“ফুলকপি” কোষ্টকাঠিন্য দূর করে, হজমকারক ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

এমন একটা ফুলের নাম বলুন যে ফুল দিয়ে মালা গেঁথে কারো গলায় পরালে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে কিন্তু রান্না করে খাওয়ালে খুশীতে গলায় জড়িয়ে ধরবে? একটি ৫-৬ বছরের ছোট্ট বাচ্চাও অবাক করে বলে দিবে, ফুলকপি। আপনি বলুন, ভাবুন, কথা ঠিক কিনা। ভাল করে ফুলকপি রান্না করে খাওয়ালে কোন বাঙ্গালী খাবে না, আমি নিশ্চিত এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।

শীতের সময়টা যারা ডায়েট কন্ট্রোল করে থাকেন তাদের জন্য উপযুক্ত সময়। বাজারে হাতের নাগালেই পাওয়া যায় নানা সবজি। টমেটো, বেগুন থেকে শুরু করে শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাঁজর, লাউ, মূলাসহ নানা সবজি। তবে এই খাবারগুলো এক ভাবে খেতে খেতে একটি একঘেয়েমি চলে আসে। সবজি নানা স্বাদের নানা ধরনের হলেও এর সাহায্যে তৈরি করা খাবার মুখোরোচক না হলে বেশিদিন খেতে ভালো লাগে না। তাই এই খাবারে ভিন্নতা আনা জরুরি।

ফুলকপি হল cruciferous (ক্রুসিফেরাস) উদ্ভিদ যা প্রাকৃতিকভাবে ফাইবার এবং বি-ভিটামিনে পূর্ণ এবং দেখতে ব্রকলির সাদা সংস্করণের মতো। ব্রকলির মতো, ফুলকপির শক্তভাবে বাঁধা ফুলগুলি একটি ঘন কোর দ্বারা সংযুক্ত থাকে, প্রায়শই এটির চারপাশে কয়েকটি হালকা পাতা থাকে। এর ইংরেজি নাম Cauliflower.

সাদা সবচেয়ে সাধারণ রঙ হলেও, আপনি কমলা, বেগুনি এবং সবুজ রঙের শেডগুলিতে ফুলকপি দেখতে পাবেন। রঙ যাই হোক না কেন, স্বাদটি একই: হালকা, কিছুটা মিষ্টি, খানিকটা nutty স্বাদের। ফুলকপি মূলত ভূমধ্যসাগর অঞ্চল থেকে এসে ১৫শ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপে পৌঁছেছিল।

ফুলকপি:

শীতের সময়ের অন্যতম খাবার হচ্ছে ফুলকপি। সবজি হিসেবে খাওয়ার পাশাপাশি এটি আপনি পরিবেশন করতে পারেন নাস্তার টেবিলেও। ফুলকপি আধা সিদ্ধ করে তা বেসনে মাখিয়ে তেলে ভেজে বিকেলের নাস্তায় পরিবেশন করতে পারেন। এটি খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি শরীরের পক্ষেও উপকারী।

শীতের সবজি আর পিঠা—এ দুটোই শীতের মজার খাবার। পুরো শীতকাল জুড়ে সবজির বাজার নানা রকম সবজিতে থাকে ঠাসা। ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, ব্রকলি, টমেটো, গাজর, শালগম, শিম, চিনা বাঁধাকপি, বেগুনি রঙের বাঁধাকপি, কত-না সবজি। এর সঙ্গে রয়েছে শীতের মজাদার মূলা শাক, পালংশাক। এসব শাকসবজি খেয়ে পুরো শীতকাল চনমনে হয়ে উঠতে পারেন, বাড়াতে পারেন দেহের পুষ্টি। যদিও শীতের বেশ কিছু সবজি এখন অন্য সময়েও পাওয়া যায়, তবু শীতকালে শীতের সবজির স্বাদই যেন আলাদা।

শীতের শিশিরে সবজি থাকে টাটকা। শাকসবজি যত টাটকা খেতে পারবেন, তার পুষ্টিগুণ তত বেশি ঠিক থাকবে। ক্ষেত থেকে তোলার পরই সবজির অনেক পুষ্টিগুণ নষ্ট হতে থাকে। যেমন টমেটো ক্ষেত থেকে তোলার তিন দিনের মধ্যে তার ভিটামিন “সি” প্রায় অর্ধেক কমে যায়। তাই যে সবজিই খাবেন, সতেজ ও টাটকা সবজি খাওয়ার চেষ্টা করবেন।

ফুলকপি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করে যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এটিতে ওজন হ্রাস এবং হজমশক্তি, কোলাইন যা স্মৃতিশক্তির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অন্যান্য অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে।

ফুলকপির উপকারিতা

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রগুলি (সিডিসি) দ্বারা প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পাওয়ারহাউস ফল এবং শাকসবজির একটি তালিকায় ফুলকপি ২৪তম বিশ্বাসযোগ্য উৎস হিসাবে বলা হয়েছে। নিচে ফুলকপির উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

হজমে সহায়তা করে ও কোষ্টকাঠিন্য দূর করে :

ফুলকপির মধ্যে ফাইবার এবং পানির পরিমাণ বেশি। উভয়ই কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যকর হজমশক্তি রক্ষা এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে যে ডায়েটরি ফাইবারগুলি প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। ফলস্বরূপ, এটি প্রদাহজনিত সংক্রমণ যেমন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার এবং স্থূলতার ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে।

