অ্যালোভেরা শরবত হার্ট ভালো রাখে, পুষ্টির ঘাটতি দূর করে ও কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে।

অ্যালোভেরা শরবত বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি প্রাকৃতিক ভাবে শীতলকারক। তাই প্রচন্ড গরমে শীতল বুলাতে এক গ্লাস অ্যালোভেরা শরবতই যথেষ্ট। ত্বক বা চুলের পরিচর্যায় অ্যালোভেরা অতি পরিচিত নাম।

এর বাংলা নাম ঘৃতকুমারী বৈজ্ঞানিক নাম: Aloe vera, ইংরেজি: Medicinal aloe, Burn plant। তবে সারাবিশ্বের মানুষ একে অ্যালোভেরা হিসাবেই চিনে। অ্যালোভেরায় রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভেষজ গুণ।

মানবদেহের জন্য যে ২২টা এমিনো এসিড প্রয়োজন তার ৮টি অ্যালোভেরাতে রয়েছে। এছাড়াও আছে ভিটামিন “এ”, ভিটামিন বি-1, ভিটামিন বি-2, ভিটামিন বি-6, ভিটামিন বি-12, ভিটামিন “সি” এবং ভিটামিন “ই”

অ্যালোভেরার জুস খাওয়ার উপকারিতা

গরমে শরীরকে যদি চাঙ্গা রাখতে চান, তাহলে অ্যালোভেরার শরবত খাওয়া শুরু করে দিন। আসুন তাহলে জেনে নিই, সেগুলো সম্পর্কে-

হার্ট ভালো রাখে:

বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালোভেরা জুস খাওয়া মাত্র সারা শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের প্রভাব বেড়ে যায়, যার কারণে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের পাশাপাশি হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতেও সময় লাগে না। সেই সঙ্গে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাও হ্রাস পায়। ফলে কোনও ধরনের হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যেমন কমে তেমনি হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও দূর হয়।

aloe vera jel

ত্বকের জন্য:

অ্যালোভেরার রস ব্রণগুলির তীব্রতা এবং উপস্থিতি হ্রাস করতে সহায়তা করে। এটি সোরিয়াসিস এবং ডার্মাটাইটিসের (psoriasis and dermatitis) মতো ত্বকের সমস্যা হ্রাস করতেও সহায়তা করতে পারে।

অ্যালোভেরা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিনগুলির একটি সমৃদ্ধ উৎস যা আপনার ত্বকের জন্য ভালো।

অ্যালোভেরার জেল ব্যবহারের ফলে ব্রণ দূর হয়ে যায়। অ্যালোভেরাতে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং এন্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্যের রয়েছে যা ত্বকের যত্নে খুবই উপকারী। ত্বকের রোদে পোড়া ভাব দূর করতে, মসৃণ রাখতে, দাগ মুক্ত করতে এবং ত্বকে ব্রণের উপদ্রব কমাতে অ্যালোভেরা খুবই কার্যকরী।

পুষ্টির ঘাটতি দূর করে:

এতে ভিটামিন “বি”, “সি”, “ই” এবং ফলিক অ্যাসিডের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে। এছাড়া স্বল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম, জিংক, ক্রোমিয়াম, সোডিয়াম, সেলেনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, এবং ভিটামিন বি-12 রয়েছে। অ্যালোভেরা নিরামিষাশীদের জন্য দুর্দান্ত।

তাই নিয়মিত এই প্রকৃতিক উপদানটি খাওয়া শুরু করলে শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলের ঘাটতি দূর হয়। সেই সঙ্গে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ঘাটতিও দূর হতে থাকে। প্রসঙ্গত, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হল সেই উপাদান যা আমাদের শরীরকে রোগ মুক্ত রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

অ্যালোভেরা জেলকে যদি তুলসি, করলা অথবা আমলকির রসের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে পারেন তাহলে আরও বেশি উপকার মেলে। সেক্ষেত্রে ভিতর এবং বাইরে থেকে শরীরের ক্ষমতা তো বাড়েই, সেই সঙ্গে ছোট-বড় কোনও রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না।

aloe vera juice

হজম স্বাস্থ্য উন্নত করে:

আমাদের শরীরে হজম ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে অ্যালোভেরার জুস খুবই কার্যকরী। কারণ এই প্রকৃতিক উপাদানটি শরীরে প্রবেশ করার পর পাচক রসের ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। ২০১৮ সালে ১৫১ জনের তিনটি গবেষণায় প্রমাণ করে যে, অ্যালোভেরা IBS এর লক্ষণগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।

অ্যালোভেরা পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। ফলে, খাবার হজম হয় দ্রুত। একই সঙ্গে এটি অন্ত্রের খারাপ ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমায় এবং ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ায়। এতে স্বাভাবিক ভাবেই হজম ক্ষমতা বাড়ে।

ওজন কমাতে:

ওজন কমাতে অ্যালভেরা জুস বেশ কার্যকরী। ক্রনিক প্রদাহের কারণে শরীরে মেদ জমে। অ্যালোভেরা জুসের অ্যাণ্টি ইনফ্লামেনটরী উপাদান এই প্রদাহ রোধ করে ওজন হ্রাস করে থাকে। পুষ্টিবিদগণ এই সকল কারণে ডায়েট লিস্টে অ্যালোভেরা জুস রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

মুখের দুর্গন্ধ দূর করে:

২০১৪ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে অ্যালোভেরা জেল মাউথ ওয়াশের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে এমন একটি উপাদান আছে যা মুখের জীবাণু দূর করে মাড়ি ফোলা, মাড়ি থেকে রক্তপাত বন্ধ করে দিয়ে থাকে। এছাড়া মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে।

aloe vera water

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে:

অ্যালোভেরা শরবত রক্তে সুগারের পরিমাণ ঠিক রাখে এবং দেহে রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখে। ডায়াবেটিসের শুরুর দিকে নিয়মিত এর শরবত খাওয়া গেলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। সুতরাং খাওয়ার আগে বা খাওয়ার পরে নিয়মিত অ্যালোভেরা শরবত পান করুন তাহলে আপনার ডায়াবেটিস অনেকটাই নিয়ন্ত্রনে থাকবে।

ক্লিনিকাল ফার্মাসি ও থেরাপিউটিক্স জার্নালে প্রকাশিত ২০১৬ সালের মেটা-বিশ্লেষণ অনুসারে অ্যালোভেরা প্রিডিবিটিস এবং টাইপ-2 ডায়াবেটিসযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে “কিছুটা সম্ভাব্য সুবিধা” থাকতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:

সুস্থভাবে দীর্ঘদিন যদি বাঁচতে চান তাহলে অ্যালোভেরা রস খেতে ভুলবেন না যেন। কারণ নিয়মিত এই প্রকৃতিক উপাদানটি গ্রহণ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতটা শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে ছোট-বড় কোনো রোগই ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। সেই সঙ্গে সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে।

ক্লান্তি দূর করে:

দেহের দুর্বলতা দূর করতে অ্যালোভেরার জুসের গুন অনেক। আপনি যদি অ্যালোভেরার জুস নিয়মিত পান করেন তাহলে দেহের ক্লান্তি দূর হবে এবং তার সঙ্গে দেহ সতেজ ও সুন্দর থাকবে।

aloe juice

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে:

অ্যালোভেরার শরবত পান করলে এটি আমাদের অন্ত্রের পানির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অন্ত্রে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে মলকে সাধারণত সহজে বের হতে সহায়তা করে।

যদি আপনার কোষ্ঠকাঠিন্য হয় বা ঘন ঘন কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয় তবে আপনার প্রতিদিনের রুটিনে অ্যালোভেরার জুস যুক্ত করার চেষ্টা করুন। এছাড়া অ্যালোভেরা শরবতে প্রায় ২০ রকম অ্যামিনো অ্যাসিড আছে যা ইনফ্লামেশন এবং ব্যাকটেরিয়া রোধ করে হজম ও বুক জ্বালাপোড়া রোধ করে থাকে।

শরীর থেকে টক্সিক বের করে দেয়:

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এই রসটা যদি খেতে পারেন তাহলে শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টর পরিমাণ এতটাই বৃদ্ধি পায় যে দেহের প্রতিটি কোণায় জমতে থাকা টক্সিক উপাদানেরা বেরিয়ে যেতে শুরু করে।

প্রসঙ্গত, এই সব টক্সিক উপাদানদের মাত্রা যদি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাহলে শরীরের প্রতিটি অঙ্গের কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। ফলে নানাবিধ রোগ ঘারে চেপে বসতে সময়ই নেয় না। তাই বিষয়ে সাবধান থাকাটা জরুরি।

দাঁতের যত্নে অ্যালোভেরা:

অ্যালোভেরার জুস দাঁত এবং মাড়ির ব্যথা উপশম করে থাকে। দাঁতে কোন ইনফেকশন থাকলে তাও দূর করে দেয়। নিয়মিত অ্যালোভেরার জুস খাওয়ার ফলে দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করা সম্ভব।

aloe vera tree

পানিশূন্যতা দূর হয়:

এই উদ্ভিদটিতে প্রচুর পানি রয়েছে , তাই এটি ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধ করার জন্য একটি আদর্শ উপায়। অ্যালোভেরার শরবত খুবই শীতলকারক ও পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি থাকে, তাই এটি পানিশূন্যতা প্রতিরোধে একটি আদর্শ উপায়।

অ্যালোভেরার শরবত গরমে শরীরের জন্য খুবই উপকারী। গরমে যে পরিমাণ ঘাম বের হয়ে যায় তা পূরণের জন্য অ্যালোভেরার শরবত কার্যকরী। কঠোর পরিশ্রমের পরে ডাবের পানির পরিবর্তে অ্যালোভেরার শরবত খেতে পারেন।

লিভারের জন্য ভালো:

এই শরবত আপনার লিভারকে সুস্থ রাখার একটি দুর্দান্ত উপায়। কারণ দেহ পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্ট ও হাইড্রেটেড থাকলে লিভার সর্বোত্তমভাবে কাজ করে। অ্যালোভেরার শরবত লিভারের জন্য আদর্শ কারণ এটি হাইড্রেটিং এবং ফাইটোনিট্রিয়েন্ট সমৃদ্ধ।

অ্যালোভেরা জুস আমরা রাস্তার পাশ থেকে কিনে খেয়ে থাকি,তবে এটা সবসময় স্বাস্থ্যকর হয় না। তাই আমাদের উচিত এটা বাড়ি তৈরী করে খাওয়া। অ্যালোভেরা জুস তৈরী করা খুব সহজ।

প্রথমে, অ্যালোভেরা পাতা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। তারপর কেটে শাঁস বের করে একটি পরিষ্কার গ্লাসে রাখুন, তারপর একেএকে পরিমান মতো পানি, বিট লবণ, মধু, লেবুর রস দিয়ে মিশিয়ে খেয়ে নিন।

আমরা যদি অ্যালোভেরার ঔষধী গুনের কথা বিবেচনা করি তাহলে, প্রতিদিন ১ গ্লাস অ্যালোভেরা জুস খাওয়া উচিত। স্বাস্থ্যকর খাবার খান সুস্থ্য জীবন যাপন করুন -এটাই কাম্য।

সতর্কতা

আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অ্যালোভেরা খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

রেফারেন্স:
এই সম্পর্কিত আরও পোস্ট পড়ুন: