম ইত্যাদি।

খাদ্য তালিকায় ম্যাগনেসিয়াম এবং জিংক রাখুন:

হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ম্যাগনেসিয়াম এবং জিংক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ম্যাগনেসিয়ামের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ভিটামিন ‘ডি–কে রূপান্তরিত করে আমাদের শরীরকে ক্যালসিয়াম শোষণে সক্ষম ও সক্রিয় করে তোলা।

৭৩ হাজার নারীর অংশগ্রহণে এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব নারী প্রতিদিন ৪শ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের হাড়ের ঘনত্ব ২-৩% বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে যেসব নারী এর অর্ধেক পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণ করেছেন বোন ডেনসিটি ছিল প্রথম দলের তুলনায় ২-৩% কম। তবে বেশিরভাগ সাধারণ খাদ্যেই ম্যাগনেসিয়াম খুব কম পরিমাণে পাওয়া যায়।

ম্যাগনেসিয়াম গ্লিসিনেট, সাইট্রেট অথবা কার্বোনেটের সাপ্লিমেন্ট এক্ষেত্রে উপকারে আসতে পারে। অবশ্য খুব অল্প কয়েকটি খাদ্য রয়েছে, যেগুলো ম্যাগনেসিয়ামের ভাল উৎস।

যেমন: সবুজ শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ, কলা, বাদাম, ডার্ক চকলেট ইত্যাদি।

জিংকও একটি খনিজ উপাদান এবং স্বল্প পরিমাণে হলেও এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য্য। জিংক হাড় গঠনের সেল সমূহকে জোরদার করতে সাহায্য করে এবং অতিমাত্রায় হাড় ভাঙ্গা রোধ করে।

জিংক এর ভাল উৎস গুলোর মধ্যে রয়েছে গরুর মাংস, চিংড়ি, শাক, কলা, ডার্ক চকলেট, বাদাম এবং কুমড়া বীজ।

প্রতিদিন ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খান:

ক্যালসিয়াম আমাদের হাড়ের জন্য অন্যতম খনিজ উপাদান। ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্যকে ভালো করে, শক্ত হাড় গঠনে সাহায্য করে। অস্টিওপরোসিস ও হাড় সম্পর্কিত সমস্যাগুলো করতে সাহায্য করে।

অধিকাংশ মানুষের প্রতিদিন ১,০০০mg (RDI), টিনএজ ছেলেমেয়েদের জন্য ১৩০০mg(RDI), বয়স্ক মহিলাদের জন্য ১২০০mg (RDI) ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার খাওয়া প্রয়োজন।

ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবারের মধ্যে সকল প্রকার দুধ জাতীয় খাবার দুধ, দই, চীজ, মটরশুটি, আলমন্ড, সবুজ শাক ইত্যাদি।

কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট:

কোলাজেন সাপ্লিমেন্টও হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় ভাল কাজ করে।

যদিও এই বিষয়টি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়নি, তবে প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণে এটি হাড়ের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল বলে মনে করা হয়। কোলাজেন হাড়ের মধ্যে থাকা প্রোটিনগুলোর মধ্যে প্রধান।

এতে রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিডের কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান যা গ্লিসাইন, প্রোলাইন এবং লাইসিন নামে পরিচিত। এগুলো হাড়, পেশী, লিগামেন্ট ও অন্যান্য টিস্যু নির্মাণ করতে সহায়তা করে।

এটি বিভিন্ন প্রাণীর মাংস, যোজক কলা ও মেরুদণ্ডে পাওয়া যায়। আমাদের দেহের মোট প্রোটিনের ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কোলাজেন।