লাউয়ের রস হার্ট ভালো রাখে, শরীর ঠান্ডা রাখে ও ভালো ঘুম আনে।

রান্না করে তো আমরা লাউ সবসময় খেয়ে থাকি। ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করুন। এবার রান্না না করে এই সবজিটি রস করে খান। লাউয়ের রস সবাই খেতে পারেন, বিশেষ করে যাঁরা ডায়াবেটিসে ভোগেন তাঁদের জন্য তো লাউয়ের রস খুব উপকারী কারণ এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ কম করে ও রক্তচাপের ভারসাম্য ঠিক থাকে। যারা মানসিক চাপে থাকেন ও ঘুম ভালো হয় না তারাও।

লাউ সবজিটির সাথে শীতল প্রভাব বা Cooling effect একেবারে সমার্থক হয়ে উঠেছে। লাউয়ে ৯২% জল থাকে। এটি শুধু শরীর ঠান্ডা রাখে না, তদুপরি এটি মূত্রবর্ধক, হজমকারক ও হাটের বন্ধু।

আমরা বাঙ্গালীরা একে লাউ বা কদু নামে চিনলেও ইংরেজিতে এটি Bottle gourd নামে পরিচিত। এছাড়া এটি calabash gourd, white-flowered gourd, New Guinea bean, Tasmania bean and long melon-নামে পরিচিত।

এগুলি বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। লম্বা অর্থাৎ বোতলের মতো এবং বৃত্তাকার, ছোট এবং বোতল আকারের। এগুলি এক মিটার দীর্ঘ হতে পারে। Cucurbitaceae -পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই ফলটি Lagenaria গোত্র বা শ্রেণীর। বৈজ্ঞানিক নাম: Lagenaria siceraria।

লাউয়ে রয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ যেমন: ভিটামিন “সি”, ভিটামিন “বি”, ভিটামিন “কে”, ভিটামিন “এ”, ভিটামিন “ই”, আয়রন, ফোলেট ও ম্যাঙ্গানিজ। আমরা অনেকেই এটা হয়ত জানি না যে লাউতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন “সি” রয়েছে। ২৫০ গ্রাম লাউ থেকে আমরা ২৫ এমজি ভিটামিন “সি” পাই, আমাদের সারা দিনে যতখানি ভিটামিন “সি” লাগে তার প্রায় অর্ধেক।

রস কীভাবে বানাবেন:

লাউয়ের ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে কেটে ব্লেন্ডারে দিয়ে রস করে নিন। এবার এর সঙ্গে একটু গোলমরিচ, পরিমাণ মতো বিট লবণ ও পুদিনা পাতা মিশিয়ে নিন। এর সঙ্গে চা-চামচের এক চামচ আদাবাটা যোগ করুন। শেষে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস যোগ করতে পারেন।

লাউয়ের রস বা জুসের উপকারিতা:

এটিতে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি, ভিটামিন কে, ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, আয়রন, ফোলেট, পটাসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে।

আপনার শরীরকে শীতল করে:

Bottle Gourd বা লাউয়ের রস আপনার শরীরে শীতল প্রভাব ফেলে এবং বিশেষত গ্রীষ্মের সময় আপনার শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে। এটি আপনার পেটকে শীতল রাখে এবং শরীরের তাপ কমায়। গ্রীষ্মকালে আপনি যেহেতু প্রচুর ঘামেন সেহেতু নিয়মিত লাউয়ের রস পান করা পানির ক্ষতি পূরণ করতে সাহায্য করে।

ওজন কমাতে সহায়তা করে:

লাউয়ের রস ওজন কমাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি ফাইবারযুক্ত রয়েছে যা আপনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিপূর্ণ রাখতে সহায়তা করে এবং এটি ক্যালোরিতেও কম। ফাইবার ওজন হ্রাসের মূল বিষয়। লাউয়ের রসে কোনও ফ্যাট ছাড়াই কম ক্যালোরি থাকে। বেশ কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, যে কোনও ভাবেই হোক, তা তরকারি বানিয়ে অথবা রস হিসেবে, লাউ খাওয়া শুরু করলে শরীরে ফাইবারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে খিদে কমে যায়। সেই সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কমে খাওয়ার পরিমাণও। আর কম খেলে ওজন যে দ্রুত কমে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে

অন্ত্র ঠিক রাখে:

যেহেতু লাউ খুব সহজে হজম হয়ে যায় তাই গরমকালে যখন আমাদের পাচনতন্ত্র একটু দুর্বল থাকে তখন লাউ খেলে তা খুব সহজেই হজম হয় যায়। লাউয়ে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার আছে বলে সবজিটি হজমে সহায়তা করে। তাই লাউ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, গ্যাস-অম্বল দূর করতে সাহায্য করে ও অর্শ সারায়। লাউয়ে পানি ও ফাইবার মাত্রা বেশি থাকে বলে এটা আমাদের পাচনতন্ত্র ও অন্ত্র ঠিক রাখে।।

ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ে ও ব্রণ কমায়:

লাউ থেকে আমরা যে ভিটামিন “সি” এবং জিংক পাই তা ত্বকের অকাল বার্ধক্য ও কুঁচকে যাওয়াকে রোধ করতে সাহায্য করে। মস্তিষ্ক সচল রাখে এবং শরীরে কোলাজেন উৎপাদন করে। কোলাজেন একটি প্রোটিন যা আমাদের শরীরের টিসুকে শক্তিশালী বানায়।

লাউয়ে থাকে ভিটামিন “বি” যা চুলের অকালপক্ক্যতা রোধ করায় কার্যকরী। সেই সঙ্গে তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এই কারণেই তো প্রতিদিন লাউয়ের রস বা এই সবজিটি দিয়ে তৈরি কোনও না কোনও খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, লাউ খাওয়া শুরু করলে আরও বেশ কিছু উপকার মেলে। যেমন ধরুন মাত্রতিরিক্ত ঘাম হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সেই সঙ্গে ব্রণের মতো ত্বকের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও আর থাকে না।

রক্তচাপ ঠিক রাখে:

এতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে যা আমাদের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। গরমকালে আমরা খুব ঘামি বলে আমাদের শরীর থেকে পানির সঙ্গে ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায় তাই লাউ খেলে ক্লান্তি দূর হয়।

আপনার হৃদয়কে সুস্থ রাখুন:

প্রতিদিন সকালে খালি পেটে লাউয়ের রস নিয়মিত খাওয়া আপনার রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে সহায়তা করে এবং হৃদয়ের কার্যকারিতা বজায় রাখে।প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনবার এর রস পান করা আপনার স্বাস্থ্যকর হৃদয় বজায় রাখতে সহায়তা করবে এবং আপনার রক্তচাপের উপর নজর রাখবে।

মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়:

লাউয়ে রয়েছে কোলিন নামক এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রেস লেভেল তো কমেই। সেই সঙ্গে স্ট্রেস, হতাশা এবং অন্যান্য মানসিক ব্যাধি প্রতিরোধে সহায়তা করে।

ভালো ঘুন আনে:

অন্যান্য সুবিধার মধ্যে এটি ঘুমের ব্যাধিগুলি নিরাময়ে সহায়তা করে। আদর্শভাবে কিছু তিলের তেল লাউয়ের রসের সাথে মিশিয়ে নিন এবং আপনি ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যান।

ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের মতো রোগের প্রকোপ কমে:

বছরের এই সময়ে পরিবেশে নানাবিধ ক্ষতিকর জীবাণুর মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সংক্রমণের মতো রোগের প্রকোপ খুব বৃদ্ধি পায়। বিশেষত মেয়েদের মধ্যে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়। যে কোনও ধরনের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে লাউয়ের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে। শুধু তাই নয়, এই সবজিতে প্রচুর মাত্রায় পানি থাকার কারণে এটি খেলে প্রস্রাব খুব ভাল হয়, ফলে ‘ইউ টি আই’ এর মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এমনিতেই অনেকটা কমে যায়।

লাউ অতিরিক্ত পিত্ত বেরোনো বন্ধ করে বলে বদহজম কম হয়। যকৃৎ ভালো রাখে লাউ। এ যুগে যখন আমরা অনেক ধরণের ক্ষতিকর খাবার দাবার খাই তখন যকৃৎ সুস্থ্য রাখা খুব দরকার। আয়ুর্বেদের মতে লাউ যকৃৎ ভালো রাখে এবং যকৃতের ফোলা রোধ করে।

একটি দুর্দান্ত পোস্ট ওয়ার্কআউট পানীয়:

লাউয়ের রস  প্রাকৃতিক শর্করা উপস্থিত থাকার কারণে প্রাকৃতিক পোস্ট ওয়ার্কআউট পানীয় হিসাবে কাজ করে যা গ্লুকোজ স্তর পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে এবং আপনার প্রশিক্ষণ অধিবেশনকালে হারিয়ে যাওয়া শর্করা প্রতিস্থাপনে সহায়তা করে। প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায়  রস আপনার পেশীগুলির কার্যকারিতাও উন্নত করে।

লাউয়ের রস কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে সহায়তা করে এবং ডায়রিয়ার নিরাময়েও সহায়তা করে। জল এবং ফাইবার সামগ্রী আপনার হজম ট্র্যাক পরিষ্কার করতে সহায়তা করে এবং সহজেই অন্ত্রের গতি সঞ্চারের অনুমতি দেয়। ডায়রিয়ার চিকিত্সার জন্য, এক চিমটি লবণের সাথে এর রস পান করুন। এই কনকোশন শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। আয়ুর্বেদের মতে লাউয়ের রস হজমের জন্য দুর্দান্ত।

সতর্কতাঃ

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো ডাক্তারের তত্বাবধানে থেকে কোনো ওষুধ গ্রহণ করলে খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ

ndtv, indianexpress.com