স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় কোন খাবারগুলি।
স্ট্রোক এখন পুরো পৃথিবীতে মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। প্রতি ২০ জনের মৃত্যুর মধ্যে একজন এ রোগে মারা যাচ্ছে। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে,
কেবল যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর আট লাখের বেশি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় এবং এর ফলে ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
মস্তিষ্কে রক্তবাহী নালি ফেটে রক্তক্ষরণ বা রক্তনালি বন্ধ হওয়ার দুর্ঘটনা হলো স্ট্রোক। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বিকল হয়ে যায়।
রক্তচাপ কম থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়া প্রতিদিনের খাবারের স্বাস্থ্যকর ডায়েটের মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। অর্থাৎ এমন অনেক খাবার আছে যা খেলে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।
স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায় যে খাবারগুলি:
এবার জেনে নেওয়া যাক, কোন খাবারগুলি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে থাকে-
অ্যাভোকাডো:
পটাসিয়াম এমন একটি পুষ্টি যা বেশিরভাগ মানুষ পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় না। কলার থেকে অ্যাভোকাডোতে পটাসিয়াম পরিমানে বেশি।
১০০ গ্রাম কলাতে ১০% পটাসিয়াম এবং অ্যাভোকাডোতে ১৪% পটাসিয়াম থাকে।
বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে উচ্চ পটাসিয়াম গ্রহণ রক্তচাপ হ্রাস করতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের ঝুঁকির কারণ।
অ্যাভোকাডোতে থাকা মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে। অ্যাভোকাডো খাওয়া রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইডের পাশাপাশি LDL এবং HDL কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
মাছ:
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল প্রায় ১২ বছর ধরে ৫০০০ পূর্ণ বয়স্কদের নিয়ে একটি গবেষণা করে যাদের বয়স ৬৫ বছর অথবা তার বেশি।
এই গবেষণায় দেখানো হয় যে, যারা সপ্তাহে অন্তত ৪ দিন মাছ খান তাদের স্ট্রোকের ঝুঁকি প্রায় ২৭ শতাংশ কম থাকে।
যেসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা ৩ রয়েছে সেসব মাছ রক্তের প্রবাহ বাড়ায় এবং রক্তচাপ কমায়।
আর খাদ্য তালিকায় বেশি পরিমাণে মাছ রাখা মানে লাল মাংসের জায়গা কমে যায়। যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।
ওটমিল:
রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকলে তা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। তাই সর্বপ্রথম আপনার উচিত হবে রক্তে কোলেস্টেরল কমানো। তার জন্য ওটমিল বেশ ভালো।
ওটমিলে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার থাকে যা ক্ষুধা মেটায় কিন্তু ক্যালরি বা কার্বো কম বাড়ায়। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে আপনি প্রতিদিন ওটমিল খেতে পারেন।
শাকসবজি ও ফলমূল:
ফল ও সবজিতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা রক্তনালিকে ক্ষয় হ্রাস করতে সহায়তা করে। এতে থাকা পটাসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি পরিমাণ পটাসিয়াম গ্রহণ করে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৪ শতাংশ কমানো সম্ভব।
পটাসিয়ামযুক্ত খাবার হলো— কলা, ডাবের পানি, আমড়া, আমলকী, বরই, লেবু, কমলালেবু, আম, জাম, আলু, টমেটো, গাজর, ফুলকপি প্রভৃতি।
একটি মাঝারি আকারের কলায় ৪২২ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম থাকে। যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে খুবই কার্যকরী।
পুঁইশাক:
পুঁইশাকে প্রচুর পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম ভিটামিন “বি” (ফলেট) এবং ফলিক এসিড রয়েছে, যা ২০ শতাংশ স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া প্রায় দশ হাজার পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ওপর করা ২০ বছরের একটি গবেষণা থেকে বলা হয়, প্রতিদিন প্রায় ২০০ মাইক্রোগ্রাম ফলেট ভিটামিন অনেকাংশে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
ডার্ক চকোলেট:
সপ্তাহে ছয়টি ডার্ক চকোলেট খাওয়া করোনারি হার্ট ডিজিজ, ডায়াবেটিস এবং স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে।
একটি সমীক্ষা অনুসারে ডার্ক চকোলেটে উচ্চ ম্যাগনেসিয়াম সামগ্রী রয়েছে। প্রতি আউন্স ডার্ক চকোলেট মহিলাদের জন্য প্রস্তাবিত ম্যাগনেসিয়ামের ২০ শতাংশ এবং পুরুষদের ১৫ শতাংশ পূরণ করতে পারে।
ডার্ক চকোলেটের ফ্ল্যাভ্যানল শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন করে। নাইট্রিক অক্সাইডের ফলে রক্তনালীগুলি প্রশস্ত হয়, যা রক্ত প্রবাহকে উন্নত করে এবং রক্তচাপকে হ্রাস করে।
টমেটো:
যে কথাটি বলতে হয়, লাইকোপেন healthy cholesterol (HDL)-এর পরিমান বৃদ্ধি করে এবং খারাপ কোলেস্টেরোল (LDL)-এর পরিমান কমিয়ে দেয়।
এর ফলে ধমনীর গায়ে জমে থাকা চর্বি দূর হয় এবং রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাই। ফলে হার্ট ভালো থাকে।
কার্ডিভাস্কুলার disease অর্থাৎ হার্ট attack এবং স্ট্রোক বর্তমান পৃথিবীতে সবথেকে মরণঘাতী রোগ হিসাবে দেখা দিয়েছে।
মধ্যবয়স্ক কিছু ব্যাক্তির উপর গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে, যাদের রক্তে লাইকোপেন এবং বিটাক্যারোটেন এর পরিমান কম তাদের স্ট্রোক এবং হার্ট-এর রোগের ঝুঁকি বেশি।
বিটাক্যারোটেন ও লাইকোপেন দুটোই টমেটোতে পাওয়া যায়।
পালংশাক:
পালংশাকে আছে উচ্চ মাত্রার ম্যাগনেসিয়াম, যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও রয়েছে উচ্চ পরিমাণে নাইট্র্রেট রয়েছে, যা রক্তচাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
পালংশাকের মধ্যে পাওয়া অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা প্রদাহ হ্রাস এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাকের ফাইবার আছে ২.৪ গ্রাম – যা হার্টের রোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পরিচিত।
বাদাম:
বলা হয় প্রতিদিন এক মুষ্টি বাদাম আপনাকে কোলেস্টেরল থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই কয়েক ধরনের বাদাম মিলিয়ে প্রতিদিন অন্তত এক মুঠ বাদাম খাওয়ার চেষ্টা করুন।
বেশ কয়েকটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, বাদাম “খারাপ” কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে, ধমনী কার্যকারিতা ঠিক রেখে হার্টের রোগ ও স্ট্রোক ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
কুমড়ার বীজ:
কুমড়োর বীজ ম্যাগনেসিয়ামে পূর্ণ। এই বীজে আছে প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট।
কুমড়োর বীজে প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা প্রদাহ হ্রাস করতে সহায়তা করে এবং তাই স্ট্রোক, হার্টের রোগ, ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
এতে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে অস্বাস্থ্যকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। স্ট্রোক কমানোর জন্য প্রতিদিন আমাদের ১০-১২ টি কুমড়ার বীজ খাওয়া অতি জরুরী।
আঁশজাতীয় খাবার:
ফাইবার বা আঁশজাতীয় খাবার দেহের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ ও ওজন হ্রাসে যেমন সহায়তা করে, তেমনি স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।
এজন্য লাল চাল, লাল আটা সব ধরনের সবুজ শাকপাতা খাওয়া উচিত। ১০০ গ্রাম পালংশাকে ২.৪ গ্রাম ফাইবার থাকে, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
পেয়ারা:
পেয়ারায় রয়েছে উচ্চমাত্রার ভিটামিন “সি” -সহ অন্যান্য আরো অনেক ভিটামিন ও এন্টিঅক্সিডেন্টস যেগুলি আমাদের হার্টকে রক্ষা করে ফ্রি-রাডিক্যালস-এর ক্ষতির হাত থেকে।
পেয়ারা “খারাপ” LDL কোলেস্টেরল হ্রাস এবং “ভাল” HDL কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। খাবারের আগে পাকা
পেয়ারা খাওয়ার ফলে স্ট্রোক ও রক্তচাপ হ্রাস পেয়েছে, LDL কোলেস্টেরল ৯.৯% হ্রাস পেয়েছে এবং HDL কোলেস্টেরল ৮% বৃদ্ধি পেয়েছে।
মিষ্টি আলু:
মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণ পটাসিয়াম থাকে যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে ভূমিকা রাখে। এটি খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
আর এই কোলেস্টেরল কমলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪০-৫০ ভাগ কমে যায়। তাই স্ট্রোক থেকে দূরে থাকতে নিয়মিত খেতে পারেন মিষ্টি আলু।
রসুন:
রান্না করা রসুনের থেকেও কাঁচা রসুনের উপকারিতা অনেক বেশি। তাই রসুনের সম্পূর্ণ উপকারিতা পেতে হলে কিছু কাঁচা রসুন খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
কাঁচা রসুন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে দারুণ ভাবে সাহায্য করে। এটি খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে আর এই খারাপ কোলেস্টেরল কমলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৬০-৮০ ভাগ কমে যায়।
গ্রিন টি:
গ্রীন টি হল সবথেকে উপকারী পানীয় দ্রব্য। আগে ভারতে এটি ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। শরীরের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ক্যান্সার থেকে শুরু করে ডায়বেটিস।
আবার রক্ত চাপ ঠিক রাখে ও কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এই গ্রিন টি। আর কোলেস্টেরল কমলে তো স্ট্রোকের ঝুঁকি এমনিতেই কমে যায়।
তাই দিনে ২-৩ কাপ গ্রিন টি খেলে বিভিন্ন সমস্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যেকোনো ত্বকের সমস্যা, হার্টের সমস্যা এছাড়াও ত্বক ও চুলকে সুন্দর রাখতে এটি দারুণ কাজ করে।
তরমুজ:
আমরা স্বাস্থ্যকর ডায়েট ও জীবনধারার মাধ্যমে রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারি।
তরমুজের বেশ কয়েকটি পুষ্টিউপাদান রয়েছে যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তার মধ্যে লাইকোপেন অন্যতম।
গবেষণায় দেখা যায় যে, লাইকোপেন কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করতে পারে।