উচ্চতর ফাইবার গ্রহণের ফলে রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে এবং স্থূলতাজনিত লোকের জন্য ওজন হ্রাস বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।

স্মৃতিশক্তি ধরে রাখে :

কোলাইন ফুলকপির একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমুখী “ভিটামিন-জাতীয় ফ্যাক্টর” যা ঘুম, পেশীগুলির গতিবিধি, শিখতে এবং স্মৃতিতে সহায়তা করে। এটি সেলুলার ঝিল্লির গঠন বজায় রাখতে সহায়তা করে, স্নায়ু আবেগ সংক্রমণে সহায়তা করে, চর্বি শোষণে সহায়তা করে এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হ্রাস করে।

শক্তিশালী হাড়ের গঠন বজায় রাখে:

ভিটামিন “কে” এর অভাবে হাড়ের ফাটল এবং অস্টিওপরোসিসের উচ্চ ঝুঁকিরসম্ভাবনা থাকে। ভিটামিন “কে” সেবন হাড়ের ম্যাট্রিক্স প্রোটিনের সংশোধক হিসাবে কাজ করে, ক্যালসিয়াম শোষণকে উন্নত করে এবং প্রস্রাবে ক্যালসিয়ামের নির্গমন রোধ করে হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে।

ক্যান্সার প্রতিরোধ করে :

ফুলকপিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা সেলুলার রূপান্তরগুলি রোধ করতে এবং ফ্রি র‌্যাডিকালগুলি থেকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করতে সহায়তা করে। এর মধ্যে একটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হ’ল ইনডোল-3-কার্বিনল বা আই 3 সি, সাধারণত ক্রুসিফেরাস শাকগুলিতে যেমন বাঁধাকপি, ব্রোকলি এবং ফুলকপিতে পাওয়া যায়। ক্রুসিফেরাস শাকসবজি খাওয়ার সাথে ফুসফুস এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে কমার সম্পর্ক রয়েছে।

কিভাবে রাসায়নিক মুক্ত করা যায়?

বাজার থেকে এসব সবজি কেনার সময় গন্ধ শুঁকে কীটনাশকের উপস্থিতি কিছুটা বোঝা যায়। যদি দু-এক দিন আগে এসব সবজিতে কোনো কীটনাশক স্প্রে করা হয়ে থাকে, সেসব সবজি থেকে কীটনাশকের কিছুটা গন্ধ পাওয়া যাবে। কোনো ঝুঁকি নিতে না চাইলে রান্নার আগে সবজিগুলো লবণ বা তেঁতুল-গোলা পানিতে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখবেন।

প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম লবণ বা তেঁতুল মিশিয়ে এ দ্রবণ তৈরি করা যায়। এভাবে ভেজালে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বিষ দ্রবণে গুলে শাকসবজি থেকে বেরিয়ে আসে। ফলে বিষাক্ততা কমে যায়।

এরপর সেসব সবজি আবার পরিষ্কার পানিতে ভালো করে ধুয়ে নেবেন। এরপর রান্না করলে তাপে বাকি বিষটুকুর অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে শোধনের ফলে বিষাক্ত শাকসবজির বিষাক্ততা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কমে যায় ও সবজিগুলো সতেজ হয়ে ওঠে।

শীতের দিনে ভাতের বিকল্প :

ফুলকপি হলো শীতের এক প্রধান সবজি। ভাতের বিকল্প হিসেবে আপনি এটি বেছে নিতে পারেন। কেননা, এর অন্যতম খাদ্য উপাদান হলো লো ক্যালরি। সাধারণত এক কাপ ফুলকপিতে ২৯ শতাংশ লো ক্যালরি থাকে। তাই ভাতের বিকল্প শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। লো ক্যালরি আপনার ডায়েট পূরণ করবে শতভাগ।

ফুলকপি দিয়ে অনেক মজার মজার খাবার তৈরি করা যায়। শীতের সকালে গরম ভাতের সাথে যার জুড়ি মেলা ভার। যেমনঃ ফুলকপির কোর্মা, ফুলকপির রোস্ট, নিরামিষ ফুলকপি আলুর রসা, ফুলকপি ভাজি পেঁয়াজ দিয়ে, ফুলকপি দিয়ে ট্যাংরাসহ বিভিন্ন মাছের ঝোল ইত্যাদি। বিকালে চায়ের সাথে গরম গরম ফুলকপির পাকোড়া খেতে খুব মজা লাগে।

সাবধানতাঃ

কোনোকিছু অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়। তাই পরিমাণমতো খাবেন। আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

শীতকালে সবজি খাওয়ার আরেকটা সুবিধা আছে। তা হলো, শীতকালে শাকসবজিতে পোকামাকড়ের উপদ্রব থাকে কম। তাই শাকসবজিতে বিষাক্ত কীটনাশক গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম দেওয়া হয়। সে জন্য শীতকালের সবজি খাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে কম।

তবু কোনো কোনো সবজি, বিশেষ করে ফুলকপি, বাঁধাকপি ও শিমে অনেকে নির্বিচারে কীটনাশক দিয়ে থাকেন। তুলনামূলকভাবে এ তিনটি শীতের সবজি তাই কখনো কখনো স্বাস্থ্যের উপকারের বদলে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ফুলকপির রোস্ট ভিডিও: