পেয়ারা পাতা খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করে, দাঁতে ব্যথা কমায় ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।

পেয়ারা একটি সুপার ফল হিসাবে প্রশংসিত হয়েছে কারণ এটি বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা সরবরাহ করে। তবে পেয়ারার পাতাও কিন্তু পিছিয়ে নেই উপকারিতার দিক থেকে। পেয়ারা পাতা ভিটামিন “সি” এর মতো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফ্ল্যাভোনয়েডগুলির পাওয়ার হাউস”।

ইতিহাসের পাতা উল্টালে জানতে পারা যায় কয়েকশো বছর আগে থেকেই মেক্সিকো এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে কোচি পেয়ারা পাতা দিয়ে বানোন চা পানের রেওয়াজ ছিল। কারণ তাদের ধরণা ছিল এই পানীয়টি পান করলে একাধিক রোগ দূরে থাকতে বাধ্য হবে।

আজও ল্যাটিন আমেরিকার বাসিন্দারা পেয়ারা পাতা দিয়ে বানানো চা পান করে থাকেন। দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে শতাব্দী ধরে প্রচলিত ঔষধের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে পেয়ারা পাতা।

যদি পেয়ারা, টমেটো গরীবের আপেল হয়ে থাকে তাহলে পেয়ারা পাতার চা কে গরীবের গ্রিন টি তো বলাই যাই। আসলে গরীবের না বলে প্রত্যেকটি মানুষের জন্য সহজলভ্য গ্রিন টি।

আগে কার দিনের বয়স্ক লোকেদের মুখে একটি কথা বেশ সোনা যেত “দাঁতে ব্যথা করছে, দাঁতের গোড়া অর্থাৎ মাড়ি ফুলে উঠেছে, রক্ত পড়ছে পেয়ারা গাছের কচি পাতা চাবাও ঠিক হয়ে যাবে”।

প্রত্যেকের বাড়িতে পেয়ারা গাছ থাকে। তাই খুব সহজেই এই পাতা সংগ্রহ করতে পারবেন। পেয়ারা পাতা চুলের ক্ষতি রোধ করে, ডায়াবেটিস কমায়, খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ভাল কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে, ডায়রিয়া কমায়, ব্রণের সংক্ৰমন ও দাঁত ব্যথা কমায়

পেয়ারা পাতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এজেন্ট এবং উপকারী ট্যানিন থাকে। এছাড়া পলিফেনলস, ক্যারোটিনয়েডস, ফ্ল্যাভোনয়েডস, থাকে যা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

এই পাতাতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন “বি” রয়েছে যা চুলের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যকে বাড়িয়ে তোলে। আয়ুর্বেদিক মতে পেয়ারা পাতার চা এর মধ্যে গ্রিন টি এর মতো স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।

পেয়ারা পাতার চা কীভাবে প্রস্তুত করবেন?

২ কাপ ফুটন্ত পানিতে ৫-১০ টি তাজা পেয়ারা পাতা ভালো করে ধুয়ে ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিন। ১০ মিনিট পর্যন্ত ভালো করে জ্বাল দিন। এবার চুলা থেকে নামিয়ে ছেকে পরিবেশন করুন পেয়ারা পাতার চা। পেয়ারা পাতা শুকিয়ে গুড়ি করে সংরক্ষন করতে পারেন। তবে গাছ থেকে তাজা পেয়ারা পাতা নিয়ে চা বানিয়ে খাওয়া ভালো।

পেয়ারা পাতার উপকারিতা

পুষ্টিগুনে ভরপুর এই ফলের পাতাও আমাদের স্বাস্থের জন্য কম উপকারী নয়। আসুন, এই পেয়ারা পাতার উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-

রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়:

বেশ কয়েকটি টেস্ট-টিউব গবেষণায় দেখা গেছে যে খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে পেয়ারা পাতার রস রক্তে শর্করার মাত্রা উন্নত করে, দীর্ঘমেয়াদী রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ এবং ইনসুলিন প্রতিরোধে সহায়তা করে।

১৯ জনের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, পেয়ারা পাতার চা পান করার পরে রক্তে শর্করার পরিমাণ হ্রাস পায়।

টাইপ-2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২০ জনের মধ্যে আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে পেয়ারা পাতার চা পান করার ফলে খাবারের খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা ১০% এরও বেশি হ্রাস পেয়েছে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিয়মিত পেয়ারার চা পান করা ভালো।

“খারাপ” LDL কোলেস্টেরলের হ্রাস করে:

পেয়ারা পাতার চা বানিয়ে নিয়মিত খেলে “খারাপ” LDL কোলেস্টেরলের হ্রাস পাই। অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন যে, পেয়ারা পাতায় উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন হার্টকে ফ্রি র‌্যাডিকালগুলির ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। পেয়ারা পাতার রস নিম্ন রক্তচাপের সাথে, “খারাপ” LDL কোলেস্টেরলের হ্রাস এবং “ভাল” HDL কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে।

মাসিকের ব্যথা কমায়:

মাসিকের সময় পেটে ব্যথা খুবই যন্ত্রনা দায়ক। এই সময়ে পেটে ব্যথা কিছুটা হলেও কমাতে সাহায্য করবে পেয়ারা পাতা। এমন কিছু প্রমাণ রয়েছে যে, পেয়ারা পাতার রস তুস্রাবের ব্যথার তীব্রতা হ্রাস করতে পারে।

১৯৭ জন মহিলা যাদের মাসিকের সময় পেটে ব্যথা হয় তাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ৬ মিলিগ্রাম পেয়ারা পাতার নির্যাস গ্রহণের ফলে ব্যথার তীব্রতা হ্রাস পায়। এটি কিছু ব্যথানাশক এর চেয়ে আরও শক্তিশালী বলে মনে হয়েছিল।

ডায়রিয়ার কমায়:

পেয়ারা পাতার রস হজম স্বাস্থ্যের জন্য উপকৃত হতে পারে। অধ্যয়নগুলি সুপারিশ করে যে, এটি ডায়রিয়ার তীব্রতা এবং সময়কাল হ্রাস করতে পারে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পেয়ারা পাতার রসে অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল বৈশিষ্ট রয়েছে। এর অর্থ এটি পেটের ক্ষতিকারক জীবাণুগুলি মারতে পারে যা ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে।

রেভিস্টায় দ্য ইনস্টিটিউটো ডি মেডিসিনা ট্রপিকাল ডি সাও পাওলো-তে প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুসারে পেয়ারা-পাতার নির্যাস স্টায়ফিলোকক্কাস অ্যারিয়াস ব্যাকটিরিয়ার বিকাশকে বাধা দেয় যা ডায়রিয়ার সাধারণ কারণ। এক্ষেত্রে এক কাপ ফুটন্ত পানিতে পেয়ারা পাতা ছেড়ে দিন। ২-৩ মিনিট ভালো করে জ্বাল করে তারপর ছেকে খেয়ে নিন পেয়ারা পাতার চা।

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকরী:

লাইকোপিন নামক অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট পেয়ারা পাতায় প্রচুর পরিমানে রয়েছে। এজন্য এটি স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং ওরাল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কার্যকরী। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে লাইকোপেন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সর্দি এবং কাশি নিরাময় করে:

পেয়ারা পাতায় উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন “সি” এবং আয়রন থাকে এবং পেয়ারার পাতা কাশি এবং সর্দি থেকে মুক্তি পেতে খুব উপকারী। কারণ এটি শ্লেষ্মা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। এটি শ্বাস নালীর, গলা এবং ফুসফুসকেও জীবাণুমুক্ত করে।

ব্রন কমাতে সাহায্য করে:

পেয়ারা পাতা পিষে ব্রনের ওপর লাগালে ব্রন কমে যায়। পেয়ারা পাতার মধ্যে থাকা ভিটামিন “সি” ব্রন কমাতে সাহায্য করবে। মুথের কালোদাগও দুর করা যায়।

দাঁতে ব্যথা কমায়:

দাঁতে ব্যথা হলে কিছু কঁচি পেয়ারা পাতা ছিড়ে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে চাবাতে থাকুন দেখবেন ব্যথা কমে গেছে। পেয়ারা পাতা প্রদাহ বিরোধী এবং মুখের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। পেয়ারা পাতার চাতে শক্তিশালী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যর কারণে দাঁত ব্যথা, মাড়ি ফোলা এবং ওরাল আলসার এর জন্য দুর্দান্ত ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে কাজ করে। এই সমস্যা নিরাময়ের জন্য পাতা পিষে মাড়ি এবং দাঁতে লাগাতে পারেন।

চুল পড়া বন্ধ করতে সহায়ক:

গরম পানিতে পেয়ারা পাতা সেদ্ধ করে নিয়ে তা চুলে লাগালে চুল পড়া রোধ হয়ে যায়। তবে মাথায় লাগানোর আগে পেয়ারা পাতা সেদ্ধ করা পানি ঠান্ডা করে নিতে ভুলবেন না।

মুখের দুর্গন্ধ দূর করে:

মুখে দুর্গন্ধ খুবই অস্বস্তিকর একটা বিষয়। কারও সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে গেলে বিব্রত লাগে, হাসতে গেলেও প্রাণ খুলে হাসা যায় না। যাদের মুখ থেকে বাজে গন্ধ বেরোয় তাদের ক্ষেত্রে ভীষণ উপকারী পেয়ারা পাতা। পেয়ারা পাতার চা মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এবং ব্যাকটিরিয়াকে মেরে ফেলতে সক্ষম। তাই একে প্রাকৃতিক মাউথ ফ্রেশনার বলা যেতে পারে।

সতর্কতা:

আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই খাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

রেফারেন্স: