গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে গর্ভবতী মায়ের যত্ন ও সতর্কতা।

প্রথম ত্রৈমাসিকটি আপনার শেষ মাসিকের সময়কালের প্রথম দিন শুরু হয় এবং ১২ সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর অর্থ হল যে, আপনি যখন গর্ভবতী হয়েছিলেন তা নিশ্চিত হওয়ার পরে আপনি ইতিমধ্যে পাঁচ বা ছয় সপ্তাহ গর্ভবতী হতে পারেন বা গর্ভাবস্থা কাটিয়ে ফেলেছেন। এই প্রথম তিন মাসে অনেক কিছুই ঘটে।

রহস্যময়তায় বা ভালো মন্দে ভরা গর্ভকালীন প্রথম ৩ মাস বা ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার; হবু মায়ের যা যা জানা দরকার। গা ঝিমঝিম, ক্লান্তি ভাব, হাত-পায়ে, পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা, বমি বমি ভাব, আর সারা শরীরে আজব একটা স্পর্শকাতর অনুভূতি।

কী এমন হলো যে, হঠাৎ বমি শুরু হলো? ভাত-মাছ খেতে ইচ্ছে করছে না। আঁচার বা টক জাতীয় খাবার খেতে ভালো লাগে। শরীর-টরীর খারাপ হলো না তো। আরে না, না। শরীর কেন খারাপ হবে। এ যে নতুন অতিথি অর্থাৎ ছোট্টো রাজপুত্র বা রাজকন্যা আসার মিষ্টি আভাস। মা হতে চলেছেন আপনি।

খবরটার অপেক্ষায় হয়তো দিন রাত এক করেছেন এদ্দিন, কিন্তু শুধু একটু সচেতনতার অভাবে টেরই পাননি সেটা। যাক, দেরি হলেও মালুম যখন হয়েই গেছে, তবে এবার শুরু সচেতনতা, সতর্কতা আর নিজের খেয়াল রাখার পালা।

যেহেতু গর্ভস্থ সন্তানের এক্কেবারে শুরুর সময়, তাই মাকে থাকতে হবে অনেক বেশি তটস্থ। কিন্তু বললেই তো আর সতর্ক হওয়া যায় না।

কারণ অনেক ক্ষেত্রেই মায়েরা বুঝতেই পারেন না যে কী হচ্ছে বা কী হতে পারে। অনেকেরই নিজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণাই থাকে না, জানা থাকে না কী করলে সন্তানের ভালো বা খারাপ হতে পারে।

তাই গর্ভধারণের এই প্রথম পর্যায়টি (first trimester) অনেকের জন্যই ক্ষতির হতে পারে, যদি সঠিক যত্ন না হয়। তাই গর্ভধারণের প্রথম তিনটে মাস নিয়ে, মায়েদের শারীরিক অবস্থা্র সবকিছু নিয়েই আজকের এই আলোচনা।

প্রথমেই জেনে নিন আপনি প্রেগন্যান্ট কি না। আজকাল প্রেগন্যান্সি কিট কিনতে পাওয়া যায়। তা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এসব কিট দিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তার মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ পরীক্ষাই সঠিক হয় বলে ধরা হয়। তবে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হতে চাইলে ডাক্তারের পরামর্শে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। নিশ্চিত যখন হওয়া গেল, এবার তবে জানা যাক পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে।

firsttrimester

গর্ভাবস্থায় প্রথম ৩ মাসের সতর্কতা (First trimester: your essential pregnancy to-do list):

সাবধানে চলাফেরা করুন। অ্যালকোহল, ক্যাফেইন, ধূমপান থেকে দূরে থাকুন, তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেমনই হোক না কেন।

প্রথম ত্রৈমাসিকের সময় গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখানে:

এই সময়ের প্রয়োজনীয় পুষ্টি  উপাদানগুলো গ্রহণ করুন যেমনঃ ফলিক অ্যাসিড, আইরন, ক্যালসিয়াম ও জিংক ট্যাবলেট।

ব্যায়াম নিয়মিত তবে ভারী ব্যায়াম নয়। সহজ কিছু যোগব্যায়াম করুন।

ফলমূল, শাকসবজি, স্বল্প ফ্যাটযুক্ত প্রোটিন, এবং ফাইবার খান।

অনেক পানি পান করুন।

যেহেতু আপনি অন্তঃসত্ত্বা, তাই আপনাকে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। অতিসত্বর একজন ডাক্তার নির্বাচন করুন।

অন্তঃসত্ত্বা হবার কারনে শরীরে বেশ কিছু হরমোন পরিবর্তন ঘটে। যার ফলে বমি ভাব, মাথা ঘোরা, খেতে না পারা, শরীর খারাপ ভাব হতে পারে। তবে সবাইকে যে এই সকল পরিস্থিতি পার করতে হয় তাও নয়, অনেক মায়ের মধ্যেই এসবের কোনটি বা কখনও কখনও একটিও উপসর্গ দেখা যায় না।

এমন কিছু হলে ভয় পাবেন না, আবার না হলেও ভয় পাবেন না। বেশি বমি হলে সকালে উঠে লেবু পানি খেতে পারেন। আর মাথা বেশি ঘোরালে শুয়ে পড়ুন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

এছাড়াও হরমোন ঘটিত পরিবর্তনের কারনে এ সময় স্তনের আকারে পরিবর্তন হওয়া শুরু হয় ধীরে ধীরে। সেই কারণে স্তনে ব্যথা হবে ও স্তন নরম হয়ে যাবে। এমনটা হলে ভয় পাবেন না। মনে রাখবেন এই পরিবর্তন আপনার সন্তানের জন্য জরুরি।

সন্তান গর্ভে ধারণ করার ফলে কিছু শারীরিক পরিবর্তনও ঘটে। যেহেতু সন্তান জরায়ুতে ধারণ করা হয় ও জরায়ুর অবস্থান থাকে প্রসাবের নালীর উপরে, তাই বাচ্চার বৃদ্ধির সাথে সাথে জরায়ু প্রসাবের নালির উপরে কিছু চাপ ফেলে। ফলে প্রসাবের পরিমান বেড়ে যাবে। এই সমস্যা প্রথম ৩ মাস এবং শেষ ৩ মাসের মধ্যেই প্রবল থাকে বেশি।

অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারীরই গর্ভের বাচ্চার ওজন বাড়ার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই সাথে দেখা দিতে পারে সুগারের সমস্যা। তাই সন্তান গর্ভধারণের পরপর ডাক্তারের পরামর্শে সব কিছুর পরীক্ষা একবার করে নিয়ে দেখতে হবে গর্ভাবস্থা স্বাভাবিক আছে কি না। এমন কোনও সমস্যা দেখা দিলে নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে।

বুক জ্বালা করা এবং কোষ্ঠকাঠিন্যও হতে পারে অনেক মায়ের। অন্তঃসত্ত্বা নারীর খাবার হজম হতে ও পেট খালি হতে অন্য নারীদের তুলনায় বেশি সময় লাগে, কারন গর্ভস্থ বাচ্চার খাবার থেকে পুষ্টি গ্রহন করতে সময় লাগে একটু বেশি। কিন্তু এই কারণটাই গর্ভবতী নারীর জন্য হয়ে যায় কষ্টের কারণ।   ডাক্তারের পরামর্শে কোন ওষুধ সেবন করতে পারেন।

এছাড়াও একজন গর্ভবতী নারী গর্ভ ধারণ করেছেন এটা জানার পরে আনন্দিত, উদ্বিগ্ন, প্রফুল্ল ও ক্লান্ত ইত্যাদি সব ধরনের অনুভূতি অনুভব করেন। এত সব কিছু এক সাথে মানিয়ে নেয়াটাও একটা বড় ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়। অনেকেই ঠিক মত মানিয়ে নিতে পারেন না নতুন পরিস্থিতির সাথে।

ফলে শিকার হন মুড সুইং এর। সেই সাথে নানা রকম “হরমোনাল চেঞ্জ” এর কারণে রাগ বা খারাপ লাগা অনুভুত হতে পারে। এমন কিছু হলে অধিক উত্তেজনা পরিহার করে চলতে হবে। কারণ বেশি উত্তেজনা গর্ভস্থ সন্তানের জন্য ভাল নয়।

সঙ্গীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটু ধৈর্য ধরুন। প্রথম তিন মাসে সহবাস এড়িয়ে চলুন। এই সময়ে যৌন মিলনের ফলে গর্ভপাতের সম্ভাবনা থাকে। তাই বাবা-মা হওয়ার স্বার্থে একটু ধৈর্য ধারণ করুন।

মনে রাখবেন আপনি যে কাজ করছেন তা “প্রেগন্যান্সি সেফ” কিনা জেনে নিন। ভারি কোন কাজ একদম করতে যাবেন না। মনে রাখবেন প্রথম তিন মাস খুব সাবধানী হতে হবে কারণ এই তিন মাসেই এবরশনের হার সবচাইতে বেশি থাকে। সেই সাথে এমন খাবার খাবেন না যা বাচ্চার জন্য খারাপ হবে।

ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক কোন ওষুধ খাবার থাকলে তা খাবেন। এমনকি গ্যাসের সমস্যা বা মাথা ব্যাথা বা জ্বর হলেও ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খেতে যাবেন না। এতে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।

ঘুমের সময় বাড়িয়ে দিন। দিনে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা করে ঘুমানোর চেষ্টা করবেন। এছাড়াও সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকে হালকা বিশ্রাম নিতে পারেন।

মনে রাখবেন সন্তান সবার কাছেই মূল্যবান। সবাই চাইবে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে। তাই কষ্ট হলেও সন্তানের ভালোর জন্য সাবধানে সবকিছু মেনে চলার চেষ্টা করুন। সেই সাথে নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখুন। বিস্রামে থাকুন, উত্তেজিত থাকবেন না। সব থেকে বড় কথা হল নিজের খেয়াল রাখুন। আপনি ভাল থাকলেই আপনার সন্তানও ভাল থাকবে।