ডেঙ্গুজ্বর হলে কি খাবেন? প্লাটিলেট বাড়ে যা খেলে।

শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর। এখন ডেঙ্গু শুধু ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ নেই। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ডেঙ্গু হলে খাবার-দাবার ও পুষ্টির দিকে খেয়াল রাখা কম জরুরি নয়। খাবার ব্যাপারে বড়দের নিয়ে ঝামেলা কম হয়। মারাত্মক কঠিন পরিস্থিতি ও টেনশনের মধ্যে পড়তে হয় বাচ্চাদের নিয়ে। জ্বর হলে বাচ্চারা কিছুই খেতে চাই না। খাওয়াদাওয়া একেবারেই ছেড়ে দেয়।

ভ্যান্ডারবিল্ট স্কুল অফ মেডিসিনের চিকিৎসক উইলিয়াম শ্যাফনারের মতে, জ্বর প্রতিরোধের সেরা উপায় হল প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করা। পানি, গরম চা এবং 100 শতাংশ ফলের রস, জ্বরের জন্য খাবারের তালিকায় রাখুন। জ্বরের জন্য আপনার তরল সমৃদ্ধ খাবার যেমন খাওয়া উচিত তেমনি লো-সোডিয়াম বা পোল্ট্রি ব্রোথ, শতভাগ ফলের রস এবং পাতলা স্যুপ।

কমলা, স্ট্রবেরি, তরমুজ, আনারস, কিউই এবং বেদানাসহ জ্বরের জন্য সেরা খাবারের তালিকায় অনেকগুলি ফল রয়েছে। এই ফলগুলি ভিটামিন “সি” সমৃদ্ধ। এই সব ফলের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট আপনার ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।

২০০৯-এ পেডিয়াট্রিক্সে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ জানিয়েছে যে, নিয়মিত প্রোবায়োটিক খাবার গ্রহণ করুন যাতে উপকারী লাইভ ব্যাকটেরিয়া গ্রহণ নিশ্চিত হয়। প্রোবাইয়টিক খাবার বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ খাবার অসুস্থ বাচ্চাদের জ্বর দারুণভাবে হ্রাস করতে পারে। কিছু শিশুদের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া শিশুদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। লাইভ ব্যাকটিরিয়া যুক্ত দই জ্বরের জন্য সেরা খাবারগুলির মধ্যে একটি। কম ফ্যাটযুক্ত টক দই সবসময়ের জন্য ভালো।

জ্বর হলে প্রোটিন খাওয়া বাদ দিলে চলবে না। প্রোটিন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তি দিতে সহায়তা করে। ডিমের সাদা অংশ, মুরগী বা টার্কির মাংস। এছাড়া কম বা ননফ্যাট দুধ, দই বা টোফু দিয়ে তৈরি গরম চা বা কফি।

জ্বর হলে ডাবের পানি, আখের রস, লেবুর রস, বেদনার রস, আনারস, স্ট্রবেরি, তরমুজ, পাকা পেঁপে ইত্যাদি খান। চিকেন স্যুপ, সবজির স্যুপ অর্থাৎ বড়রা তরলজাতীয় অনেক খাবারই খেতে পারেন। বাচ্চাদের বুকের দুধ, চিকেন স্যুপ, ডাবের পানি, মধু, তাঁজা ফল এবং ওটমিল খেতে দিন। বাচ্চাদের ক্যাফেইনটেড বেভারেজ, হার্ড অর jagged ফুডস, প্রসেসেড ফুডস একেবারেই দিবেন না। High in স্যাচুরেটেড ফ্যাট এন্ড সুগার- এই খাবারগুলি বাচ্চাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

ডেঙ্গুজ্বর হলেও উপরের খাবারগুলো খেতে হবে। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর হলে যেহেতু রক্তের প্লাটিলেট কমে যাই এবং কোনোরকম আঘাত ছাড়াই চোখ, নাক, খাদ্যনালী, মূত্রনালী, চামড়ার নিচে, মাড়িসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষরণ হয়, পেটব্যথা ও অনেক সময় যকৃৎ বড়ো হয়ে যাই। তাই ডেঙ্গু জ্বর হলে খাবারের বিষয়ে একটু বেশি সচেতন হতে হবে। যেসব খাবার রক্তক্ষরণ কমায় এবং প্লাটিলেট বাড়ায় সেগুলো বেশি করে খেতে হবে।

ভিটামিন k সমৃদ্ধ খাবারগুলো রক্তক্ষরণ কমায়।

ভিটামিন k- সমৃদ্ধ খাবারগুলি কি কি?

১. সবুজ শাকসবজিতে ভিটামিন k পাওয়া যায়। সবুজ শাকসবজির মধ্যে পালংশাক, সর্ষেশাক, ধনেপাতা, লেটুস পাতায় ভিটামিন k বেশি পাওয়া যায়। সবজি ভালোভাবে ধুয়ে জুস করেও খেতে পারেন।

২. ব্রকলি, ফুলকপি, পাতাকপি, turnip green বা ওলকপি ভিটামিন k এর ভালো উৎস। সবজির স্যুপ খান। চিকেন ও সবজি একসাথে স্যুপ করেও খেতে পারেন।

৩. মাছ, লিভার(গরু ও অন্যান্য), মাংস, ডিম এবং cereals- তে অল্প পরিমানে ভিটামিন k পাওয়া যায়।

প্লাটিলেট কি :

প্লেটলেটগুলি হ’ল কোষ যা আমাদের রক্তের মধ্যে সঞ্চালিত হয় এবং যখন তারা ক্ষতিগ্রস্থ রক্তনালীগুলি সনাক্ত করে তখন একত্রে আবদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনার শরীরের কোথাও কেটে যাই প্লাটেলেটগুলি ক্ষতিগ্রস্ত জায়গায় আবদ্ধ হয়, যার ফলে রক্ত জমাট বাঁধে। তারা কেন সেখানে যাই তার একটি বিবর্তনীয় কারণ রয়েছে। এটা আমাদের রক্তপাত থেকে রক্ষা করে।

আপনার শরীরের কোথাও কেটে গেলো। ব্যাস সাথে সাথে প্লাটিলেট সেখানে হাজির। আপনার রক্তপড়া বন্ধ। প্লাটিলেট না থাকলে রক্তপড়া কখনোই বন্ধ হতো না। ভাবুনতো- কি ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।

রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা:

একটি সাধারণ প্লাটিলেট গণনা প্রতি মাইক্রোলিটার রক্তে 150,000 থেকে 450,000 প্লেটলেট থাকে।এই পরিমাপের চাইতে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে গেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি দেখা দেয়। ২০ হাজারের নিচে প্লাটিলেটের সংখ্যা নেমে আসলে কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। ৪,৫০,০০০ এরও বেশি প্লেটলেট থাকা থ্রোম্বোসাইটোসিস নামে পরিচিত; 150,000 এর কম থাকার থ্রোম্বোসাইটোপেনিয়া হিসাবে পরিচিত।

প্লাটিলেট বাড়ে যেসব খাবারে :

কোনো কারণে রক্তে প্লাটিলেট কমে গেলে জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনার মাধ্যমেই প্লাটিলেটের সংখ্যা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিছু খাবার আছে যেগুলো প্লাটিলেট বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। আসুন জেনে নিই, সেসব খাবারের নাম-

ব্রকোলি :

ব্রকলি ভিটামিন ও মিনারেলে পূর্ণ। এতে ভিটামিন “এ”, “সি” এবং “k” এর পাশাপাশি প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস(লুটেনিন, zeaxanthin, beta-carotene, সালফোরাফেন) এবং ফাইবার রয়েছে। রক্তক্ষরণ কমাতে এবং প্লাটিলেট বাড়াতে ব্রোকলির কোনো তুলনা হয় না। এই পুষ্টিকর উপাদানগুলি শরীরকে ভেতর থেকে এতটাই শক্তিশালী করে যে অসুস্থ্য হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়।

পালং:

ভিটামিন ও মিনারেলে পরিপূর্ণ পালং শাকে এক ডজনের অধিক এন্টি -ইনফ্লামেটরি ও এন্টি ক্যান্সার কম্পোনেন্ট রয়েছে। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। প্লাটিলেট দ্রুত বৃদ্ধি করে। পালংশাকে ভিটামিন k বিদ্যমান। এটি রক্তক্ষরণ কমায়।

ডাব:

কম ক্যালোরিযুক্ত, প্রাকৃতিকভাবে চর্বি ও কলেস্টেরল মুক্ত, কলা থেকে অধিক পটাশিয়ামযুক্ত- এক কথায় অমৃত। স্পর্শমনি বা divine elixir যেটাই বলি না কেনো ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, আইরন, কপার, ফান্ডামেন্টাল অ্যামিনো অ্যাসিড, প্রয়োজনীয় দুটি লবন- সোডিয়াম ও পটাশিয়াম- এতো পুষ্টি উপাদানের মিলনমেলা। এককথায় অসাধারণ এবং প্লাটিলেট বাড়াতে দারুন কার্যকর।

পেঁপে :

পেঁপে খুব দ্রুত রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম। মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডেঙ্গু জ্বরের কারণে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপে পাতার রস তা দ্রুত বৃদ্ধি করে। রক্ত প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিদিন পেঁপে পাতার রস কিংবা পাকা পেঁপের জুস পান করুন।

মিষ্টি কুমড়া এবং কুমড়া বীজ:

মিষ্টি কুমড়া রক্তের প্লাটিলেট তৈরি করতে বেশ কার্যকরী। এ ছাড়া মিষ্টি কুমড়াতে ভিটামিন ‘এ’রয়েছে যা প্লাটিলেট তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া এবং এর বীজ খেলে উপকার পাওয়া যায়।

লেবুর রস:

লেবুতে থাকা প্রচুর পরিমানে ভিটামিন “সি” রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।ফলে প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়। ভিটামিন সি রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতেও সহায়তা করে।

আমলকী:

আমলকী রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমান ঠিক রাখতে ও চোখের দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে। আমলকী লিভারের স্বাস্থ্যর জন্য ভালো। এটি লিভার থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে ও লিভারের কার্যক্ষমতা ভালো করতে সাহায্য করে।প্রতিদিন সকালে আমলকীর জুস খেলে পেপটিক আলসার প্রতিরোধে কাজ করে। আমলকী শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বের করতে সাহায্য করে এবং ওজন কমায়। মোদ্দাকথা হলো -ভিটামিন সি তে পরিপূর্ণ আমলকী। এ ছাড়া আমলকিতে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আছে। ফলে আমলকি খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

অ্যালোভেরার রস:

মানবদেহের জন্য যে ২২টা এমিনো এসিড প্রয়োজন তার ৮টি অ্যালোভেরাতে রয়েছে। এছাড়াও আছে ভিটামিন A, B1, B2, B6, B12, C এবং Eআপনি যদি নিয়মিত অ্যালোভেরা জুস পান করেন তাহলে আপনার ক্লান্তি দূর হবে এবং দেহ সতেজ ও সুন্দর থাকবে। ডায়রিয়া সারাতেও অ্যালোভেরা রস দারুণ কাজ করে।অ্যালোভেরা জুস হজম শক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই প্লাটিলেট বাড়াতে এলোভেরা জুস খান।

ডালিম:

ডালিম রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এতে প্রচুর আয়রন রয়েছে যা প্লাটিলেট বৃদ্ধি করে। খুব বেশি খেতে হবে এমন নয়। অল্প করে হলেও নিয়মিত কিছুদিন ডালিমের রস খাওয়ার চেষ্টা করুন। ডালিমের রসের ভিটামিন দুর্বলতা দূর করে কাজে শক্তি দেবে।