বরই বড়ই গুনের। কেন খাবেন? জেনে নিন।

আপেল, স্ট্রবেরির দরকার নেই, ইচ্ছামতো বরই খান। যেখানে যে পুষ্টিকর খাবার স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়, সেটা যদি আমরা ভারসাম্য রেখে খাই – সঠিক পরিমাণে ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিনস, মিনারেলস শরীরকে দিতে পারি – তাহলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়।

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফলমূল, শাকসব্জি বা ডিম, দুধ ইত্যাদি থেকেই যে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া সম্ভব – আর এর জন্য বাইরে থেকে খাবার আমদানির কোনও প্রয়োজন নেই।

জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফও এই অভিযানে সক্রিয় সমর্থন জানাচ্ছে – যার মূল কথাটা হল স্থানীয় খাবার বা ‘লোকাল ফুড সিস্টেম’-ই আমার আপনার প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ঠ। এই কথাটা ভারতের জন্য যেমন – তেমনি বাংলাদেশের জন্যও সত্যি।

লোকাল ফুড সিস্টেম বলতে আমরা বোঝাচ্ছি আমার বাড়ির আঙিনায় যেটা পাওয়া যাচ্ছে, কিংবা আমার বাড়ির পাশের বাজারে যেগুলো সব সময় পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোকে।

প্রকৃতিতে শীত যখন সেঁজে গুঁজে প্রস্তুত তার মুগ্ধতা ছড়াবে, বরইগাছের তখন উর্বরকাল। অশ্বিন কার্তিক মাস। সবুজ প্রকৃতিতে সাদা ফুলের বাহারে তখন নবযৌবনা jojube বা china date বা বরই গাছ।

ফুল থেকে গুটি হওয়ার পরে বরই খাওয়ার যোগ্য হতে ৩-৪ মাস সময় লাগে। মাঘ মাস থেকে বরই পাকতে শুরু করে। মাঘ-ফাল্গুন বরই খাওয়ার উৎসবের মেলা। Ziziphus mouritiana এর সাইন্টিফিক নাম।

আমাদের কিছু দেশি ফল রয়েছে যাদের সাথে আমাদের নাড়ীর সম্পর্ক। দেখলেই জিভে জল। স্মৃতিকাতর বাঙালির চোখেও জল মানে ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। বরই বা কুল যে নামেই ডাকি না কেন, এই ফলও সে রকমই একটি খাবার।

আমের কথা শুনলে যেমন মনে পড়ে বিকাল বেলা বা সন্ধ্যার পরে কালবৈশাখী ঝড়ের পরে আম খুটতে যাওয়া অথবা গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে আমের আশায় ছুটে বেড়ানো দুরন্ত শৈশব-কৈশোরের কথা। বরই বা কুলের কথা শুনলে স্কুলের টিফিনে বা ছুটির পরে বরই মাখা খাওয়ার একটুকরা কিশোরকাল। সে অনুভূতি কাউকে বুঝিয়ে বলা যাবে না।

বরই মানে কাঁটার আঘাত সহ্য করা। বরই মানে পকেটে লুকানো, কাগজে মোড়ানো লবণ। বরই মানে বন্ধুবান্ধব বা খেলার সাথীরা মিলে বরই মেখে কলাপাতায় ভাগ করে খাওয়ার অপার আনন্দ। বরই মানে এক অন্যরকম মায়াময় কোমল শৈশব।

বাঙ্গালী মেয়েরা দেশি টক মিষ্টি বরই খেতে বেশি পছন্দ করেন। শ্রেষ্ট বরই কোনটি? কুল বরই। বরইশ্রেষ্ঠ কুল স্বাদ, গন্ধ, মিষ্টত্ব সব দিক থেকে আলাদা।  সব জাতের বরই বরই হলেও সব বরই কুল নয়।

নারকেলি বরই বলে যেটিকে আমরা চিনি, দেশি বরই থেকে আকারে কিছুটা বড় আর নারকেলের মতো দেখতে, সেটিই আদতে কুল বরই।

বরই রোদে শুকিয়ে সারা বছর খাওয়ার জন্য রেখে দেয়া হয়। শুকনো বরই দিয়ে রান্না করা চাটনি বা টক খেতে খুব মজা। বরই আঁচার বা বরই চাটনী ছোট্ট শিশু থেকে বুড়া সবাই খেতে খুব ভালোবাসে।

শুকানো আস্ত বরই বা বরই গুঁড়ো করে খেজুরের গুড়ের সাথে মিশিয়ে বিভিন্ন মশলা সহযোগে আঁচার বানানো হয়। এটি পোলাউ, বিরিয়ানি ও দুধ ভাতের সাথে খেতে খুব ভালো লাগে।

বরই এর স্বাস্থ্য উপকারিতা নিচে দেওয়া হলো –

কেন খাবেন বরই? এর স্বাস্থ্যগুণের কথা আমরা আস্তে আস্তে জানবো। এমনি এমনি বরই খান। শীতে যেমন বাড়ির বাইরে পা রাখলেই কমলার দেখা পাওয়া যায়, বসন্তে তেমন রাস্তাঘাটে থরে থরে সাজানো বরই পাওয়া যাচ্ছে।

রাস্তার মোড়ে, হাটে-বাজারে, শহরের অলি গলি ফুটপাথে, শহরে বা পাড়া মহল্লায় ভ্যানে করে, বাড়ির পাশের অস্থায়ী বাজারে,— সবখানে এখন হরেক রকমের বরই রাজত্ব করছে।

কোষ্টকাঠিন্য থেকে মুক্তি :

কোষ্টকাঠিন্য হলে মানুষ খোলাখুলি ভাবে অন্যকে বলতে চাই না। সে এটি প্রকাশ করতে বিব্রত বোধ করে। বর্তমান বাংলাদেশে ক্রনিক কোষ্টকাঠিন্য রোগীর সংখ্যা যেভাবে বেড়েছে তাতে করে বরই তাদের জন্য হতে পারে একটি উত্তম পথ্য। বরইতে থাকা উচ্চ পরিমানে ফাইবার যা কোষ্টকাঠিন্য স্বাভাবিক করে।

শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট:

বরই ফলের মধ্যে ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে সমৃদ্ধ থাকে এবং এতে বেটুলিনিক অ্যাসিড নামে একটি রাসায়নিক উপাদান থাকে যা গ্লুটাথিয়োন স্তর বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে যেটি জারণ চাপের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।

হজম স্বাস্থ্যের উন্নতি করে:

বরই ফলের মধ্যে প্রচুর আঁশযুক্ত উপাদান রয়েছে যা দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে সহায়তা করে। ডায়েট্রি ফাইবার একটি ভাল রেচক হিসাবে কাজ করে যা অন্ত্রের চলাচলকে আরও সহজ করে তোলে। এটিতে পেকটিন রয়েছে যা ডায়রিয়া বিরোধী বৈশিষ্ট্য দেখায়।

ওজন কমাতে সাহায্য করে:

বরইতে ক্যালোরি খুব কম। প্রোটিন এবং ফাইবার সামগ্রীর সমৃদ্ধ উৎস। এটি খাওয়ার পরে এটি পুষ্টির চাহিদা মেটাতে কাজ করে এবং পূর্ণবোধ হয়ে যাওয়ার অনুভূতি দেয়। এটি অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি, বিশেষত পেটের চর্বি প্রতিরোধকারী হিসাবে কাজ করে।

মানসিক স্বাস্থ্য এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে:

জুজুবি ফলটি নিউরো-প্রতিরক্ষামূলক হিসাবে কাজ করে।এটি মেমরি ধরে রাখে এবং লেখাপড়ার উন্নতি ঘটায়। এটি উদ্বেগ এবং অনিদ্রা থেকে মুক্তি দেয় যার।এটি বিভিন্ন স্নায়বিক ডিজেনারেটিভ রোগের চিকিত্সা করে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।

অধ্যয়নগুলি আরও দেখায় যে, এটিতে ডিপ্রেশন বিরোধী অ্যাকশন রয়েছে এবং এটি নিউরোট্রান্সমিটার এবং স্ট্রেস হরমোনগুলিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

রক্তচাপ কমায়:

স্বাভাবিক রক্তচাপ বজায় রাখার জন্য বরই ফল একটি দুর্দান্ত থেরাপি। এটি নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি করে এবং উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহে সহায়তা করে। এছাড়াও, জুজুবি ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম এবং কম পরিমাণে সোডিয়াম থাকে। এটি রক্তচাপ বজায় রাখতে সহায়তা করে।

অ্যান্টিইনফ্লামেটরী বৈশিষ্ট্য:

জুজুবি ফলের মধ্যে রয়েছে বেটুলিনিক অ্যাসিড যা অ্যান্টিইনফ্লেমেটরি ক্রিয়াকলাপ এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যযুক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস এবং এসেরিচিয়া কোলি উভয়ের বিকাশকে বাধা দেয় যা বহু ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণের জন্য দায়ী।

কফ থেকে মুক্তি দেয়:

জুজুবি ফলের মধ্যে ব্রোমেলাইন নামক একটি বিশেষ এনজাইম রয়েছে যা কফ এবং শ্লেষ্মা গঠন কমাতে দেখা যায়। সুতরাং, এটি শ্বাস প্রশ্বাসের পথ এবং সাইনাস গহ্বর সাফ করতে সহায়তা করে।

রক্ত পরিষ্কার করে:

বরই ফলের মধ্যে স্যাপোনিনস এবং আলকালোয়াডস রয়েছে যা সরাসরি রক্তের ডিটক্সিফিকেশনের সাথে যুক্ত। এটি রক্ত থেকে ক্ষতিকারক টক্সিনগুলি নির্মূল করে এবং শরীরকে রক্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচায়।

বয়স ধরে রাখে:

বরই ফল একটি দুর্দান্ত অ্যান্টি-এজিং এজেন্ট। যেহেতু এই ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে, এটি wrinkles, মেলানিন জমা এবং পিগমেন্টেশন প্রতিরোধে সহায়তা করে।

ত্বক ভালো রাখে :

এর ভেতরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের ফ্রি র‍্যাডিকেলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এছাড়াও এর মধ্যে ভিটামিন সি, এ, বি২, ফাইটোকেমিক্যাল ইত্যাদি পাওয়া যায় যা ত্বক উজ্জ্বল করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

শীত থেকে গরমের শুরু অবধি সময়টা দেশি ফলের অভাব মেটায় প্রধানত দেশি টক বরই ও মিষ্টি কুল। বর্তমানে বাজারে আপেল কুল ও বাউকুল নামে দুটো নতুন জাতের কুল পাওয়া যায়। লাল টুকটুকে আপেল কুল খুব মিষ্টি হয়ে থাকে এবং বাউকুল সাইজে অন্য কুলের থেকে বড় হয়ে থাকে।

সতর্কতাঃ

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করেন বা চিকিৎসকের দেওয়া কোনো ওষুধ খাচ্ছেন তাহলে খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ

medindia.net, healthline, প্রথম আলো।