ব্রণ থেকে মুক্তি পাবার প্রাকৃতিক উপায়।

মেয়েদের মুখের সৌন্দর্যের ব্যাঘাত ঘটায় ব্রণ। ত্বকের উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য নষ্ট করার করার জন্য দায়ী এই ব্রণ এবং তার কালো দাগ। এই ব্রণের কারণে মেকাপ করলেও আমাদের মুখে ঠিক মতো মেকাপ সেট হতে চাই না।

কেউই চায় না তার মুখের সৌন্দর্য ব্রনের জন্য নষ্ট হয়ে যাক। কিন্তু আবহাওয়া অথবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে না চাইলেও ব্রনের সমস্যায় ভুগতেই হয়।

ব্রণ কেন হয়?

বয়ঃসন্ধিকালে হরমোন টেস্ট্রোরেন আর প্রোজেস্ট্রোরেনের প্রভাবে ত্বকের সিবেসিয়াস গ্রন্থি অধিক হারে তেল নিঃসরণ শুরু করে। কোনো কারণে সিবেসিয়াস গ্রন্থির নালির মুখ বন্ধ হয়ে গেলে সেবাম নিঃসরণের বাধার সৃষ্টি হয় এবং তা ভেতরে জমে ফুলে উঠে যা ব্রণ (Acne) নামে পরিচিত।

এর উপর জীবাণুর সংক্রমণ ঘটলে পুঁজ তৈরি হয়। অনেক সময় বাইরে থেকে ছোট দেখালেও বেশ গভীর হতে পারে। এজন্য ব্রণের সংক্রমণ সেরে গেলেও মুখে কাল দাগ থেকে যেতে পারে।

সাধারণত ১৩ বছর বয়স থেকে ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত শতকরা ৯০ জনের ব্রণ কমবেশি হয়ে থাকে। ২০ বছর বয়সের পর থেকে ব্রণের প্রকোপ কমতে থাকে।

ব্রণ থেকে মুক্তি পাবার প্ৰাকৃতিক উপায়

ব্রণ হল একটি সাধারণ ত্বকের রোগ যা ১০০ জন লোকের মধ্যে ৮৫ জন লোকের হয়ে থাকে। ব্রণ আমাদের খুবই হতাশ করে তোলে এবং এ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। যদিও আধুনিক চিকিৎসা আমাদের ব্রণ থেকে মুক্তি দিতে পারে।

তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে আমাদের ত্বকের উপর। তাইতো মানুষ এখনও প্রাকৃতিক উপায় গুলোর দিকে ছোটে। ব্রণ নিরাময়ের অনেকগুলি প্রাকৃতিক উপায় আছে। নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

তুলসী:

শুনলেই একটু অবাক হতে হয় যে, রূপচর্চায় খুব কাজে দিবে তুলসীর পাতা। কারণ ত্বকের অয়েলি ভাব নিয়ে সমস্যায় ভোগেন অনেকেই। বিশেষ করে তরুণীদের কাছে কমন অভিযোগের বিষয়। অয়েলি ত্বকে ব্রণের সমস্যা বেশি হয়। ত্বক অতিরিক্ত অয়েলি হওয়ার কারণে লোমকূপের মুখে ময়লা-জীবাণু আটকে থাকে। মরা কোষ দূর না হওয়ার কারণে ত্বকে ব্লাকহেডসের পরিমাণও বেড়ে যায়। এই সমস্যা থেকে বাচার সবচাইতে সহজ উপায় হচ্ছে তুলসী পাতার ব্যবহার।

কারণ এটি প্রাকৃতিক হওয়ার কারণে আপনার ত্বকের কোন ক্ষতি করবে না। তাই আপনি নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবেন। ভালো ফলাফল পেতে তুলসী পাতার সাথে গোলাপ জল, তুলসী বীজ, মধু ও চন্দন মিশিয়ে লাগাতে হবে। লাগিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। পারলে রোজ করুন এটা। ব্রণ, কালো দাগ দূর হওয়ার পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়বে।

মুলতানি মাটি:

অয়েলি ত্বক যাদের, তাদের ব্রণ বেশী হয়। তাই ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে হলে আগে অয়েলি ভাব কমাতে হবে। মুলতানি মাটি এক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করবে। কয়েক টুকরো শসা পেস্ট করে নিয়ে তার থেকে রস বের করে নিন। এরপর এর সাথে মুলতানি মাটি মিশিয়ে একটা পেস্ট তৈরি করুন।

এই পেস্টটি কিছুক্ষণ মুখে মুখে লাগিয়ে রাখুন। তারপর আলতো করে ভালো করে ম্যাসাজ করুন। দেখবেন অয়েলি ভাব কমে আসছে। এটা পারলে রোজই করুন, নয়তো একদিন অন্তর অন্তর। যদি এটা রোজ না করতে পারেন, শুধু শসার রস দিয়ে মুখ ধুলেও হবে।

নিমপাতা:

আমরা সবাই জানি নিমপাতা আমাদের ত্বকের জন্য কতটা উপকারী। আর ব্রণর জন্য নিমপাতা এক কথায় অতুলনীয়। এর অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ব্রণের হওয়ার হাত থেকে আপনার ত্বককে রক্ষা করতে পারে। তাই নিমপাতা ব্যবহার করুন।

নিমপাতা বেটে এর সাথে গোলাপজল মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করে নিন। চাইলে পেস্টটির সাথে এক চামচ মুলতানি মাটি যোগ করতে পারেন। এবার এই পেস্টটি মুখে লাগিয়ে রাখুন ২০ মিনিটের মতো। তারপর ধুয়ে ফেলুন ঠান্ডা পানি দিয়ে। সপ্তাহে ২দিন করার চেষ্টা করুন।

কাঁচা হলুদ এবং চন্দনের গুঁড়ো:

হলুদ বিশেষ করে ব্রণর জন্য দুর্দান্ত কারণ এটিতে কার্কুমিন রয়েছে, যেটা এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি হিসাবে কাজ করে। এই কারর্কুমিন শরীরের অতিরিক্ত মেলানিনের উৎপাদন হ্রাস করে।

মেলানিন শরীরের বিভিন্ন দাগকে আরও বেশি কালো করে তোলে। কাঁচা হলুদ এবং চন্দনকাঠের গুঁড়ো ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর পাশাপাশি ব্রণের জন্য খুবই ভালো। কাঁচা হলুদ বাটা এবংচন্দন কাঠের গুঁড়ো একত্রে নিয়ে এতে পরিমাণ মত পানি মিশিয়ে পেষ্ট তৈরি করতে হবে।

মিশ্রণটি এরপর ব্রণ আক্রান্ত জায়গায় লাগিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পর শুকিয়ে গেলে মুখ ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই মিশ্রণটি শুধুমাত্র ব্রণদূর করার কাজ করে না বরং ব্রণের দাগ দূর করতেও সাহায্য করে।

ডাবের পানি:

আমরা হয় তো অনেকেই জানিনা গ্লোয়িং ত্বকের একটি রহস্য হল ডাবের পানি। ডাবের পানি ত্বককে ভিতর থেকে তরতাজা রাখে ও আস্তে আস্তে উজ্জ্বলতা বাড়ায়। ডাবের পানিতে তুলে ভিজিয়ে ব্রণ আর উপরে লাগালে এটি দ্রুত দূর হয়ে যায়।

কমলা লেবুর খোসা:

কমলা লেবুর খোসা বেলেন্ড করে নিন। মসুরির ডাল আর চাল ভিজিয়ে ভালো করে পিষে নিন। তারপর চন্দন গুড়ি, মুলতানি মাটি, বেলেন্ড করা কমলা লেবুর খোসা ভালো করে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। চাইলে এই পেস্টটির মধ্যে দুই চামচ দুধও মিশিয়ে নিতে পারেন। মুখে ৩০মিনিট মতো লাগিয়ে রাখুন তারপর ধুয়ে ফেলুন। এই প্যাকটা নিয়মিত মুখে লাগান। ত্বকের জেল্লা বাড়বে। ব্রণের দাগও দূর হয়ে যাবে।

পাকা পেঁপের স্ক্রাব:

পেঁপে ব্রণের খুব ভাল প্রতিষেধক। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিন “এ” এবং এনজাইম আছে যা ব্রণ দূর করে ত্বককে নরম ও মসৃণ করে থাকে। ব্রণ হবার একটি অন্যতম কারণ হলো অপরিষ্কার ত্বক। তাই ত্বক রাখতে হবে পরিষ্কার। নিয়মিত স্ক্রাবিং ত্বককে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে।পাকা পেঁপে বাটা আর চালের গুঁড়ো মিশিয়ে নিন। এর সঙ্গে পাতিলেবুর রস যোগ করুন। মিশ্রণটা সারা মুখে লাগিয়ে নিন। হালকা হাতে ২০-২৫ মিনিট ম্যাসাজ করুন। এবার পরিষ্কার ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটা সপ্তাহে দু থেকে তিন দিন করুন। কয়েকদিন পর থেকেই আপনি বুঝতে পারবেন পার্থক্য।

বরফ:

যেকোনো ব্যাথা দূর করতে বরফ খুবই ভালো কাজ করে। ব্রণ হওয়া মানেই তার সঙ্গে আছে ব্যাথা। আর এই ব্যাথা সহ্য করার মতো কষ্ট কিছুই হয় না। এই সব থেকে রেহাই পাওয়া যায় বরফ ব্যবহার করলে। বরফ টুকরো নিয়ে সেটা ব্রণর জায়গায় ঘষুন হালকা করে। এটা রোজ পারলে দিনে দু’বার করে করুন। দেখবেন ব্রণর ব্যাথা অনেক কমে যাবে, খানিক আরাম পাবেন।

আপেল এবং মধুর মিশ্রণ:

আপেল এবং মধুর মিশ্রণ হচ্ছে ব্রণের দাগ দূর করার সবচেয়ে জনপ্রিয় ঘরোয়া পদ্ধতি। প্রথমে আপেলের পেষ্ট তৈরি করে তাতে ৪-৬ ফোঁটা মধু মিশাতে হবে।

মিশ্রণটি মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করেএরপর মুখ ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে ৫-৬ বার এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনি কয়েকদিনের মধ্যে পরিবর্তনটা অনুভব করতে পারবেন

গ্রীন টি:

গ্রীন টিতে থাকা ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং ট্যানিনগুলি ব্যাকটেরিয়ার সাথে লড়াই করতে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে বলে পরিচিত যা ব্রণর হওয়ার প্রধান দুটি কারণ। গ্রীন টি-এর প্রধান অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট – এপিগালোকটেকিন-3-গ্যালেট (EGCG) – ব্রণ জনিত সমস্যা যেমন সিবাম(sebum) উৎপাদন ব্রণের বৃদ্ধি হ্রাস করে, ব্যাথা কমায়।

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ত্বকে ২-৩% গ্রীন টি প্রয়োগ করা ব্রণ রোগীদের মধ্যে সিবাম উৎপাদন এবং pimples উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
গরম পানিতে গ্রীন টি ব্যাগ ভিজিয়ে চা বানিয়ে নিন। চা ঠান্ডা করে স্প্রে বোতলে ঢেলে নিয়ে মুখে স্পেরে করুন।

শুকিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন তারপর ধুয়ে ফেলুন। বাকি চা পাতির সাথে মধু যোগ করে পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্টটি মাস্ক হিসাবে ব্যাবহার করতে পারেন।

নারকেল তেলে:

অন্যান্য প্রাকৃতিক প্রতিকারের মতো, নারকেল তেলেও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল যৌগ থাকে। এই যৌগ থাকার অর্থ হল নারকেল তেল ব্রণ জনিত ব্যাকটিরিয়া ধ্বংস করতে পারে এবং লালচেভাব এবং পিম্পল গুলির ফোলাভাব কমাতে পারে।

খাঁটি নারকেল তেল যেখানে ব্রণ হয়েছে সরাসরি সেখানে নারকেল তেল দিয়ে আলতো ঘষুন। তারপর কিছুক্ষন রাখার পরে মুখ ধুয়ে ফেলুন। ব্রণ কমা না পর্যন্ত প্রতিদিন একবার করুন।

ব্রণ থেকে মুক্তি পাবার কিছু টিপস

  • প্রতিদিন ৯-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
  • যতটা সম্ভব তেলযুক্ত বা ফাষ্ট ফুড জাতীয় খাবার পরিহার করুন।
  • সব সময় বাইরে থেকে আসা মাত্র মুখ ফেইস ওয়াশ দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এতেকরে ত্বকে জমে থাকা ধূলোবালি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
  • চেষ্টা করুন দিনে ৪-৫ বার মুখ ধোয়ার।
  • অনেকেরই নখ দিয়ে ব্রণ খোটার বাজে অভ্যাস রয়েছে। এতে ব্রণের অবস্থা আরও খারাপ হবে। এর ফলে ব্রণ লাল হয়ে যাবে। এমনকি মুখে দাগ হয়ে যাবে।
  • মানসিক চাপ কমান ও যথেষ্ট ঘুম পড়ুন।

যারা বহুদিন যাবত ব্রণ ও ব্রণের দাগ সমস্যায় ভুগছেন, কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, তারা অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেন।