আলু হজমে সহায়তা করে, পেট ভরিয়ে রাখে ও ত্বকের জন্য ভালো।

সকালের নাস্তায় গরম গরম আলু ভাজি বা গরম ভাতে আলু ভাজি আর ঘি। এছাড়া গরম ভাতের সঙ্গে পেঁয়াজ ভাজি, শুকনা মরিচ পোড়া, সরিষার তেল আর লবণ দিয়ে মজাদার আলুর ভর্তা না হলে কি চলে। যেকোন তরকারিতে আলু তো থাকবেই।

এটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে আলু আমাদের খাদ্য তালিকায় কতটা মিশে আছে। অনেকের ধারণা আলু স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ। আলু খাওয়া যাবে না।

বিশ্বের অনেক দেশেই রুটি বা ভাতের বদলে আলু খাওয়ার প্রচলন আছে। যখন রুটি বা ভাতের বদলে আলু খাওয়া হয় তখন আলু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এতটা ক্ষতিকর নয়।

আলুর বৈজ্ঞানিক নাম: Solanum tuberosum, ইংরেজীতে potato বলে। আলুর খোসায় আছে ভিটামিন “এ”, পটাশিয়াম, আয়রন, ভিটামিন “সি” ও খাদ্য আঁশ বা ফাইবার। আলু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কারণ আলুতে ভিটামিন “সি” রয়েছে।

এছাড়া আলুতে ভিটামিন “বি”, আমাইনো অ্যাসিড ও ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি ত্বকের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

ডায়াবেটিস হলে আপনি কি আলু খেতে পারবেন?

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কী খাওয়া উচিত এবং কী খাওয়া উচিত নয় সে সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে।

অনেক লোক মনে করে যে আলুতে কার্বস বেশি তাই ডায়াবেটিস রোগীদের না খাওয়া ভালো। সত্যটি হল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা আলু খেতে পারেন তবে সেটা অবশ্যই পরিমাণ মতো।

তবে আপনি সিদ্ধ আলু খাচ্ছেন না ভাজা আলু খাচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে।

তেলে ভাজা আলু রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। এক্ষেত্রে, আলু সেদ্ধ করে সারারাত ফ্রিজে রেখে দিন এবং এটি ঠান্ডা অবস্থায় খেতে পারেন।

আলু যেহেতু বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়, কিভাবে এটা খাওয়া হয় তার উপরে ভিত্তি করে আলুর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) একেক রকম হয়।

উদাহরণস্বরূপ যে আলুটা আমরা সবসময় খাই (Nicola potato) খোসাসহ সিদ্ধ করলে এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স: ৫৮, লাল আলু (Pontiac potato) খোসা ছাড়া ভেজে নিলে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স: ৯৩।

যে খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যত কম হবে সেটি রক্তে শর্করার পরিমাণ তত কম বৃদ্ধি করবে। ডায়াবেটিস থাকলে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ভালো।

তাই তেলে ভেজে না খেয়ে সেদ্ধ করে সারারাত ফ্রিজে রেখে দিয়ে ঠান্ডা করে পরিমাণ মত (২০-৫০ গ্রাম) খেতে পারি।

আলু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে কেন?

আলুতে কোনো চর্বি নাই, তবে এতে অল্প প্রোটিনযুক্ত স্টার্চি কার্বোহাইড্রেট রয়েছে।

হার্ভার্ডের মতে, আলুতে থাকা কার্বোহাইড্রেট শরীর দ্রুত হজম করে এবং উচ্চ গ্লাইসেমিক লোড থাকে যা রক্তে দ্রুত শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং ইনসুলিন হরমোনের ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়।

ইনসুলিন হরমোনের অতিরিক্ত ব্যবহার ডায়াবেটিস ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

আলুর পুষ্টি উপাদান

আলু অনেকগুলো ভিটামিন এবং খনিজের উৎস। নিচে আলুর পুষ্টি উপাদান দেওয়া হলো –

  • ক্যালোরি: ১৬১
  • পানি: ৭৭%
  • প্রোটিন: ৪.৩ গ্রাম
  • কার্বহাইড্রেট: ৩৬.৬ গ্রাম
  • ফাইবার: ৩.৮ গ্রাম
  • ভিটামিন “সি”: ২৮%
  • ভিটামিন বি 6: ২৭%
  • পটাশিয়াম: ২৬%
  • ম্যাগনেসিয়াম: ১২%
  • ফোলেট: ১২%

আলুর স্বাস্থ্য উপকারিতা

এতে নিয়াসিন, ফসফরাস রয়েছে। কীভাবে আলু খাওয়া হয় তার উপর নির্ভর করে আলুর পুষ্টি উপাদান। উদাহরণস্বরূপ, সেদ্ধ আলুর থেকে ভাজা আলুতে ক্যালোরি এবং ফ্যাট বেশি থাকে।

আলুর খোসাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে। তাই আলু খোসা ফেলে দিলে পুষ্টির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। নিচে আলুর স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –

হজম স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারে:

আলুতে থাকা প্রতিরোধী স্টার্চ হজম স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে সাহায্য করে। যখন প্রতিরোধী স্টার্চ বৃহত অন্ত্রে পৌঁছায়, তখন এটি অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটিরিয়ার খাদ্য হয়ে ওঠে শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিডে পরিণত করে।

