কয়েকটি স্বাস্থ্যকর জুস ও উপকারিতা।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সুষম খাবারের কোনো বিকল্প নেই। ভিটামিনস ও মিনারেলসের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ফল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পৃথিবীতে অনেক রকমের ফল পাওয়া যায়। তবে দেশভেদে ভিন্ন রকম ও স্বাদের ফল দেখা যায়।

ভিটামিন “সি” ও পটাশিয়ামের সবচেয়ে ভালো উৎস এই ফল থেকে আরও অনেক রকম পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। ফল খাওয়ার পাশাপাশি আমরা ফলের জুস করেও খেয়ে থাকি। যেকোন ফলের জুস আমাদের সকলের কাছে খুবই পছন্দের। অনেকে আছে আস্ত ফল খেতে চাই না কিন্তু ফলের ফলের জুস খাই।

এছাড়া অনেক সবজি আছে যেগুলো জুস করে খেয়ে থাকেন অনেক। এসব সবজির জুসও কিন্তু ফলের জুসের থেকে কোন অংশে কম নয়। নিচে কয়েটি ফলের জুস ও সবজির জুস এবং তার উপকারিতা দেওয়া হলো –

টমেটোর রস

আকর্ষণীয়তা, ভাল স্বাদ, উচ্চ পুষ্টিমান এবং বহুবিধ উপায়ে ব্যবহারযোগ্যতার কারণে সর্বত্রই টমেটো জনপ্রিয়। এ সবজিতে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন “এ” এবং ভিটামিন “সি” রয়েছে।

এক কাপ টমেটোর রসে রয়েছে-

  • ক্যালোরি: ৪১
  • চিনি: ৬ গ্রাম
  • ফোলেট: ১২%
  • পটাশিয়াম: ১১%
  • ভিটামিন “এ”: ৬%
  • ভিটামিন “সি”: ১৮৯%
  • ভিটামিন “ই”: ৫%
  • ভিটামিন “কে”: ৫%

টমেটোর জুস বিশেষত ভিটামিন সি-তে প্রচুর পরিমাণে থাকে, এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা আয়রন শোষণকে সমর্থন করে, ত্বকের স্বাস্থ্য এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নতি করে।

টমেটো অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট লাইকোপিনের অন্যতম উৎস, যা হার্টের রোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস সহ অনেক স্বাস্থ্য সুবিধার সাথে যুক্ত। ক্যারোটিনয়েড এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা টমেটোগুলিকে তাদের লাল রঙ দেয়। একটি পর্যালোচনাতে দেখা গেছে যে লাইকোপিন গ্রহণের বৃদ্ধি হার্ট ডিজিজের ঝুঁকি ১৩% কমাতে পারে।

বিট জুস

বিট স্বাস্থ্য বেনিফিটের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিটের রস জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রান্না করে খাওয়ার থেকে আপনি যদি এটি ব্লেন্ডারে রস বা জুইস করে খেতে পারেন তাহলে অনেক বেশি উপকার পাবেন।

এক কাপ বীটের রস সরবরাহ করে-

  • ক্যালোরি: ৭০
  • কার্বস: ১৮ গ্রাম
  • চিনি: ১৩ গ্রাম
  • প্রোটিন: ১.৫ গ্রাম

ফলের তুলনায় বেশিরভাগ শাক সবজিতে প্রাকৃতিকভাবে চিনির পরিমাণ কম থাকে। বিট বেটালাইনের একটি দুর্দান্ত উৎস, যা রঙ্গক বিটকে গাঢ় রঙ দেয়। বীটের রস শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে যা হার্টের রোগ, প্রদাহ এবং নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে।

বীটের রস নাইট্রেট বেশি থাকে, যা অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স বৃদ্ধি করে, রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

আপেল জুস

আপেলের পাশাপাশি আপেলের জুসও বেশ জনপ্রিয়। আপেলের জুস একাধিক উপকার সহ স্বাস্থ্যকর ফলের পানীয় হিসাবে বিবেচিত। এই বহুমুখী ফলের রসটিতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত।

১ কাপ আপেলের রসে আছে:

  • ক্যালোরি: ১১৪
  • কার্বস: ২৮ গ্রাম
  • চিনি: ২৪ গ্রাম
  • পটাসিয়াম: ৫%
  • ভিটামিন সি: ৩%

আপেলের রস পটাসিয়ামের একটি মাঝারি উৎস। পটাসিয়াম স্নায়ু সংকেত এবং হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই সুস্বাদু জুসটিতে অ্যান্টি-ক্যান্সার, অ্যান্টি-অ্যালার্জি এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাব সহ পলিফেনল এবং ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে।

আপেলের জুস হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, হাঁপানির লক্ষণগুলি কমাতে পারে, ওজন হ্রাসে সহায়তা করে এবং নির্দিষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। এছাড়া আপেলের রস ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিডের মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে উচ্চ পরিমাণে।

ডালিম জুস

ডালিমের রস পুষ্টিকর সুবিধার কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ডালিমের রক্ত লাল দানা ও সুমিষ্ট স্বাদের সাথে রয়েছে অনেক গুলি উপকারী যৌগ যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১ কাপ ডালিমের রস সরবরাহ করে-

  • ক্যালোরি: ১৩৪
  • কার্বস: ৩৩ গ্রাম
  • চিনি: ৩২ গ্রাম
  • পটাশিয়াম: ১১%
  • ভিটামিন “সি”: ১% এরও কম
  • ভিটামিন “কে”: ২২%

ডালিমের রসে ভিটামিন “কে” রয়েছে, যা রক্ত জমাট বাঁধা, হার্টের স্বাস্থ্য এবং হাড়ের বিকাশকে সহায়তা করে। পাশাপাশি ডালিমের রস স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, হার্ট ভালো রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

এই ফলে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট অ্যান্থোসায়ানিন (anthocyanin) বেশি, যা ডালিমগুলিকে তাদের গাঢ় লাল রঙ দেয়। ডালিমে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্রিন টিয়ের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। তাই প্রতিদিন আমাদের ডালিম খাওয়া বা ডালিমের রস পান করা উচিত।

কমলা জুস

সারা বিশ্ব জুড়ে বছরের প্রায় পুরো সময় ধরে, সর্বাধিক পানকৃত, ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের পরিচিত ও পছন্দের পানীয়টি বা রসটি হলো কমলালেবুর রস। এটি সুস্বাদু, এটি চিত্তাকর্ষক, এটি চিরকালীন বা সর্বদা আনন্দদায়ক।

এক কাপ কমলার রসে আছে

  • ক্যালোরি: ১১২
  • কার্বস: ২৬ গ্রাম
  • চিনি: ২১ গ্রাম
  • ফোলেট: ১৯%
  • পটাশিয়াম: ১১%
  • ভিটামিন “সি”: ১৩৮%

কমলার রস ভিটামিন “সি” এর একটি দুর্দান্ত উৎস। ভিটামিন “সি” একটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা ত্বকের স্বাস্থ্য এবং আয়রন শোষণের জন্য প্রয়োজনীয়। এই জুসে ফিনিলিক যৌগ যেমন সিনিয়ামিক (cinnamic), ফেরিউলিক (ferulic) এবং ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড (chlorogenic acids) রয়েছে।

এই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যৌগগুলি ফ্রি র‌্যাডিক্যালের সাথে লড়াই করতে সহায়তা করে।

কমলার রসে থাকা ভিটামিন “সি” হাড়ের গঠন, ক্ষত নিরাময়ে এবং মাড়ির স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সহায়তা করে। এছাড়া এই জুস ফোলেট সমৃদ্ধ, যা ডিএনএ সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় এবং ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং বিকাশকে সমর্থন করে।

এটি পটাসিয়ামেরও একটি উৎস যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে।

তরমুজের জুস

সারা পৃথিবীজুড়ে গ্রীস্মকালে এতো বিশুদ্ধ, এতো নিখুঁত রিফ্রেশমেন্ট দ্বিতীয়টি আর নেই। এন্টিঅক্সিডেন্ট, লাইকোপেন, অ্যামিনো অ্যাসিড, পটাসিয়াম – এর কোনোটিই আপনার ভাবনায় নেই।

১ কাপ তরমুজের জুসে-

  • ভিটামিন “সি” – ২১% (RDI)
  • ভিটামিন “এ” – ১৮% (RDI)
  • পটাসিয়াম – ৫% (RDI)
  • ম্যাগনেসিয়াম – ৪% (RDI)

তরমুজে থাকা ভিটামিন “সি” ত্বকের তারুণ্য বজায় রাখে। ত্বকের যে কোনো সংক্রমণে প্রতিরোধ ব্যাবস্থা গড়ে তুলে ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখে। তরমুজে বিদ্যমান লাইকোপেন এবং অন্যান্য প্লান্ট কম্পাউন্ড ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে থাকে। রক্তচাপ বজায় রাখে, পানিশুন্যতা দূর করে, চোখ ভালো রাখতে সহায়তা করে।

পেঁপের জুস

পেঁপে প্রকৃতির ওষুধ যা প্রায় সকল স্বাস্থ্য সমস্যার নিরাময় করতে পারে। গ্রীষ্মের তাপে শীতলতার পরশ বুলাতে আমরা কোল্ড ড্রিংক এর পরিবর্তে পাকা পেঁপের জুস খেতে পারি।

১ কাপ পেঁপের জুসে রয়েছে –

  • ক্যালোরি:৫৯
  • কার্বোহাইড্রেট: ১৫ গ্রাম
  • ভিটামিন “সি”: ১৫৭% (RDI)
  • ভিটামিন “এ”: ৩৩% (RDI)
  • ফোলেট (ভিটামিন বি-9): ১৪% (RDI)
  • পটাশিয়াম: ১১% (RDI)

সুমিষ্ট এই জুসটি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ যা প্রদাহ হ্রাস করতে পারে, রোগের সাথে লড়াই করতে পারে এবং তরুণ দেখাতে সহায়তা করে। পেঁপে ফলের মধ্যে দুটি এনজাইম, পাপাইন এবং কিমোপাপাইন থাকে। উভয় এনজাইমগুলি প্রোটিন হজম করে, এর অর্থ তারা হজমে সহায়তা করতে পারে এবং প্রদাহ হ্রাস করতে পারে।

গাজরের জুস

কমলা রং স্বাদে মিষ্টি এবং খুবই পুষ্টিকর সবজি এটি। ছোট থেকে বড় সকলের খুবই পছন্দের এই সবজিটির সব থেকে বড় গুণ হলো দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে।

গাজরের জুসে রয়েছে –

  • ক্যালোরি: ৯৬
  • কার্বস: ২২ গ্রাম
  • সুগার: ৯ গ্রাম
  • ভিটামিন “এ”: ২৫৫% (DV)
  • ভিটামিন “সি”: ২৩% (DV)
  • পটাশিয়াম: ১৫% (DV)

গাজরের জুসে ক্যালরি এবং শর্করা কম থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কারণ গাজরের রসে রয়েছে ভিটামিন “এ” এবং ভিটামিন “সি” উভয়ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে যা ইমিউন কোষকে ফ্রি র‌্যাডিক্যাল এর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

টেস্ট-টিউব সমীক্ষায় পরামর্শ দেওয়া হয় যে গাজরের জুস ক্যান্সার থেকে রক্ষা করতে পারে। এক কাপ গাজরের জুসে ২০% এর বেশি ভিটামিন “সি” রয়েছে। ভিটামিন “সি” ত্বকের কোলাজেন উৎপাদনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি ভিটামিন।

এছাড়া ভিটামিন “সি” ত্বকের কোষগুলিকে পুনরুত্থিত করে যা মুখের চামড়া কুঁচকিয়ে যাওয়া রোধ করতে সহায়তা করে।

আনারসের জুস

আনারস সুমিষ্ট, সুগন্ধ, ভিটামিন ও মিনারেলে পরিপূর্ণ এক কথায় অসাধারণ।

আনারসের জুসে রয়েছে –

  • ক্যালোরি: ৮২.৫
  • কার্বহাইড্রেট: ২১.৬ গ্রাম
  • ভিটামিন “সি”: ১৩১% (RDI)
  • ফোলেট: ৭% (RDI)
  • পটাশিয়াম: ৫% (RDI)
  • ম্যাগনেসিয়াম: ৫% (RDI)

আনারসের জুস বর্ষাকালের এই জ্বর সারাতে দারুন কার্যকর। আনারসে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান। সুমিষ্ট স্বাদের আনারসের জুস মুখের অরুচী দূর করার পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে ভিটামিন “সি” থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

আনারসে রয়েছে “ব্রোমেলিন” নামক একটি এনজাইম। এটি প্রোটিনকে সহজে ভেঙ্গে দেয়। ব্রোমেলিন আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করে।

আঙ্গুরের রস

আঙ্গুরের কিছু বিশেষ উপাদান রয়েছে, যার কারণে তাকে “সুপার ফুড” মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আঙ্গুরের খোসা, বীজ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন। রস করে খান।

আঙ্গুরের জুসে রয়েছে –

  • ক্যালোরি: ১০৪
  • কার্বহাইড্রেট: ২৭.৩ গ্রাম
  • ভিটামিন “সি”: ২৭% (RDI)
  • ভিটামিন “কে”: ২৮% (RDI)
  • ভিটামিন বি 6: ৬ % (RDI)
  • পটাশিয়াম: ৮ % (RDI)

ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে, রক্তের শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করতে পারে আঙ্গুরের রস। এছাড়া আঙ্গুরের রস হার্টের জন্য ভালো, চোখের জন্য ভালো, স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করতে এবং হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

রেফারেন্স: