হরিতকী হজমে সহায়ক, অ্যালার্জি নিরাময়ে, দাঁত ও ত্বকের যত্নে অতুলনীয়।

হরিতকী, নামটি খুব চেনা চেনা লাগছে তাই না। ভাবছেন কোথায় যেন শুনেছি। ঠিক ধরেছেন ত্রিফলা নামে পরিচিত তিনটি ফলের একটি হরিতকী। আমলকি, হরিতকী এবং বহেরা একসঙ্গে ত্রিফলা বলা হয়।

স্বাদে একটু তিক্ত, প্রথম কামড় দেওয়ার সাথে সাথে মনে হবে ফেলেদি। তারপর মনে হবে তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে মুখটা ধুয়ে ফেলি। যখনই মুখ ধুতে বা পানি খেতে যাবেন তখনই অবাক হয়ে যাবেন।

এটা ভেবে যে পানি এত মিষ্টি লাগছে কেন। তাই হরিতকী সরাসরি চিবিয়ে খেতে না পারলে রস করে পানির সাথে খেতে পারেন।

অসাধারণ স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য হরিতকীকে “মেডিসিনের কিং” বলা হয়। রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নিরাময়ের বৈশিষ্ট্যর জন্য আয়ুর্বেদে হরিতকীর অবস্থান অনেক উপরে।

আয়ুবের্দ চিকিৎসা শাস্ত্রে, তেঁতো স্বাদের ছোট এ ফল মানব দেহের জন্য মহাষৌধ হিসেবে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

হরি অর্থ হল “যা চুরি করে” এবং তকীর অর্থ “যা ত্বকের আভা পরিষ্কার করে। অর্থাৎ হরতকী হল যা দেহ থেকে সমস্ত রোগকে সরিয়ে দেয় এবং ত্বকে উজ্জ্বলতা এনে দেয়।

ভিটামিন “সি” এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানগুলিতে সমৃদ্ধ।

গলা ব্যথা এবং এলার্জি থেকে শুরু করে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজম পর্যন্ত বিভিন্ন রোগ নিরাময় করতে লোকেরা হরিতকী ব্যবহার করে।

ক্ষত নিরাময়ে, ছত্রাকের সংক্রমণ, মুখের শ্লেষ্মা ঝিল্লির প্রদাহ, হাঁপানি, পাইলস এবং কাশিতেও উপকারী হরিতকী।

ইংরেজীতে Myrobalan, বৈজ্ঞানিক নাম টের্মিনেলিয়া চেব্যুলা (Terminalia chebula), বাংলায় হরিতকী।

আয়ুর্বেদে হরিতকীর সাতটি জাতের কথা বলা হয়েছে যথা- বিজয়া, রোহিনী, পুতনা, অমৃতা, অভয়া, জীবন্তি এবং চিতাকি।

হরিতকীর উপকারীতা

নিচে হরিতকীর উপকারীতা দেওয়া হলো-

হজমের উন্নত করে:

নিয়মিত হরিতকী খেলে হজম শক্তির কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। পেট ফাঁপা এবং অন্যান্য গ্যাস্ট্রিক (গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল) সমস্যা কমাতে পারে।

রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সামান্য বিট লবণ, লবঙ্গ বা দারুচিনির সঙ্গে হরিতকীর গুঁড়ি মিশিয়ে খান। এতে পেট পরিষ্কার থাকবে। এছাড়া কোষ্ঠকাঠিণ্যতা দূর করে হরিতকী।

অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল:

হরিতকী গ্যালিক অ্যাসিড, ইলেগিক অ্যাসিড, চেবুলিনিক অ্যাসিড, ফ্ল্যাভোনল গ্লাইকোসাইডস, সেলেনিয়াম এবং ভিটামিন এর উৎস, যা আমাদের শরীরকে ক্যান্সার এবং অন্যান্য গুরুতর রোগ থেকে রক্ষা করে।

হরিতকীতে ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ রোধ করার জন্য শক্তিশালী অ্যান্টি-ব্যাকটিরিয়াল এবং অ্যান্টিভাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

অ্যালার্জির বিরুদ্ধে লড়াই করে:

অ্যালার্জির সমস্যা আছে অনেকের। অ্যালার্জি দূর রাখতে হরিতকী বেশ কার্যকর। যার অ্যালার্জি আছে প্রতিদিন হরিতকী ফুটিয়ে সেই পানি খেলে অ্যালার্জির সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

অনেকেরই গলা ব্যথা হয়ে থাকে বা অ্যালার্জিতে মুখ ফুলে যায়। এ ধরণের সমস্যা হলেও হরিতকী পানিতে ফুটিয়ে সেই পানি পান করলে অনেকটা আরাম পাবেন।

বুকে ব্যথা ও জয়েন্ট ব্যথা দূর করে:

কিছু গবেষণা দেখায় যে হরিতকী খাওয়া হার্টের সমস্যা বা বুকে ব্যথা অনুভবকারীদের জন্য ভালো।

হরিতকীর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্যগুলি বাত, গাউট এবং জয়েন্টে ব্যথার চিকিৎসার জন্য বেশ কার্যকর।

দাঁত ও মুখের জন্য:

হরিতকী পেস্ট বা গুড়ি এবং দই দিয়ে তৈরি পেস্ট মুখের আলসার এর চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করতে পারেন, দাঁতে ব্যথা বা মাড়ির সমস্যা থাকলে।

দাঁত ঝকঝকে করতে দাঁত বা মাড়িতে পেস্টটি লাগাতে পারেন। এটি দিনে দুবার দাঁতে লাগান। এটি দাঁত ঝকঝকে বা পরিষ্কার করে দাঁতকে শক্তিশালী করবে।

ডায়রিয়া এবং আমাশয়:

দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া এবং আমাশয়ের জন্য কার্যকর প্রতিকার হিসাবে হরিতকী বা হরিতকীর গুড়ি।

বাটিতে এক চামচ হরিতকী গুঁরি এবং এক চামচ খাঁটি মধুর সাথে ভালভাবে মিশিয়ে খেলে ডায়রিয়া এবং আমাশয় থেকে দ্রুত আরাম পাওয়া যায।

ভালো ফলাফল পেতে দিনে দুবার মিশ্রণটি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ত্বক এবং চুল:

ব্রণ দূর করতে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতার পাশাপাশি চুল পড়া এবং খুশকির জন্য হরিতকী খুবই ফলদায়ক।

ব্রণ এবং ত্বকের জ্বালা নিরাময়ের জন্য গরম পানিতে হরিতকী গুঁড়ি দিয়ে পেস্ট তৈরি করে ঠান্ডা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

তারপর এটি ঠান্ডা হয়ে গেলে সরাসরি ত্বকের আক্রান্ত স্থানে প্রয়োগ করুন। এটি ব্রণর প্রকোপ রোধ করতে ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ফুসফুসের ব্যাধি:

হরিতকী বা হরিতকী পাউডার কাশি, ব্রঙ্কাইটিস এবং ফুসফুসের অন্যান্য সমস্যার জন্যও পরামর্শ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রায় আধা চা চামচ গুঁড়ি ও অল্প পরিমাণে মধু মিশিয়ে খেতে হবে।

চোখের ব্যাধি:

চোখের ব্যাধির জন্য হরিতকী খুবই কার্যকর। এটি আয়ুর্বেদিক ঔষুধ ‘ত্রিফলা’ এর অন্যতম প্রধান উপাদান।

হরিতকী পানি আই ওয়াশ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। রাত্রে হরিতকী পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরের দিন সকালে এই পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলুন।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ভালো:

রক্তে উচ্চ গ্লুকোজের মাত্রা এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা হ্রাস টাইপ-2 ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ।

হরিতকীর উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করতে দেখা গেছে। তবে হরিতকী বা হরিতকী গুড়ি খাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলোচনা করা উচিত।

হরিতকী রোদে শুকিয়ে অনেক দিন পর্যন্ত রাখা যায়। এটি শুকিয়ে পাউডারও করে নিতে পারেন। এর কোনো বিশেষ ক্ষতিকর দিক এখনো পাওয়া যাই নাই।

তবে আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে হরিতকী খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।