মাথা ব্যথা থেকে মুক্তি পাবার প্রাকৃতিক উপায়।

মাথা ব্যথার সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। মাথা ব্যথা হলে আমাদের যেন কিছুই ভালো লাগেনা। তখন সবকিছু ছেড়ে চুপচাপ অন্ধকার ঘরে বসে থাকতে মন চায়। মাথা ব্যথা এমন একটি রোগ যেটি একজন মানুষকে যথেষ্ট ভাবে দুর্বল করে দিতে পারে।

কাজের চাপ, রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় নাই, অতিরিক্ত টেনশন, জোরে শব্দ বা অতিরিক্ত সূর্যের তাপ এমনকি অতিরিক্ত ঠান্ডায়ও মাথা ব্যথা হতে পারে। এছাড়া সর্দি-কাশি, জ্বর এবং গাঢ় সুগন্ধির কারণেও মাথায় ব্যথা হতে পারে।

মাথা ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে আমরা ঔষুধ খেতে পারি কিন্তু যেকোনো সময় হঠাৎ করে ঔষুধ খাওয়া আমাদের শরীরের জন্য ভালো না। তাই আমাদের প্রাকৃতিক উপায়গুলো বেছে নেওয়া উচিৎ। নিচে প্রাকৃতিক উপায়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

আদা:

আদাতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি সহ অনেক উপকারী যৌগ রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনের ব্যথা আছে এমন ১০০ জনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাইগ্রেনের ব্যথা হ্রাস করার ক্ষেত্রে আদা খুবই কার্যকর ছিল।

এছাড়া আপনি আদা চাও খেতে পারেন। আদা চা যেকোনো ধরনের মাথা ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মাইগ্রেনের মাথা ব্যথার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষেধক হল আদা।

এটি রক্ত চলাচলকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে মস্তিষ্কে সঠিকভাবে রক্ত চলাচল সম্পন্ন হয়। যা মাথা ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পানি পান করুন:

পানি আমাদের শরীরের অধিকাংশ রোগ দূর করতে পারে। অপর্যাপ্ত পানি পান করা মাথা ব্যাথার অন্য আরেকটি কারণ হতে পারে। অধ্যয়নগুলি প্রমাণ করেছে যে, দীর্ঘস্থায়ী ডিহাইড্রেশন হল মাথা ব্যথা এবং মাইগ্রেনের একটি সাধারণ কারণ।

মাথা ব্যাথার সময় আমাদের বেশি পরিমাণে পানি পান করা উচিত। কেননা সঠিক পরিমাণে পানি পান করলে মাথা ব্যথা কমাতে সহায়তা করবে। এছাড়াও আমাদের শরীরের রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে, যা মাথা ব্যথাকে কমাতে সহায়তা করবে।

পর্যাপ্ত ঘুম:

পর্যাপ্ত ঘুম আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রতি রাতে ছয় ঘণ্টারও কম ঘুমিয়েছে এবং যারা বেশি ঘুমিয়েছে তাদের মধ্যে তুলনা করে দেখা গেছে যে, যারা কম ঘুমিয়েছে তাদের ঘন ঘন এবং তীব্র মাথা ব্যথা ছিল।

তবে খুব বেশি ঘুমও মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। তাই প্রাকৃতিক ভাবে মাথা ব্যথা প্রতিরোধ করতে হলে সঠিক বিশ্রাম অর্থাৎ পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে।

আইস প্যাক:

মাথা ব্যাথা শুরু হলে মাথার উপর আইস প্যাক ধরে রাখুন। তবে যাদের অল্পতেই ঠান্ডা লাগার প্রবণতা রয়েছে তাদের জন্য এ পদ্ধতিটি নয়। এটি স্নায়ুকে করে দেয় এবং রক্তনালী সীমাবদ্ধ করে, এগুলি সবই মাথা ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।

২৮ জন মহিলার এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মাথায় ঠান্ডা জেল প্যাক প্রয়োগ করায় মাইগ্রেনের ব্যথা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

একটি আইস প্যাক তৈরি করতে, বরফের সাথে পানি মিশিয়ে ব্যাগটি পূর্ণ করে একটি নরম তোয়ালে মুড়ে নিন। তারপর মাথা ব্যথা কমানোর জন্য মাথায়দিয়ে রাখুন। এতে করে আরাম পাবেন।

লবঙ্গ:

মাথা ব্যথা কমাতে একটি অন্যতম উপাদান হলো লবঙ্গ। এটি মাথা যন্ত্রণা কমিয়ে একটি ঠাণ্ডা অনুভূতি প্রদান করে। লবঙ্গ ভালো করে পিষে নিয়ে হাতের তালুতে রেখে বা পরিষ্কার কাপড়ের ভেতর নিয়ে এক মিনিট এর ঘ্রাণ নিন এবং দেখুন মাথা ব্যথা চলে গেছে।

পুদিনা পাতা:

মাথা ব্যথা কমানোর জন্য একটি অন্যতম প্রাকৃতিক উপাদান হলো পুদিনা পাতা। পুদিনা পাতার মধ্যে ম্যানথল ও ম্যানথন নাম দুটি উপাদান রয়েছে। এই উপাদান দুটি মাথা ব্যথা দূর করার জন্য খুব ভালো কাজ করে।

একমুঠো পুদিনা পাতা নিয়ে সেটি পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখার পর পানি থেকে তুলে পুদিনা পাতা পেস্ট করে রস বের করে নিন। এবার এই মিশ্রণটি সরাসরি কপালে লাগান, যেখানে ব্যথা হচ্ছে। এছাড়াও পুদিনা পাতার চাও তৈরি করে খেতে পারেন।

এক কাপ পানিতে ৭-৮ টি পুদিনা পাতা এবং হাফ চামচ মধু দিয়ে চা তৈরি করে খেতে পারেন। এটিও মাথা যন্ত্রণা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তুলসী:

তুলসী অতিপরিচিত শব্দ হলেও আমরা তুলসীর উপকারীতা সম্পর্কে অনেকেই জানি না। অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে সর্দি কিংবা দীর্ঘদিন কাশির ফলে মাথা ব্যথা হতে পারে।

সেক্ষেত্রে তুলসী এ ধরনের মাথা ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তুলসীর মধ্যে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান সর্দির ভাইরাসকে ধ্বংস করে শ্লেষ্মাকে পাতলা করতে সহায়তা করে।

যার ফলে মাথা হালকা হতে শুরু করে। মাথা ব্যথা কমাতে তুলসী পাতার চা ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথবা বাজার থেকে তুলসী টি কিনে খেতে পারেন।

আপেল সিডার ভিনিগার:

মাথা ব্যথা কমাতে আপেল সিডার ভিনেগারের গুরুত্ব গবেষণায় প্রমাণিত না হলেও এটি ব্যক্তিদের নিজস্ব ব্যবহারের ফলে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আপেল সিডার ভিনিগার মাইগ্রেনের মত জটিল ধরনের মাথা ব্যথা কমাতে বা টেনশন জনিত কারণে হওয়া মাথা ব্যথা কমাতে পারে।

ঘনঘন যাদের মাথা ব্যথার সমস্যা দেখা দেয়, তাদের মাথা ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। এক গ্লাস হালকা গরম পানিতে দুই চামচ আপেল সিডার ভিনিগার ভালো ভাবে মিশিয়ে নিন। এবার এই মিশ্রণটি পান করুন। দিনে ১-২ বার এটি পান করতে পারেন। এটি খাওয়ার ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি ঘটবে এবং মাইগ্রেন কিংবা টেনশন জনিত কারণে মাথা ব্যথা কমাতে সহায়তা করবে।

ম্যাগনেসিয়াম:

রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ এবং স্নায়ু সংক্রমণসহ দেহে অগণিত ক্রিয়াকলাপের জন্য ম্যাগনেসিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মজার বিষয় হচ্ছে ম্যাগনেসিয়াম মাথা ব্যথা কমাতে কার্যকর।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ৬০০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম সাইট্রেট দিয়ে চিকিৎসা মাইগ্রেনের মাথা ব্যথার তীব্রতা হ্রাস করতে সহায়তা করে।

কফি পান করুন:

মাথা ব্যথা কমাতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি পানীয় উপাদান হলো চা এবং কফি। এই দুটোই মাথা ব্যথার ঔষুধ হিসেবে কাজ করে।

এছাড়া কফির মধ্যে থাকা ক্যাফিন মাথা ব্যথা কমাতে কিংবা মাথা ব্যথার চিকিৎসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া আদা চাও মাথা ব্যথা দূর করতে খুবই কার্যকর। এই দুটো পানীয় তৎক্ষণাৎ মাথা ব্যথা থেকে রেহাই পেতে সাহায্য করে।

লেবু:

মাইগ্রেন জনিত কারণে হওয়া মাথা ব্যথা কমাতে আরেকটি প্রাকৃতিক উপাদান হলো লেবু। এর সাথে যদি কিছু পরিমাণ লবণ যোগ করা যায় সেটিও এই ব্যথা কমাতে আরো ভালো করে। মূলত লেবুর মধ্যে থাকা সাইট্রাস জাতীয় উপাদান এবং লবণের মধ্যে থাকা ম্যাগনেসিয়াম যেকোনো ধরনের ব্যথা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাইগ্রেনের ব্যথা কমাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

যোগব্যায়াম:

যোগব্যায়াম করার মানে হল মানসিক চাপ থেকে মুক্তি, নমনীয়তা বৃদ্ধি, ব্যথা হ্রাস এবং জীবনের মান উন্নত করার একটি দুর্দান্ত উপায়। যোগব্যায়াম মাথা ব্যথার তীব্রতা কমাতে সহায়তা করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনযুক্ত ৬০ জন ব্যক্তির একটি গবেষণার উপর যোগব্যায়ামের প্রভাব পরীক্ষা করা হয়েছিল।

অন্য গবেষণায় দেখা গেছে যে ব্যক্তিরা তিন মাস ধরে যোগব্যায়াম করেছিলেন, আর যারা যোগব্যায়াম করেননি তাদের তুলনায় মাথা ব্যথার ফ্রিকোয়েন্সি, তীব্রতা এবং এর সাথে সম্পর্কিত লক্ষণগুলো উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছিল।

ব্যয়াম করুন:

মাথা ব্যথার ফ্রিকোয়েন্সি এবং তীব্রতা হ্রাস করার একটি সহজ উপায় হল শারীরিক কাজ কর্মে লেগে থাকা।

উদাহরণস্বরূপ, ৯১ জনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মাথা ব্যথার ফ্রিকোয়েন্সি হ্রাস করার জন্য Relaxation এর থেকে যারা ৪০ মিনিট ধরে বাইরে সাইকেল চালায় তাদের মধ্যে মাথা ব্যথা কম ছিল।

৯২,০০০ এরও বেশি লোক সহ আরও একটি অধ্যয়ন দেখায় যে, নিম্ন স্তরের শারীরিক ক্রিয়াকলাপ স্পষ্টভাবে মাথা ব্যথার ঝুঁকির সাথে জড়িত ছিল।

শক্ত ঘ্রাণ এড়িয়ে চলুন:

যেকোনো ধরনের দৃঢ় গন্ধ সম্পন্ন পারফিউম, ধুপকাঠি কিংবা সুগন্ধি ব্যবহারের ফলে হঠাৎ মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। মাইগ্রেন বা টানাপূর্ণ মাথাব্যথার অভিজ্ঞতার শিকার হওয়া ৪০০ জনের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, শক্ত গন্ধ, বিশেষত সুগন্ধিগুলি প্রায়শই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

যদি আপনার মনে হয় গন্ধের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে তাহলে আতর, সিগারেটের ধোঁয়া এবং সুগন্ধযুক্ত খাবারগুলি এড়িয়ে চললে মাথা ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে পারে।

রোদ থেকে দূরে থাকতে হবে:

রোদ আমাদের শরীরের জন্য ভালো হলেও। কাঠফাটা রোদে আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। যাদের মাইগ্রেনের সমস্যা রয়েছে তারা রোদে ছাতা ব্যবহার করুন বা খুব বেশি রোদে রাস্তায় না বেরোনো ভালো কারণ রোদে গেলে তাদের মাথা ব্যথা বাড়তে পারে।

মাথা ব্যথাকে অবহেলা না করে সেটি যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।