যষ্টিমধু ত্বকের জন্য ভালো, বদহজম হ্রাস করতে পারে ও পেপটিক আলসার কমাতে পারে।

যষ্টিমধু হচ্ছে গ্লাইসাইররিজা গ্লাবরা গাছের শিকড়। বাংলায় গাছটিকে যষ্টিমধু গাছ বলা হয়ে থাকে। যষ্টিমধুর শিকড় থেকে মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। এটি মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়।

মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের অনেক দেশে চকোলেট এবং মিষ্টিজাতীয় খাবার প্রস্তুতিতে যষ্টিমধু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে যষ্টিমধু ঔষধি উদ্ভিদ নামে পরিচিত।

যষ্টিমধুর মূলে ৩% অ্যানথোল থাকে। যষ্টিমধুর বেশিরভাগ মিষ্টতা গ্লাইসারাইজিন থেকে আসে। যার মিষ্টি স্বাদ চিনির ৩০-৫০ গুণ বেশি। তবে এর মিষ্টি স্বাদ চিনি থেকে আলাদা।

যষ্টিমধু ইংরেজিতে: licorice এবং বৈজ্ঞানিক নাম: Glycyrrhiza glabra. যষ্টিমধু শব্দটিতে মধু থাকলেও এটা কিন্তু মধু নয়! তবে এর গুণাগুণ মধুর থেকে কোনও অংশে কম নয়।

যষ্টিমধু মূলে থাকা আইসোফ্লাভিন গ্লাব্রেন এবং আইসোফ্রাভিন গ্লাব্রিডিন হচ্ছে ফাইটোএস্ট্রোজেন। এটি আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

তবে অধিক পরিমাণে যষ্টিমধু একদিনে খেলে গ্লাইসাররিজিনিক এসিড রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং মাংসপেশী দুর্বল করে দেয় ও হাইপোক্যালেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

অনেকে হার্টের রোগ, অ্যাসিড রিফ্লাক্স, কাশি, ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রমণের মতো রোগের চিকিৎসার জন্য যষ্টিমধু ব্যবহার করে।

এটি নিয়মিত ক্যাপসুল আকারে বা পানির সাথে খাওয়া যায়। এছাড়া যষ্টিমধু দিয়ে চাও বানিয়ে খেতে পারেন। এই চা গলায় ব্যথা কমাতে পারে।

যষ্টিমধুর উপকারিতা

যষ্টিমধু আয়ুর্বেদীয় ওষুধ তৈরির অন্যতম উপাদান হিসেবে বহু বছর ধরে ব্যবহার হচ্ছে। নিচে যষ্টিমধু এর উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হলো –

বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ যৌগ রয়েছে:

এতে শত শত উদ্ভিদ যৌগ রয়েছে, যষ্টিমধুর মুলের প্রাথমিক সক্রিয় যৌগটি হল গ্লাইসরিহিজিন (Glycyrrhizin)।

গ্লাইসারাইজিন মিষ্টি স্বাদের পাশাপাশি এর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

ত্বকের জন্য ভালো:

যষ্টিমধুতে ৩০০ টিরও বেশি যৌগ রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি শক্তিশালী যৌগ হল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল প্রভাব।

এতে থাকা গ্লাইসারাইজিনকে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সুবিধার সাথে সংযুক্ত করে।

আপনি যষ্টিমধুকে অভ্যন্তরীণ অথবা বাহ্যিক যেভাবেই ব্যবহার করেন না কেন, এতে ত্বকের উপকার হয়।

ষষ্ঠিমধু ত্বকের ব্রণ, সোরিয়াসিস, প্রদাহ, সানবার্ন ও পায়ের ছত্রাক জনিত অ্যাথলেট’স ফুট নিরাময়ে অবদান রাখে।

ত্বকের ফোলা ও চুলকানি থেকে মুক্তি পেতে যষ্টিমধুর নির্যাস থেকে প্রস্তুতকৃত টপিক্যাল সল্যুশন ব্যবহার করতে পারেন।

বদহজম হ্রাস করতে পারে:

যষ্টিমধু আবার বদহজম বা অ্যাসিডিটির খুব ভাল ওষুধ। অ্যাসিড রিফ্লাক্স, অস্থির পেট এবং অম্বলের মতো বদহজমের লক্ষণগুলি দূর করতে প্রায়শই যষ্টিমধু ব্যবহার করা হয়।

বদহজম দ্বারা আক্রান্ত ৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের নিয়ে ৩০ দিনের একটি গবেষণায়, প্রতিদিন ৭৫ বার-মিলিগ্রাম যষ্টিমধু ক্যাপসুল গ্রহণের ফলে বদহজমের লক্ষণগুলি উন্নতি ঘটে।

এছাড়া ফুটানো পানিতে যষ্টিমধু ভিজিয়ে রেখে অল্প করে মধু মিশিয়ে পান করতে পারেন। খুব সহজেই অ্যাসিডিটি দূর হবে।

পেপটিক আলসার কমাতে পারে:

যষ্টিমধু গ্লাইসিরিঝিজা গ্ল্যাব্রা প্ল্যান্টের (Glycyrrhiza glabra plant) শুকনো মূল থেকে আসে এবং এটি একটি প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী ভেষজ ঔষধ যা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।

কিছু সমীক্ষা রিপোর্ট করেছে যে যষ্টিমধু আলসার-প্রতিরোধক এবং আলসারের সাথে লড়াই করার বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। যষ্টিমধু আলসার সম্পর্কিত ব্যথা কমাতে সহায়তা করতে পারে।

গবেষকরা আরও জানিয়েছেন যে যষ্টিমধু পাওয়া যৌগ এইচ পাইলোরি (H. pylori infections) বৃদ্ধি রোধ করতে পারে।

অ্যান্টিক্যান্সার বৈশিষ্ট্য রয়েছে:

অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি প্রভাবগুলির পাশাপাশি অসংখ্য উদ্ভিদ যৌগগুলির কারণে, যষ্টিমধু নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।

বিশেষত যষ্টিমধু ত্বক, স্তন, কোলোরেক্টাল এবং প্রস্টেট ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি ধীর করে দেয়।

মাথা এবং ঘাড়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত ৬০ জন প্রাপ্তবয়স্কদের ২ সপ্তাহের সমীক্ষায় জানা গেছে যে যষ্টিমধু ওরাল মিউকোসাইটিসের (oral mucositis) চিকিৎসার মতোই কার্যকর ছিল।

শ্বাসতন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে:

প্রদাহ-প্রতিরোধী এবং অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল প্রভাবগুলির কারণে, যষ্টিমধু এবং যষ্টিমধু চা শ্বাসকষ্টের পরিস্থিতিতে সহায়তা করতে পারে।

তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার (যেমন- কাশি বা কফ, গলা ব্যথা, হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিস) চিকিৎসা হিসেবে যষ্টিমধু ব্যবহার করা যেতে পারে।

যষ্টিমধুর মূলে থাকা গ্লাইসারাইজিন হাঁপানি উপশম করতে সহায়তা করে।

গহ্বর থেকে রক্ষা করতে পারে:

যষ্টিমধু গহ্বরে হতে পারে এমন ব্যাকটিরিয়া থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

একটি ৩ সপ্তাহের সমীক্ষায় ৬৬ টি স্কুল-বয়স্ক বাচ্চাদের প্রতিদিন ২ বার ১৫ মিলিগ্রাম যষ্টিমধুযুক্ত ললিপপস দেওয়া হয়েছিল।

ললিপপস গ্রহণের ফলে স্ট্রেপ্টোকোকাস মিউট্যান্স ব্যাকটিরিয়াগুলির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা গহ্বরের প্রধান কারণ।

টেস্ট-টিউব স্টাডিজও সাধারণত গহ্বর এবং দাঁত ক্ষয়ের সাথে সংযুক্ত ব্যাকটিরিয়া থেকে রক্ষা করার জন্য যষ্টিমধু এক্সট্র্যাক্ট কার্যকর দেখায়।

কফ নিঃসারক ও কাশি কমায়:

যষ্টিমধু তরল আকারে কফ বের করে দেয় এবং কাশি ভালো করতে পারে। এছাড়া ব্রঙ্কাইটিস, টনসিলাইটিস ও কণ্ঠনালীর প্রদাহ দূর করতেও সাহায্য করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:

যষ্টিমধুতে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট রয়েছে এবং এটি ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ তন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলে।

ফুড কেমিস্ট্রি নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যষ্টিমধু শরীর থেকে ক্ষতিকর ফ্রি র‌্যাডিকেল দূর করে ও শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করে।

দাঁতের স্বাস্থ্য উন্নত করে:

যষ্টিমধু হচ্ছে একটি মাল্টিপারপোজ হার্ব, যা আপনার দাঁত ও মাড়িকেও সুস্থ রাখতে পারে।

জার্নাল অব ন্যাচারাল প্রোডাক্টসে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, যষ্টিমধুতে দুটি কার্যকরী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে, যা দাঁতের ক্ষয় ও মাড়ির রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যাকটেরিয়ার গ্রোথ ঠেকাতে পারে।

চোখের জন্য:

চোখে অনেক সময় হয়তো ঝাপসা দেখছেন। তা হলে এক কাজ করুন, শুকনো ২-৩টে আমলকির সঙ্গে যষ্টিমধু নিয়ে একটু থেঁতো করে আধ কাপ গরম জলে ৫-৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন।

এ বার ওই জল কয়েক বার ছেঁকে নিন। এ বার চোখে ওই ছেঁকে নেওয়া জলের ঝাপটা দিলে কয়েক দিনের মধ্যেই আপনার চোখের ঝাপসা ভাব দূর হবে।

যষ্টিমধুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

  • যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাঁদের জন্য যষ্টিমধু ভাল নয়।
  • কিডনির সমস্যা থাকলেও যষ্টিমধু ব্যবহার করা উচিত নয়।
  • যষ্টিমধুর পরিমাণ বেশি হয়ে গেলেই উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদযন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
  • আবার বেশি পরিমাণে যষ্টিমধু খেলে মাথা ধরা, আলস্য এবং পটাশিয়ামের অভাব দেখা দিতে পারে।
  • যষ্টিমধুর তৈরি কোনও ওষুধ ব্যবহারের আগে সব সময়ই ডাক্তার অথবা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
  • শিশু এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মহিলাদেরও যষ্টিমধু পণ্যগুলি এড়ানো উচিত।
  • গর্ভাবস্থায় প্রচুর পরিমাণে যষ্টিমধু – এবং বিশেষত গ্লাইসারাইজিন গ্রহণ আপনার শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

    তাই গভর্বতী থাকাকালীন বা লিভার সিরোসিস থাকলে যষ্টিমধু ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

সতর্কতা:

যা কিছু খাবেন পরিমিত পরিমাণে খাবেন। অতিরিক্তি কোন কিছুই ভালো নয়।

এছাড়া আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই খাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

রেফারেন্স: