হলুদ দুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ত্বক উজ্জ্বল ও ব্রণ দূর করতে সাহায্য করে।

গোল্ডেন দুধ একটি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পানীয় যা মানুষ হলুদ দিয়ে তৈরি করে। এই গোল্ডেন দুধকে “হলুদ দুধ” বলা হয়। হলুদ দুধ তৈরির জন্য দুধের সাথে হলুদ, দারুচিনি, আদা এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে গরম করতে হবে।

এই মশলাগুলির মধ্যে অনেক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে বা প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

এছাড়া হলুদে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার, পটাশিয়াম, ভিটামিন “বি”৬, ম্যাগনেশিয়াম ও ভিটামিন “সি” ও কারকিউমিন নামক রাসায়নিক থাকে যা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে আমাদের বাঁচায়।

তবে ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন এই হলুদ দুধের সঙ্গে মেশালে এর গুণাগুণ আরও বেড়ে যায়।

অনেক আগে থেকেই হলুদ মিশ্রিত দুধ নানান ধরনের শারীরিক সমস্যার ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যেমন – ঠাণ্ডা লাগা, শারীরিক ব্যথাসহ বিভিন্ন রোগে এক গ্লাস হলুদ দুধ (Golden or Turmeric Milk) হতে পারে প্রাকৃতিক সমাধান।

হলুদ দুধের উপকারিতা

জেনে নিন, হলুদ দুধের উপকারিতা সম্পর্কে-

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:


হলুদ দুধে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ভাইরাল এবং অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য শরীরকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

এটি সর্দি-কাশি ও ফ্লু থেকে দূরে রেখে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন এক গ্লাস গরম দুধে এক চা চামচ হলুদ খেতে পারেন।

হাড় ভালো রাখে:


হলুদে থাকা কারকুমিন একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি যৌগ। গবেষণায় প্রমাণিত কারকুমিন বাতের (জয়েন্টে ব্যথা) ব্যথা কমাতে সহায়তা করে।

এটি হাড়ের টিস্যুগুলোকে রক্ষা করে এবং হাড়ের ক্ষয় রোধ করে। তাছাড়া দুধ ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিন “কে” এবং ভিটামিন “ডি” এর দুর্দান্ত উৎস, যা হাড়কে শক্তিশালী করে তোলে।

রিউমাটয়েড (rheumatoid) আর্থ্রাইটিসযুক্ত ব্যক্তিদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, কারকুমিন একটি অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি (ব্যথা নাশক) ঔষুধ এর থেকে বেশি কার্যকর ছিল।

turmeric Milk

কোষের ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়াই করে:


হলুদ দুধ থাকা কারকুমিন এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট একজন ব্যক্তির শরীরের কোষের ক্ষতি মেরামত করতে সাহায্য করে এবং অনেক অসুস্থতার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিভিন্ন রোগ ও সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।

মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে:


কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে, হলুদ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। হলুদ দুধ মস্তিষ্কের জন্য ভালো।

গবেষণায় দেখা গেছে যে হলুদ দুধে থাকা কারকিউমিন মস্তিষ্ক-প্রাপ্ত নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (BDNF) এর মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।

BDNF একটি যৌগ যা আপনার মস্তিষ্ককে নতুন সংযোগ তৈরি করতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।

মস্তিষ্কে BDNF এর মাত্রা কম থাকলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ যেমন আলঝেইমার্স (Alzheimer’s) হতে পারে।

আলঝেইমার্স এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মস্তিষ্কে একটি নির্দিষ্ট প্রোটিন জমা হওয়া, যাকে বলা হয় টাউ (tau) প্রোটিন।

টেস্ট-টিউব এবং প্রাণী গবেষণায় দেখা গেছে যে হলুদ দুধে থাকা দারুচিনির যৌগ এই টাউ জমা কমাতে সাহায্য করে।

রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে:


রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে হলুদ দুধ। এটি রক্তনালী পরিষ্কার করে তাই, হলুদ দুধ রক্ত পরিশোধক হিসেবেও কাজ করে।

হজমের সমস্যা দূর করে:


হলুদ দুধে থাকা আদা এবং হলুদ হজমের উন্নতি করতে পারে।

হলুদ দুধ বিভিন্ন ধরনের হজমের সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে যেমন গ্যাস, পেট ফুলে যাওয়া, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ইনফেকশন, ডায়রিয়া এবং পেটের আলসারের মতো বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধ করতে হলুদ দুধ অত্যন্ত কার্যকরী।

গবেষণা আরও দেখায় যে হলুদ দুধ বদহজমের লক্ষণগুলি কমাতে সাহায্য করতে পারে। হলুদ আপনার পিত্তের উৎপাদন ৬২% পর্যন্ত বাড়িয়ে চর্বি হজমের উন্নতি করতে পারে।

ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে:


গবেষণায় দেখা গেছে, হলুদে থাকা কারকিউমিন ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। ক্যান্সার হল অনিয়ন্ত্রিত কোষের বৃদ্ধি।

কাঁচা আদা ও দারুচিনি ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কমাতে সাহায্য করতে পারে। হলুদের সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে পারে এবং টিউমারে নতুন রক্তনালীগুলির বৃদ্ধি রোধ করতে পারে।

মাথাব্যথা দূর করে:


হলুদের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান দুধের পুষ্টির সঙ্গে মিশে মাথাব্যথা রোধে কাজ করে। পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন ধরনের ব্যথা রোধেও এই দুধ উপকারী।

অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে:


হলুদ দুধ সর্দির বিরুদ্ধে ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তবে এই পানীয়টি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য বেশি জনপ্রিয়।

টেস্ট-টিউব অধ্যয়ন পরামর্শ দেয় যে কারকুমিন এ অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে এবং লড়াই করতে সাহায্য করে।

আর এতে থাকা আদার যৌগ কিছু ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে। আদার নির্যাস মানুষের শ্বাসযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাস (HRSV) এর সাথে লড়াই করতে সাহায্য করে, যা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের একটি সাধারণ কারণ।

রক্তে শর্করার মাত্রা কমতে পারে:


জনপ্রিয় পানীয় হলুদ দুধের উপাদান আদা এবং দারুচিনি, রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

প্রতিদিন ১-৬ গ্রাম দারুচিনি রক্তে শর্করার মাত্রা ২৯% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া, দারুচিনি ইনসুলিন প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে পারে।

হার্টের রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী:


হার্টের রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ। দারুচিনি, আদা এবং হলুদ যা হলুদ দুধের মূল উপাদান। এই উপাদানগুলি হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।

১০টি সমীক্ষার পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ১২০ মিলিগ্রাম দারুচিনি মোট কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড এবং “খারাপ” কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমাতে পারে এবং “ভাল” কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।

ট্রাইগ্লিসারাইড এবং “খারাপ” কোলেস্টেরল এর মাত্রা হ্রাস পাওয়া এবং “ভাল” কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

হেপাটাইটিস ভাইরাস প্রতিরোধ করে:

হলুদে কারকুমিনের উপস্থিতির জন্য হলুদ দুধে অ্যান্টিভাইরাল উপাদান থাকে। এটা ভাইরাস প্রতিরোধ করে এবং এর বৃদ্ধিও প্রতিরোধ করে। হলুদ দুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং লিভারকে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।

ভালো ঘুমের জন্য:


ঘুমানোর এক ঘণ্টা আগে এক গ্লাস হলুদ দুধ পান করুন। দুধে থাকা উপকারি উপাদান হলুদের বিভিন্ন পুষ্টিগুণের সঙ্গে মিশে চাপ দূর করে এবং ভালো ঘুমে সাহায্য করে।

রক্ত পরিশোধন করে:


হলুদ দুধ রক্ত পরিশোধিত এবং পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। এর পুষ্টি রক্তে সঞ্চালন ভালো করে। হলুদের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট দেহের লিমপ্যাথিক পদ্ধতি ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ব্যথা কমায়:


হলুদ দুধে থাকা আদা, দারুচিনি এবং হলুদ প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

প্রদাহ কমানো বা প্রদাহ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। যেমন হৃদরোগ, ক্যান্সার, বাত, আলঝেইমার রোগ, বিপাকীয় সিন্ড্রোম ইত্যাদি।

৪৫ জন অংশগ্রহণকারী একটি ছোট অধ্যয়নে দেখা গেছে যে ৫০০ মিলিগ্রাম হলুদে সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন ব্যবহার প্রদাহ কমাতে ৫০ মিলিগ্রাম একটি সাধারণ আর্থ্রাইটিসের ওষুধ গ্রহণের মতো কার্যকর ছিল।

ত্বক উজ্জ্বল ও ব্রণ দূর করতে:


এটির মধ্যে এন্টিসেপ্টিক এবং এন্টিব্যাক্টেরিয়াল উপাদান থাকে যেটি ব্রণ দূর করতে সাহায্য করে। এটি শুধু ব্রণই দূর করে না, তার সাথে ব্রণের দাগ কমিয়ে দিয়ে মুখের উজ্বলতা বাড়িয়ে তোলে।

তাই নিজেকে ভিতর থেকে ব্রণ মুক্ত রাখতে চাইলে হলুদ দুধ খাওয়া অভ্যাস করুন।

বলিরেখা দূর করতে:


হলুদ দুধ ত্বকের বলিরেখা দূর করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন নিয়ম করে একগ্লাস হলুদ দুধ খাওয়ার চেষ্টা করুন। ত্বকের বয়েসের ছাপ দূর করে ত্বক ফর্সা করে তুলবে।

যেভাবে তৈরি করবেন হলুদ দুধ-

হলুদ দুধে ব্যবহৃত দুধ এবং হলুদ, উভয় উপাদানই স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারী। হলুদ দুধ তৈরি করতে, এক গ্লাস দুধ ভালো করে ফুটিয়ে তাতে এক চা চামচ হলুদ মিশিয়ে নিন।

স্বাদ বাড়াতে আপনি এতে আদা কুচি, ১ চামচ দারুচিনি গুঁড়া, ১ চিমটি গোল মরিচ ও ১ চামচ মধু মিশিয়ে নিতে পারেন।