করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যেসব ভেষজ খাবারগুলি গুরুত্বপূর্ণ।

করোনভাইরাস একটি বিশ্বব্যাপী মহামারী যেকারণে সবকিছু থমকে আছে। সমগ্র বিশ্ব কোভিড -১৯ এর নিরাময়ের পথ খুঁজছে। টিকা আবিষ্কার করার জন্য দিন-রাত এক করে ফেলছে। তারপরেও একেবারে কার্যকরী কোনো ওষুধ এখনো সাফল্যের মুখ দেখেনি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন যে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে আক্রান্তদের মৃত্যুহার হ্রাস করতে। তারা বলে যে, তুলসী, দারুচিনি, গোলমরিচ, আদা, হলুদ, মধু, কিসমিস, লেবুর রস এবং নিয়মিত যোগব্যায়াম ক্ষতিকারক ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক।

আয়ুর্বেদ শরীর ও মনকে সুস্থ ও সুখী রাখার জন্য একাধিক প্রতিরোধমূলক পদ্ধতির সমর্থন করে। আয়ুর্বেদ সর্বদা একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্যকর খাবার বা পান করার অভ্যাসের পরামর্শ দেয়। এই ভেষজ খাবারগুলি আপনাকে সুস্থ রাখতে এবং আপনার ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করবে।

তবে, আপনার যদি করোনাভাইরাসের লক্ষণ থাকে তবে অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দেওয়া সাধারণ নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন।

একটি ইতিবাচক মানসিকতা রাখুন। ভয় পেলে হবে না। মনের জোর ধরে রাখতে হবে। মহামারীর এই সময়ে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করছে। তার পরেও শান্তভাবে সবকিছু মোকাবেলা করতে হবে। আগের থেকে আরো বেশি ব্যায়াম করুন। প্রথমে নিঃশ্বাসের ব্যায়াম দিয়ে শুরু করুন।

দুগ্ধ (দই), পনির, ভাজা খাবার, মাংস, মাছ, লাল মরিচ বা শুকনো মরিচের মতো গরম খাবার এবং অধিক টক ও নোনতা খাবারগুলি কম খাওয়ার চেষ্টা করুন। বৃদ্ধি করুন: তাজা (রান্না করা) ভেজি এবং আনুপাতিকভাবে আরও সবুজ ভেজি যেমন: পালং, বাদামি চাল, মুগ ডাল (মটরশুটি), দানা, কিছু ভেজানো ফল ইত্যাদি।

ভেষজ খাবার ও ভাইরাস মোকাবেলা:

আমরা সকলেই জানি যে, কোনও প্রকার নতুন ভাইরাস বা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা জরুরি।

ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার:

আমরা জানি, সূর্যের আলো ভিটামিন-ডি-এর প্রধানতম উৎস। পরবর্তী ভালো উৎস মাশরুম। বাইরের দেশগুলোতে ভিটামিন-ডি এর চাহিদা পূরণে মাশরুম ব্যাপকহারে খাওয়া হয়। ডিমের কুসুম, দুধ, দই, কড লিভার মাছের তেলও – ভিটামিন ডি এর ভালো উৎস।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফুসফুসের সংক্রমণ যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া ইত্যাদি প্রতিরোধে এই ভিটামিন বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে। আবার দীর্ঘদিন ধরে শরীরে ভিটামিন ডি–এর ঘাটতি থেকে গেলে ফুসফুসের কার্যকারিতা কমতে পারে বলেও বেশ কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে।

এই ভিটামিন ভাইরাল সংক্রমণ রোধ করতে পারে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে পারে। সাধারণত, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন দেখা যায়। ভিটামিন-ডি এই প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইন যেমন এনএফ-কে বি ও গামা ইন্টারফেরনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার:

অন্যদিকে, ভিটামিন–সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট, যা শরীরের শ্বাসযন্ত্র ও সিস্টেমিক সংক্রমণকে রোধ করতে পারে। এটিও ভিটামিন-ডি এর মতো প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি সাইটোকাইনের মাত্রা হ্রাস করতে পারে।

শরীরের নিউট্রোফিলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে ফুসফুসের ক্ষতি উপশম করতে পারে। ভিটামিন “সি” আমাদের শরীরে জমা থাকে না। তাই পরিমিত পরিমানে নিয়মিত গ্রহণ করতে হয়।

করোনাভাইরাস সারা দুনিয়ার মানুষকে ঘরবন্দী করে ফেলেছে। কোনো প্রতিষেধক নাই বলেই আক্রান্ত মানুষকে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে নিজ দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।

সংগত কারণেই এখন জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে এমন সব খাবারগুলো নিয়ে, যা দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম। যে খাবারের তালিকায় একেবারে প্রাথমিক আলোচনাতেই রয়েছে ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ খাবার।

ভিটামিন সি, যাকে অ্যাসকরবিক অ্যাসিডও বলে, এটি দেহের অনেক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, এটি সারা শরীর জুড়ে টিস্যুগুলি বৃদ্ধি এবং মেরামত করে থাকে। সাধারণ সর্দি বা ঠাণ্ডার জন্য ভিটামিন সি একটি জনপ্রিয় প্রতিকার।

ভিটামিন “সি” এর উৎস:

ভিটামিন সি এর ডায়েটরি উৎসগুলিতে অনেকগুলি ফল এবং শাকসব্জী অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটস (এনআইএইচ) অনুসারে-সর্বাধিক ভিটামিন “সি” যুক্ত সূত্রগুলি হল তাজা, কাঁচা সাইট্রাস ফল (কমলা, আমলকি, পেয়ারা, লেবু), ক্যান্টালৌপস, কিউইস, আম, পেঁপে, আনারস, স্ট্রবেরি, রাস্পবেরি, ব্লুবেরি এবং তরমুজ। লাল এবং সবুজ মরিচ, পালং শাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম শাক এবং অন্যান্য পাতাযুক্ত শাক, টমেটো, আলু, ব্রকলি এবং শীতের স্কোয়াশ ভিটামিন “সি” এর অন্যতম ভাল উৎস।

আমরা অনেকেই সকালে খালি পেটে লেবুর রস হালকা গরম জলের সাথে খাই। কেউ আমলকির গুঁড়ো বা ত্রিফলা খান। আমলকি বা কমলালেবু-ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলের সাথে দু-একটি রসুনের কোয়া থেঁতলে খেতে পারেন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দারুন কার্যকর।

আদা:

মসলার মধ্যে অন্যতম ভেষজ গুন সম্পন্ন মসলা হলো আদা। আদাকে আমরা মূলতঃ ভেষজ ওষুধ হিসাবে। বিভিন্ন ধরণের ঔষুধে আদা ব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আদা হজমে সহায়তা করতে, বমি বমি ভাব হ্রাস করতে এবং সাধারণ জ্বর, সর্দি কমাতে সহায়তা করে। এটিতে শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রভাব রয়েছে। মুখের রুচি বাড়াতে ও বদহজম রোধে আদা খুবই কার্যকরী। বিশেষজ্ঞদের মতে আদা কোষ্ঠকাঠিন্যে দূর করতে পারে। কারণ আদায় আছে বিশেষ গুণ, যা অন্ত্রের গতিবিধি সচল করে কোষ্ঠকাঠিন্য ভাব দূর করতে পারে।

গোলমরিচ:

গোল মরিচে পাইপারিন (piperine) নামের রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা থেকে এর ঝাঁঝালো স্বাদটি এসেছে। আমরা সবাই গোল মরিচ এই শব্দটির সাথে পরিচিত। এটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক ব্যবহৃত একটি মশলা। গোলমরিচকে বলা হয় মশলার রাজা। কারণ এটির মতো এতো বেশি গুনাগুণ নাকি আর কোন মশলায় নেই। এই গুনের কারণে গোল মরিচ হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদিক ঔষুধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

এলাচি:

এলাচি শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা দূরীকরণে সহায়তা করে। এলাচি আপনার ফুসফুসের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে তোলে যা হাঁপানি, সর্দি এবং কাশির মতো শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে। আপনার প্রতিদিনের খাবারে এলাচি যুক্ত করুন বা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্যকর উপকারের জন্য এলাচি চা পান করতে পারেন।

মধু, লেবুর রস, গরম পানির সাথে একটা এলাচ পিষে মিশিয়ে পানিটুকু পান করালে তা শ্বাসকষ্ট দূর করবে। যারা হুপিংকাশি ও ফুসফুস সংক্রমণের মতো সমস্যায় ভুগে থাকেন তাদের জন্য এলাচ খুবই উপকারি।

নিম:

বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ঔষধী গাছ হিসাবে ৫০০০-বছর ধরে নিম গাছের ব্যবহার হয়ে আসছে। নিমের ডাল, পাতা, ফুল, বাকল সব কিছুই কাজে লাগে। ১৩০টি ঔষধী গুন সম্পন্ন নিম পাতা ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া নাশক হিসাবে খুবই কার্যকরী। নিম পাতা রক্ত পরিষ্কার রাখতে খুবই ভালো কাজ করে। ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের কষ্ট প্রতিহত করতে পারে নিম। ভাইরাল জ্বরের উন্নতি করতে পারে নিমপাতার রস।

তুলসী পাতা:

তুলসীপাতার এন্টিভাইরাল ও এন্টিফাংগাল বৈশিষ্ট রয়েছে। তুলসী পাতায় প্রচুর এন্টি অক্সিডেন্ট ও এসেনশিয়াল অয়েল আছে যা, শরীরের মধ্যে ইউজেনল, মিথাইল ইউজেনল ও ক্যারিওফাইলিন উৎপন্ন করে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এর ইথানলিক নির্যাস শরীরের আইএল-৬ নিঃসরণ এবং এনএফ-কে বি প্রকাশ বন্ধ করে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ক্ষমতা দেখায়।

লবঙ্গ:

লবঙ্গের অসাধারণ ঔষধি গুনাগুন রয়েছে। হাল্কা গরম পানিতে লবঙ্গের গুঁড়ির সাথে মধু যোগ করে, সেটা খেয়ে নিন অথবা লবঙ্গ চাও খেতে পারেন। ভাইরাল ফিভারে কাজে দেবে। শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতায় লবঙ্গ কাজ করতে পারে। গবেষণায় লবঙ্গের কুঁড়ি বা পাতা থেকে সংগৃহীত প্রয়োজনীয় তেলগুলোতে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ভাইরাল কার্যক্রম পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে প্রাপ্ত ইউজেনল ট্র্যাকিয়াল মসৃণ পেশিতে ভালো প্রভাব ফেলে এবং ব্রোঙ্কোডিলেটিং এবং অ্যান্টি-এজম্যাটিক হতে পারে।

গ্রীন টি:

সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে চায়ের জুড়ি নেই। চা যদি পানই করতে হয়, তবে গ্রিন টি নয় কেন? গ্রীন টিতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা সব দিক থেকে শরীর চাঙা রাখে। এটি রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া ক্যাটেচিন নামক একটি উপাদান থাকে এই চায়ে যা ভিটামিন “ই” এবং “সি” থেকেও বেশি শক্তিশালী।

জিংক সমৃদ্ধ খাবার:

জিংক মানবদেহের প্রতিরোধব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি করোনাভাইরাসসহ নানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এমনকি এটি করোনাভাইরাসের বংশবৃদ্ধির বিশেষ এনজাইম আরএনএ পলিমারেজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। গরুর মাংস, শুকরের মাংস, ডিম, মুরগি ইত্যাদি জিংক সমৃদ্ধ খাবারের প্রাণীজ উৎস। বিভিন্ন বীজ (মিষ্টি কুমড়োর বীজ, flaxseeds, সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদি), বাদাম, আস্ত শস্যদানা, ডাল, শিমের বীজ ইত্যাদি জিংক সমৃদ্ধ খাবারেরউদ্ভিজ্জ উৎস।

শক্তিশালী আয়ুর্বেদিক herb বা ঔষধিগুলির নিয়মিত ব্যবহার মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, এমনকি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংক্রামক রোগগুলিকে দূরে রাখতে সহায়তা করে।