হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগ কি? হাঁপানি দূর করার কিছু ঘরোয়া প্রতিকার।

শিল্প উন্নয়নের ফলে শহর অঞ্চলে বায়ুদূষণ এতো আকারে বেড়েছে যে, আমরা বায়ুদূষণে এখন চ্যাম্পিয়নের মেডেল পেয়ে গেছি।

কি শীত বা কি গরম সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, মানুষের ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দূষণ যদি এভাবে চলতে থাকে আর আমরা যদি এই দূষণের লাগাম টেনে না ধরতে পারি তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাবে। ঘরে ঘরে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগী দেখা যাবে।

এছাড়া অধিক হরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গাছপালা ধংস ও শিল্প-কলকারখানা তথা নগর-সভ্যতার ফলে বিশ্ব জলবায়ু ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।

বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে চলার ফলে গত কয়েক দশকে বাচ্চা থেকে বয়স্ক, সব বয়সিদের মধ্যেই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বেড়েই চলেছে।

দিন রাত শ্বাস নিচ্ছি। শ্বাস প্রক্রিয়া কখনো থেমে নেই। অথচ এই বিষয়ে আমরা মোটেও ভাবি না বা সচেতন হই না। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তখন আমরা শ্বাসনালী, ফুসফুস ইত্যাদির গুরুত্ব বুঝতে পারি।

বায়ু দূষণ ছাড়াও আরও নানা কারণে হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগ হতে পারে যেমন: বংশগত, ফুসফুসে সংক্রমণ, ওয়েদার কন্ডিশন, খাবার এবং অ্যালার্জি প্রভৃতি।
শ্বাসকষ্ট মানে হাঁপানী নয়। শ্বাসকষ্টের বিভিন্ন কারণ হতে পারে। তবে সারা বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি লোক শ্বাসনালীর সচরাচর সমস্যা-হাঁপানি বা এ্যাজমায় আক্রান্ত।

সর্দিকাশি, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিসে যেমন শ্বাসকষ্ট হয় তেমনই হৃদরোগের কারণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

পেটের সমস্যা, গ্যাস, হজমের সমস্যা, অ্যালার্জি, হাঁপানি, রক্তাল্পতা, কিডনির সমস্যা এমনকি অতিরিক্ত মানচাপ চাপ, টেনশনেও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।

তবে বেশিরভাগ শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী ফুসফুসের সমস্যা। মূলত অবস্ট্রাকটিভ লাং ডিজিজের কারণেই শ্বাসকষ্ট হয়। এই ধরনের দু’টি বড় রোগ রয়েছে।

একটা হল হাঁপানি বা অ্যাজমা আর অন্যটি হল ‘ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ’ (সিওপিডি)।

হাঁপানি বা অ্যাজমা মূলত জেনেটিক এবং পরিবেশগত রোগ। হাঁপানি হলে ফুসফুসে হাওয়া ঢোকা–বেরোনোর পাইপ (ব্রঙ্কিওল) সরু হয়ে যায় বলে শ্বাসকষ্ট হয়।

আর সিওপিডি মূলত মধ্যবয়স্কদের ক্ষেত্রে হয়। ধূমপান হল মূলত এই রোগের কারণ। এ ছাড়াও বায়ু দূষণের সংস্পর্শেও এই রোগ হয়।

শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট হয় এবং বুকে হাপ ধরে। এই অবস্থাকেই হাঁপানি বা শ্বাস রোগ বলে। যখন হাঁপ ওঠে তখন রোগী খুব কষ্ট পায়। বর্তমানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। কষ্ট হতে হতে, ধুঁকতে ধুকতে মরণ।

হাঁপানি বা অ্যাজমা কি?

হাঁপানি বা অ্যাজমা একটি ফুসফুসজনিত রোগ। এর ফলে শ্বাসকষ্ট হয়। আমরা যে অক্সিজেন বা শ্বাস গ্রহণ করি তা শ্বাসনালীর মধ্যে দিয়ে ফুসফুস তথা সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।

ফুসফুসে বায়ু প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হলেই হাঁপানির আক্রমণ ঘটতে পারে।

অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট এমন একটা রোগ যার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। হাঁপানি অনেক সময় তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

সাধারণত এলার্জি, বায়ু দূষণ, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, আবহাওয়া, খাদ্য ও নির্দিষ্ট ওষুধের কারণেও হতে পারে।

এখন প্রকৃতিতে যেহেতু ধুলাবালির পরিমাণ বেশি তাই হাঁপানি রোগীদের একটু সাবধানে থাকতে হবে। কারণ হাঁপানি রোগীদের জন্য ধুলোবালি অত্যন্ত ক্ষতিকর। অ্যাজমা বা হাঁপানির অনেক চিকিৎসা রয়েছে।

তবে এখন আপনি চাইলে খুব সহজে ওষুধ ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে পরিত্রাণ পেতে পারেন হাঁপানির হাত থেকে। তাহলে জেনে নিন হাঁপানি প্রতিরোধের প্রাকৃতিক উপায় সম্পর্কে।

অ্যাজমা বা হাঁপানি দূর করার ঘরোয়া বা প্রাকৃতিক প্রতিকারঃ

কিছু প্রাকৃতিক থেরাপি যেমন: ডিপ breathing বা গভীর শ্বাস বা যোগব্যায়াম, প্রগতিশীল পেশী শিথিলকরণ, এবং বায়োফিডব্যাক হাঁপানি উপশম করতে সহায়তা করে।

আকুপাংচার:

এই ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসায় শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলিতে পাতলা সূঁচ ফুটিয়ে চিকিৎসা করা হয়।

হাঁপানিতে আক্রান্ত কিছু লোকেরা বলেন আকুপাংচারটি তাদের উপসর্গগুলি সহজ করে দেয়, অ্যাজমার চিকিৎসা হিসাবে এটির কার্যকারিতা প্রমাণের খুব একটা প্রমাণ নেই।

বায়োফিডব্যাক থেরাপি :

প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে যে হার্ট রেট ভেরিয়েবিলিটি (এইচআরভি) বাড়াতে বায়োফিডব্যাক থেরাপি হাঁপানি রোগীদের স্পিরোমেট্রি উন্নত করে।

ভেষজ এবং প্রাকৃতিক খাদ্য পরিপূরক:

এই রোগের চিকিৎসার জন্য অনেক লোক ভেষজ, গাছপালা এবং পরিপূরক, বিশেষত চাইনিজ গুল্ম ব্যবহার করে। এটি কতটা ভাল কাজ করে তা পরিষ্কার নয়।

ম্যাগনেসিয়াম এবং ফিশ অয়েল (ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড) এর মতো পরিপূরক সম্পর্কে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

তবে ভিটামিন সি, ডি, ই এবং ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড আপনার লক্ষণগুলির ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করতে পারে।

আপনার যদি নির্দিষ্ট কিছু খাবারে অ্যালার্জি থাকে তবে সেই সকল খাবার এড়ানো হাঁপানির লক্ষণগুলি রোধে সহায়তা করতে পারে।

উদ্ভিদ-ভিত্তিক ডায়েট:

বেশ কয়েকটি গবেষণায় ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য অনুসরণকারী হাঁপানিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য উপকার পাওয়া গেছে।

এতে প্রচুর ফলমূল, শাকসব্জী, আস্ত শস্য, বাদাম, বীজ এবং জলপাইয়ের তেলের মতো স্বাস্থ্যকর চর্বি অন্তর্ভুক্ত।

হাঁপানি রোগী নিরামিষ ভোজী হলে ভালো। তেল, চর্বি, লাল মাংস, মাছ, মশলা ইত্যাদি হাঁপানি রোগে ক্ষতিকর।

অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের রান্না ঘরে থাকা বা আমাদের রান্নাঘরের নিত্যব্যবহার্য সাধারণ কিছু খাবার বা মশলা চটজলদি অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট কমাতে দারুন কাজে আসে।

আদা হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগের জন্য একটি সুপরিচিত প্রাকৃতিক চিকিৎসা। গবেষকদের মতে, আদা শ্বাসনালীর প্রদাহ কমাতে এবং শ্বাসনালী সংকোচন রোধে সাহায্য করে।

কর্পূর এবং সরিষার তেল নিয়ে গরম করুন। এরপর আলতো করে বুকে এবং পিঠে ম্যাসেজ করতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত উপসর্গ প্রশমিত হয় ততোক্ষণ ম্যাসেজ করতে হবে।

এর ফলে শ্বাসনালীর প্যাসেজ পরিষ্কার এবং স্বাভাবিক শ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করবে। ঘরোয়া উপায়ে হাঁপানি প্রতিকারের এটি খুবই কার্যকরি পদ্ধতি।

রসুন হাঁপানি প্রতিরোধে প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে কাজ করে। হাঁপানির একটি বিকল্প চিকিৎসা হিসাবে রসুন ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই অ্যাজমা রোগীদের বেশি করে রসুন খাওয়া উচিত।

ওজন কমানো:

শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে তার চাপ শরীরের মাঝখানে পড়ে এবং ফুসফুসের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ওজন হারানো বা কমানো ফুসফুসের কাজের পরিমাণ আরও উন্নত করতে পারে ফলে হাঁপানি বা অ্যাজমা কমে। যেমন: ওজন কমলে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।

যোগ ব্যায়াম:

শবাসন, ধনুরাসন ও সর্বাঙ্গাসন অভ্যাসে হাঁপানী রোগে অনেক উপকার হয়। যোগব্যায়ামে ব্যবহৃত শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়ামগুলো হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে শ্বাসকষ্ট এবং চাপ কমাতে সাহায্য করে।

কফি বা ক্যাফেইন:

কফি হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত গরম কফি পান করলে শ্বাসনালী পরিষ্কার হবে।

কিন্তু দিনে তিন কাপের বেশি ব্ল্যাক কফি খাওয়া উচিত না। যদিও হাঁপানির নিয়মিত চিকিৎসা হিসেবে কফি ব্যবহার করা উচিত না।

সতর্কতাঃ

এলার্জি, এ্যাজমা/হাপানি এবং শ্বাসকষ্ট এই বিষয়গুলি একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ। দেখা যায় এলার্জির তীব্রতা বাড়লে এ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদের শ্বাসকষ্টও বেড়ে যায়। তাই যারা এ সমস্যায় ভুগছেন তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করাই উচিত।

ঔষুধ ছাড়া শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করলেও এ সমস্যার তীব্রতা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

এই সংক্রান্ত রোগীদের চলাফেরা, ওঠাবসা, খাবার-দাবার এক কোথায় জীবনযাত্রার সকল বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। নিচে তার জন্য কিছু করণীয় এবং বর্জনীয় টিপস উপস্থাপন করা হলো।

করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়সমূহ:

  • ধূলাবালি থেকে বাচতে রাস্তা ঘটে চলাচলের সমসয় মুখে মাস্ক ব্যবহার করুন।
  • বাসা বাড়িতে কার্পেট ব্যবহার না করাই অতি উত্তম।
  • যেকোন প্রকার স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ এড়িয়ে চলুন।
  • বাসায় বিড়াল, কুকুর বা অন্য কোনো প্রাণী পোষা থেকে বিরত থাকুন।
  • ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করুন বা গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন।
  • মশার কয়েলও শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে থাকে এর থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করুন।
  • স্প্রে করার সময় নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করুন কারণ এটাও বেশ ক্ষতিকর।
  • যে কোনো উপায়ে ধূমপান পরিহার করা অপরিহার্য।
  • বাসা বাড়িতে ফ্রীজে রাখা খাবার ভালো করে গরম করে গ্রহন করুন।
  • পুরাতন বই পত্র এবং বিছানা বা কার্পেট ঝেড়ে নেওয়ার সময়ও মাস্ক ব্যবহার করুন বা গামছা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন।
  • শীতকালে লেপ-তোষক ভাল করে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করুন।
  • শীত থেকে বাচতে উলেন কাপড়ের পরিবর্তে সুতি অথবা জিন্সের কাপড় ব্যবহার করুন।
  • রান্না করার সময় মশলার ঝাঁঝাঁলো গন্ধ এড়াতে মাস্ক বা শুকনো কাপড় ব্যবহার করুন।
রেফারেন্স: