“ত্রিফলা” কোষ্টকাঠিন্য দূর করে, ক্যান্সার প্রতিরোধী ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

‘ত্রিফলা’ কথাটির মানে হচ্ছে তিন ফলের সমাহার বা মিশ্রণ। ত্রিফলায় থাকা তিনটি ফল হলো হরিতকি (Haritaki), আমলকি (Amaloki)  এবং বহেড়া (Bibitoki)। দ্রব্যগুণে ফল তিনটির অবস্থান অনেক ঊর্ধ্বে।

শুধু আয়ুর্বেদ শান্ত্রে নয় আধুনিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে, দ্রব্যগুণে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে হরিতকী, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমলকী এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে বহেড়া।

ত্রিফলা(Triphala) আক্ষরিক অর্থে “তিনটি ফল”, ত্রি অর্থ “তিন” এবং ফালা অর্থ “ফল”। ভারতে একটি প্রবাদ আছে যে, কোনও বৈদ্য (আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক) যদি ত্রিফলাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানেন তবে তিনি যেকোনো রোগ নিরাময় করতে পারেন।

শরীরকে রোগ মুক্ত রাখতে ত্রিফলার বাস্তবিকই কোনও বিকল্প নেই।

ত্রিফলা আমাদের শরীর হতে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়, রক্ত পরিষ্কার করে, আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পুনর্যৌবন দান করে এবং আমাদের দেহকে নবীন ও শক্তিশালী করে।

বীজ বাদে তিনটি ফলকে শুকিয়ে নিয়ে তারপর তা গুঁড়ো করে একসঙ্গে সমপরিমাণ মিলিয়ে যে শক্তিশালী মিশ্রনটি তৈরি করা হয়, তাকেই আযুর্বেদ শাস্ত্রে ত্রিফলা নামে ডাকা হয়ে থাকে।

এটি গতানুগতিক আয়ুর্বেদিক ওষুধের মূল ভিত্তি, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি যা ৩০০০ বছর আগে ভারতে উদ্ভূত হয়েছিল। এর বহু কার্যকরী স্বাস্থ্য সুবিধার কারণে ত্রিফালা বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ত্রিফলা খাওয়ার উপযুক্ত সময় কোনটি?

খালি পেটে অর্থাৎ সকালে ও দুপুরে খাওয়ার আগে ত্রিফলা খাওয়া হয়।

আদর্শভাবে, ত্রিফলা গ্রহণের সর্বোত্তম সময়টি হল খুব সকাল বেলা। আপনি যদি শুধু ত্রিফলার স্বাদ পছন্দ না করেন তবে এতে কিছুটা মধু মিশিয়ে নিতে পারেন।

কিডনির জন্য ত্রিফলা ভালো?

তিনটি অত্যাবশ্যক পুনরুজ্জীবিত গুল্মের সংমিশ্রণ, ত্রিফলা কিডনির সমস্ত কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়তা করে। এটি শরীরের মলমূত্র ব্যবস্থার প্রধান দুটি অঙ্গ লিভার এবং কিডনিকে শক্তিশালী করে।

ত্রিফলার স্বাস্থ্য উপকারিতা

নিচে ত্রিফলার বহুমুখী স্বাস্থ্য উপকারীতা আলোচনা করা হলো –

কোষ্ঠকাঠিন্যে কমানোর প্রাকৃতিক ঔষধ:

হতাশা, দুশ্চিন্তা, অনিয়মিত খাওয়া দাওয়া ও অন্যান্য কিছু কারণে কোলনের পেশি সংকোচন ধীর হয়ে কোষ্টকাঠিন্যের সমস্যায় পড়ে গেছেন।

অথবা নিম্ন ফাইবারযুক্ত খাদ্য অর্থাৎ আপনার খাবারে আঁশ কম। বিশেষত মাংস, দুধ বা পনিরের পরিমান খাবারে বেশি। পানি কম খাওয়ার অভ্যাস।

চাপ প্রয়োগ করতে করতে আপনার মলদ্বার ব্যথা হয়ে গেছে। সকালটা আপনার জন্য অনেক বেদনার, তাহলে আজ থেকেই ত্রিফলা চুর্ন খাওয়া শুরু করুন।

কোলোনকে পরিশুদ্ধ করার মধ্যে দিয়ে আরও নানা ধরনের রোগের আশঙ্কা কমাতেও ত্রিফলার কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে।

ক্ষত সেরে যায় চোখের নিমেষে:

অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটারি এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদানে ঠাসা হওয়ার কারণে এই মিশ্রনটি খাওয়া শুরু করলে শরীরের এমন কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে যে ক্ষত সারতে সময় লাগে না।

এই কারণেই তো ছোট বাচ্চাদের নিয়মিত এই আয়ুর্বেদিক মিশ্রনটি খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।

ব্যথা দূর করে:

ত্রিফলায় ভিটামিন সি, ফ্ল্যাভোনয়েডস, পলিফেনলস, ট্যানিনস এবং স্যাপোনিন সহ অন্যান্য শক্তিশালী উদ্ভিদ যৌগ রয়েছে।

এই যৌগগুলি ফ্রি র‌্যাডিকালগুলির দ্বারা সৃষ্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।

এছাড়া ত্রিফলা বাতজনিত কারণে প্রদাহ এবং ক্ষয় হ্রাস করতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি অ্যাথলেটিকের কর্মক্ষমতা উন্নত করে এবং প্রদাহ বা ব্যথা হ্রাস করে

সংক্রমণ হ্রাস করে:

এটি সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে ফলে গুরুতর স্বাস্থ্য পরিস্থিতি থেকে মুক্ত রাখে।

নিয়মিত ত্রিফলা খাওয়া শুরু করলে দেহের পুষ্টিকর উপাদানের মাত্রা এতটা বেড়ে যায় যে তার প্রভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটতে সময় লাগে না।

ফলে ছোট-বড় রোগব্যাধির প্রকোপ কমে চোখের নিমেষে।

ডায়াবেটিসে কার্যকরী:

এর প্রতিটি উপাদান হাইপোগ্লাইসেমিক হওয়ায় এটি রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করে। এর ভিতরে বিদ্যমান উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে খুব সহায়ক ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকৃত হতে পারে।

কিছু নির্দিষ্ট ক্যান্সার প্রতিরোধী:

বেশ কয়েকটি টেস্ট-টিউব এবং প্রাণী গবেষণায় দেখা গেছে যে, ত্রিফলা নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজ করে।

উদাহরণস্বরূপ, এটি লিম্ফোমা বৃদ্ধি, পেট এবং অগ্ন্যাশয় ক্যান্সারের প্রতিরোধ করতে পারে। ত্রিফলা টেস্ট-টিউব স্টাডিতে কোলন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার কোষের মৃত্যুর জন্যও কাজে লেগেছিলো।

খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়:

ত্রিফলার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট একদিকে যেমন এলডিএল (LDL) বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।

তেমনি হার্টে যাতে কোনওভাবেই প্রদাহ সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোনও ধরনের করনারি আর্টারি ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়।

ওজন হ্রাস করতে পারে:

অতিরিক্ত ওজনরে কারণে যদি চিন্তায় থাকেন, তাহলে ডায়েট কন্ট্রোলের পাশাপাশি আপনার প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত ত্রফলা চুর্ণ। কারণ নিয়মিত এই প্রাকৃতিক উপাদানটি গ্রহণ করলে বাওয়েল মুভমেন্টের উন্নতি ঘটে।

সেই সঙ্গে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটার কারণে শরীরে মেদ জমার আশঙ্কা একেবারে কমে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ওজন কমতে শুরু করে।

দাঁতের সমস্যা থেকে রক্ষা:

ব্যাকটিরিয়া ও খাদ্য কণিকার দ্বারা প্লেগ সৃষ্টি হয় সেটা যদি পরিষ্কার না করা হয়, তাহলে ব্যাকটিরিয়ার প্রকোপে মাড়ি ফুলে উঠতে পারে।

দাঁতের সমস্যাটি দূর করার সেরা উপায় হল নিয়মিত ত্রিফলা সেবন করা। এই ঔষধিটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণাগুণ আপনাকে দাঁতের সমস্যা থেকে রক্ষা করবে।

স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে:

নিয়মিত খালি পেটে ত্রিফলা খাওয়ার অভ্যাস করলে শরীরের অন্দরে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, যা ব্রেন পাওয়ার বাড়ানোর পাশাপাশি মানসিক ক্লান্তি এবং স্ট্রেস কমাতেও বিশেষ ভূমিকা নেয়।

এতে উপস্থিত গ্যালিক অ্যাসিড, ইলেগিক অ্যাসিড এবং চেবুলিনিক অ্যাসিড ত্বক এবং চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও কাজে আসে।

সতর্কতা

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।

আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত বা নিয়মিত কোনো মেডিকেল কোর্স-এর ভেতর দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ হেলথলাইন, maharasi ayurveda. NDTV.