পায়েস বা রাইস ক্ষীর হজমে সহায়ক, শক্তির ভান্ডার ও আনন্দিত করে তোলে।

আমরা বাঙালি। আমাদের প্রধান খাবার হলো ভাত। অন্য যত খাবার খাই না কেন ভাত না হলে আমাদের চলে না। হাজার হাজার বছর আগে থেকে আবহমান বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতিতে গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু।

আর এর কল্যাণে দুধ দিয়ে ভাত খাওয়ার প্রচলনও বহু পুরানো। এরপর দুধ দিয়েই ভাত রান্না করা শুরু হলো। এই ভাত বা অন্নের সঙ্গে মিষ্টি অর্থাৎ গুড় মিশে তৈরি হলো মিষ্টান্ন বা পায়েস।

আগে পায়েসের সাথে তেজপাতা ও কর্পূরের বন্ধুত্ব থাকলেও পরে আস্তে আস্তে কিসমিস, এলাচি ও বাদামের সাথে ভালোবাসার কেমিস্ট্রি একেবারে জমে উঠেছে। বর্তমানে পায়েসের সাজসজ্জায় ডালিমের লাল দানা বা গোলাপ ফুলের লাল পাপড়ি ছড়াতে দেখা যায়।

পায়েস কি বা কাকে বলে?

সহজ ভাষায় চাল বা ভাত, গরুর দুধ বা নারকেলের দুধে সেদ্ধ করে, গুড় বা চিনি দিয়ে নামিয়ে গরম গরম যে খাবারটি উপভোগ করা হয় তাকে পায়েস বলে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাঙালি cousin-এর জনপ্রিয় ডেসার্ট বা শেষ পাতের লোভনীয় হজমকারক।

ক্ষীর বা পায়েস বা মিষ্টান্ন ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাধিক বিখ্যাত মিষ্টি খাবার। খির বা পাইসাম হল ভারতীয় উপমহাদেশের এক ধরণের পুডিং। আয়ুর্বেদের লিপির উপর ভিত্তি করে, পায়েসের রেসিপিটি ভারতের অন্যতম প্রাচীন রেসিপি।

পায়েসের বিভিন্ন নাম:

এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। রোমানরা এর আগে ক্ষীর বা পায়েসকে পেটের শীতলকারক হিসাবে ব্যবহার করতেন। ক্ষীর’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ Ksheer(क्षीर) থেকে উৎপত্তি। ক্ষীর মিষ্টি চালের পুডিংয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নাম। পায়েস একটি রাইস পুডিং জাতীয় খাবার যা ভারতীয় উপমহাদেশে খুবই জনপ্রিয়।

সংস্কৃত নাম क्षीर (ক্ষীর)/ पायसम् “পায়াসম (payasam)”। হিন্দি, खीर khīr; পাঞ্জাবি, کھیر/ਖੀਰ; উড়িয়া, ଖିରି khiri; সিন্ধি, کھیر; উর্দু, کھیر; এবং নেপালি: खिर। পায়াসাম হিসেবে তামিল: பாயாசம், তেলেগু: పాయసం, মালায়ালম: പായസം, পায়েস হিসেবে কন্নড়: ಪಾಯಸ, বাংলা: পায়েস, সিলেটি: পায়েস, অসমীয়া: পায়স এবং কোঙ্কানি पायस। ফিরনি হলো পায়েসের পারস্য সংস্করণ।

সকল উৎসবে পায়েস প্রস্তুত করা হয়। ক্ষীর শব্দটি উত্তর ভারতে ব্যবহার করা হয়। সম্ভবত সংস্কৃত শব্দ ক্ষীর থেকে এসেছে যার অর্থ দুধ। ক্ষীরের আরেকটি নাম পায়েস বা পায়াসম বাংলায় ব্যবহৃত হয় যা সংস্কৃত পায়াসা বা পায়াসাম থেকে এসেছে যার অর্থ দুধ।

বিবাহ, জন্মদিন বা  যেকোনো শুভ উৎসবে পায়েস না হলে আমাদের চলে না।

প্রকৃতপক্ষে, সুস্বাদু ডেসার্ট পায়েস শুধু আমাদের মুখের তৃপ্তির জন্য নয়, এটি আমাদের শারীরিক সুস্থতা, মানসিক সুস্থতা এবং যৌন স্বাস্থ্যের জন্যও সমান গুরুত্ব বহন করে। বন্ধু-বান্ধব, পরিবার পরিজন নিয়ে আয়েস করে পায়েস খাওয়ার যে কি মজা তা আমরা বাঙালি ছাড়া কেউ জানে কিনা সন্দেহ।

পায়েস বা ক্ষীরের উপকারিতা বা স্বাস্থ্যসুবিধাঃ

ক্ষীর প্রাচীন ভারতীয় ডায়েটের একটি অংশ ছিল এবং আয়ুর্বেদে তার উল্লেখ রয়েছে। ক্ষীর বা পায়েস যেমন দক্ষিণ ভারতে পরিচিত, প্রাচীন ভারতের একটি জনপ্রিয় পদ ছিল, যা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল।

একটি সূত্র রয়েছে যা দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে এসেছে। পায়েস হিন্দু মন্দিরের খাবারও, বিশেষত, এটি শিবের সাথে সম্পর্কিত ছিল এবং তাঁর ভক্তদের কাছে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করতেন।

হাড়ের শক্তির জন্য দুধ:

দুধে হাড়-শক্তিশালী উপাদান, প্রোটিন, প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাস রয়েছে। এগুলি হাড়ের খনিজ ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য, জয়েন্টগুলিকে শক্তিশালীকরণ এবং সংযোজক টিস্যুগুলিকে জীবনের পরবর্তী বছরগুলিতে অস্টিওপরোসিস, আর্থ্রাইটিসের মারাত্মক ক্ষয়জনিত প্রদাহজনিত অসুস্থ্যতা থেকে রক্ষা করে।

এলাচি যৌন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো:

পর্যাপ্ত এফ্রোডিসিয়াক এবং উত্তেজক বৈশিষ্ট্য সহ এলাচ একটি শক্তিশালী মশলা যা যৌন স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, পাশাপাশি কার্যকরভাবে ইরেক্টাইল ডিসফাঙ্কশন এর সমস্যাগুলি মোকাবেলা করে। উপরন্তু, এটি একটি স্বতন্ত্র লোভনীয় সুবাস ধারণ করে এবং ক্লান্তি, অলসতা, উৎসাহ, মেজাজ এবং প্রজনন সুস্থ্যতা বাড়াতে শক্তি সরবরাহ করে।

হার্টের সুস্থতার জন্য বাদাম:

ভিটামিন ই এবং জিঙ্ক ছাড়াও বাদামে প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান অসম্পৃক্ত ফ্যাট থাকে। এই গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিকর উপাদানগুলি রক্ত, হৃদরোগের কোলেস্টেরল ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্ডিয়াক কার্য সম্পাদন করতে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়াকলাপকে উৎসাহ দেয় এবং এথেরোস্ক্লেরোসিস এবং এরিথমিয়া সহ অসুস্থ্যতা থেকে শরীরকে সুরক্ষিত করার জন্য বিখ্যাত।

শরীর শীতল করে:

এটি মানবদেহে একটি সম্পূর্ণ শীতল প্রভাব সরবরাহ করে। গ্রীষ্মের মরসুমে এটি খুব সহায়ক যখন একটি সূক্ষ্ম শক্তি থাকে যা বিপাক নিয়ন্ত্রণ এবং দেহের অত্যধিক তাপ  নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়।

পুষ্টির ভান্ডার:

সাদা চালের পরিবর্তে পায়েসে বাদামি চাল ব্যবহার করুন। বাদামি চাল ব্যবহার করার কয়েকটি কারণ হল: বাদামি চাল অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং সাধারণত আঠালো যুক্ত থাকে। এতে কোনও কোলেস্টেরল বা ট্রান্স ফ্যাট থাকে না। বাদামি চালে পাওয়া যাবে ফোলেট, বি ভিটামিন, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, সেলেনিয়াম এবং আরও অনেক কিছু।

শরীর চাঙ্গা রাখে ও শক্তি যোগায়:

অত্যন্ত পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ পায়েস বা ক্ষীর। দুধে তৈরি খাবারেও রয়েছে উচ্চমাত্রার পুষ্টিগুণ। এতে ক্যালসিয়াম ছাড়াও ফসফরাস, আয়রন, জিংক, কপার, ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে পায়েস শরীরকে চাঙ্গা রাখে, শক্তি জোগায়।

যাদের ডায়াবেটিক আছে তাদের খাবারটি এড়িয়ে যেতেই হবে।

পায়েস রান্নার সহজ ও ঝটপট রেসিপি:

অল্প সময়েই তৈরি করা যায় পায়েস। পায়েস রান্না করতে লাগবে  দুধ এক লিটার, কালিজিরা কিংবা সুগন্ধি পোলাউয়ের চাল ১৫০ গ্রাম, চিনি ২৫০ গ্রাম বা খজুরে গুড় ১৫০ গ্রাম, দারচিনি, এলাচ দুটি, লবণ এক চিমটি, কিশমিশ ৫০ গ্রাম এবং বাদাম কুচি ৫০ গ্রাম।

প্রথমে দুধ ভালো করে জ্বাল দিয়ে কমিয়ে তিন পোয়ার মতো করতে হবে। এ সময় দুধে দারচিনি, এলাচ দিতে হবে। এর আগে চাল ভিজিয়ে রাখতে হবে। ভেজানো চাল দুধে ছাড়তে হবে। চাল ফুটে উঠলে লবণ, চিনি ও গুড় মিশিয়ে আরো জ্বাল দিতে হবে। ঘন হয়ে এলে তেজপাতা, কিশমিশ দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে। পরিবেশনের আগে পেস্তা বা কাজুবাদাম দিয়ে পরিবেশন করলে স্বাদে বৈচিত্র্য আসবে।

সতর্কতাঃ

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নোই। আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে কোনো ওষুধ গ্রহণ করলে খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ

wiki, netmeds