আলুর প্রতিরোধী স্টার্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড বুইট্রেটে (butyrate) রূপান্তরিত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, বুইট্রেটে কোলনের প্রদাহ হ্রাস করতে পারে এবং কোলোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

পেট ভরিয়ে রাখতে সহায়তা করে:

একটি সমীক্ষায় ১১ জনকে ৩৮টি খাবার খাওয়ানো হয়েছিল। এর মধ্যে আলু ছিল।

৩৮টি খাবার খেয়ে কে কতটুকু পরিপূর্নতা অনুভব করে ছিল তার উপর ভিত্তি করে খাবারগুলোর রেট করা হয়েছিল। আলু সেগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ পূর্ণতা রেটিং পেয়েছিল।

অনেক্ষণ ধরে পেট ভরিয়ে রেখে খাওয়ার প্রবণতা কমাতে পারে আলু। খাওয়ার প্রবণতা কমার ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

হার্টের জন্য ভালো:

অস্বাভাবিক উচ্চ রক্তচাপ হার্টের রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। আলুতে ২৬% পটাশিয়াম রয়েছে যা রক্তচাপকে হ্রাস করতে পারে।

বেশ কয়েকটি স্টাডিজে দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে উচ্চ পটাসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার।

এছাড়া আলুতে থাকা ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড (chlorogenic acid) এবং কুকোয়ামিনস (kukoamines) রক্তচাপ কমায়, যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

রক্তে সুগার নিয়ন্ত্রণের উন্নতি করতে পারে:

আলুতে একটি বিশেষ ধরণের স্টার্চ থাকে যা প্রতিরোধী স্টার্চ নামে পরিচিত।

টাইপ-2 ডায়াবেটিসযুক্ত ব্যক্তিদের একটি গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে যে, প্রতিরোধী স্টার্চযুক্ত খাবার গ্রহণ করার পরে অতিরিক্ত রক্তে শর্করা অপসারণ করতে সহায়তা করে।

অন্য একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, চার সপ্তাহের সময়কালে ১০ জনকে প্রতি ৩০ গ্রাম প্রতিরোধী স্টার্চ খাওয়ানো হয়েছিল। এতে দেখা গেছে যে প্রতিরোধী স্টার্চ ইনসুলিনের প্রতিরোধ ক্ষমতা ৩৩% কমিয়েছে।

মজার বিষয় হল, আমরা নিজেরাই আলুর প্রতিরোধী স্টার্চ বাড়িয়ে তুলতে পারি। এক্ষেত্রে, আলু সেদ্ধ করে সারারাত ফ্রিজে রেখে দিন এবং এটি ঠান্ডা অবস্থায় খান।

ত্বকের জন্য ভালো:

আলু, বেটে কিংবা আলুর রস ত্বকে লাগালে বিভিন্ন দাগ, র‍্যাশ ও অন্যান্য ত্বকের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

আলুতে ভিটামিন “সি”, ভিটামিন “বি”, পটাশিয়াম ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, ফসফরাস ইত্যাদি রয়েছে যা ত্বকের জন্য উপকারী।

এছাড়া রোদে পোড়া ভাবও দূর করতে সহায়তা করে আলুর রস।

মানসিক চাপ কমায়:

আলুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-৬ রয়েছে, যা মন ভালো রাখার জন্য কার্যকরী দুটি উপাদান সেরেটোনিন ও ডোপামিন নামক নিওট্রান্সমিটার গঠনে সহায়তা করে।

নিওট্রান্সমিটার মস্তিষ্কে অনুভূতি আদান প্রদান করে থাকে এবং মানসিক চাপ কমিয়ে মন ভালো করতে সহায়তা করে।

ক্যান্সার প্রতিরোধী:

আলুতে ফোলেট থাকে। ফোলেট ডিএনএ সংশ্লেষণ এবং মেরামতের ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করে এবং তাই এটি ডিএনএতে পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার কোষ গঠনে বাধা দেয়।

আলু জাতীয় ফল এবং শাকসবজি থেকে ফাইবার গ্রহণ ক্যালোরেক্টাল ক্যান্সারের ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত।

ভিটামিন সি এবং কোরেসেটিন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট হিসাবেও কাজ করে, ফ্রি র‌্যাডিক্যালগুলি থেকে ক্ষতির হাত থেকে কোষকে রক্ষা করে।

সতর্কতা:

আলু শুধু স্বাস্থ্যকরই নয়, সেগুলি সুস্বাদু ও বহুমুখীও। আলু ভাজি, আলুর চিপস এবং ফ্রান্স ফ্রাই সহ বিভিন্ন ভাবে খেয়ে থাকি।

এতে প্রচুর পরিমাণে তেল ব্যবহার করা হয় যার ফলে ক্যালোরির পরিমাণ বাড়তে পারে। আলুতে কার্বোহাইড্রেট উচ্চ মাত্রায় থাকে।

তাই ডায়াবেটিস বা স্থূলত্বের লোকদের জন্য উপকারী না।

আলুর চিপস এবং আলু দিয়ে তৈরী ফ্রেঞ্চ ফ্রাই জাতীয় অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া টাইপ-2 ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ এবং স্থূলত্ব ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

সূত্র: হেলথ লাইন, মেডিকেলনিউজটুডে