প্রকৃতির মাঝে থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়, হার্ট সুস্থ্য থাকে ও আয়ু বৃদ্ধি পায়।

অনেকবার আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি সম্পূর্ণা তোমার ঐ রূপের মাধুর্যে আচ্ছন্ন হয়ে!
এখনো মাঝে মধ্যে হারাই-!!
এখনো মাঝে মধ্যে হারিয়ে যাই আমি এক অচেনা প্রকৃতির মাঝে!
যেই প্রকৃতিতে আমার অস্তিত্ব একেবারেই নতুন!!
প্রকৃতিটা বেশ আশা দিয়ে সাজানো, জানো?
অনেক স্বপ্নেরা ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় এই প্রকৃতির মাঝে!
–সৈয়দ শরীফ


প্রকৃতি… আহা কি শান্তি। প্রকৃতি মানে শান্তির পরশ দুঃখ বেদনা ভুলে গিয়ে মনটা আনন্দে ভরে উঠা। প্রকৃতি মানে এক বুক ভরে সতেজ নিঃশ্বাস।

প্রকৃতির মাঝে গেলে মনে হয় পুরো পৃথিবীটাকে ভুলে গিয়ে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে উজাড় করে দি।

বেশি বেশি সবুজ দেখুন, সবুজের মাঝে থাকুন, মাঝে মধ্যে হারিয়ে যান সবুজ প্রকৃতির মাঝে, তাহলেই বিষণ্নতা থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন- বিশ্বাস হয়? হ্যাঁ প্রকৃতি পারে আপনার বিষণ্নতা কাটায়ে আয়ুটা বাড়িয়ে দিতে

অনেকের কাছে মনে হবে যে প্রকৃতি নিয়ে এত কথা বলার কি আছে। কথায় আছে না আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝি না।

এমন অনেকে আছেন যারা প্রকৃতির ছোয়া থেকে অনেক দূরে অর্থাৎ শহরে। আসলে আমরা যারা শহরে থাকি তারা প্রকৃতি শব্দটা বুঝি।

সুস্থ্য, স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রকৃতির থেকে ভালো ওষুধ আর নেই।

যদি এ বিষয়টি আপনি মানতেই না চান তাহলে বলুন তো, আপনি যখন বেড়াতে যান পাহাড়ের কোলে বা সাগরের গর্জনের মাঝে অথবা ঘন সবুজ অরণ্যে, তবে কেন আপনার মন ভালো হয়ে যায়? এই ব্যাখ্যা কি আপনার কাছে আছে?

nature field

আসলে বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির দৌড়ের মাঝে আমরা কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আমাদের মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি বেশিরভাগ সময়েই আমাদের দৈনন্দিন নানা জটিলতায় ফেলে দেয়।

আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন, যারা সামান্য মানসিক চাপে একেবারেই ভেঙে পড়েন।

আর তাই এসবের সমাধান কিন্তু আমাদের হাতেই আছে। অনেকেই জানেন না, প্রকৃতি এক্ষেত্রে আমাদের কতটা উপকার করে থাকে।

বলতে গেলে আমাদের শারীরিক অসুস্থতা থেকে শুরু করে মানসিক সমস্যাসহ সকল কিছুর সমাধান প্রকৃতির মধ্যেই বিরাজমান।

গবেষকরা জানিয়েছেন, নিজেকে চাপমুক্ত রাখতে চাইলে প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় প্রকৃতির মাঝে কাটানো উচিত। প্রকৃতির নিবিড় ভালোবাসার হাতছানিতে কিছুটা সময় জিরিয়ে নিতে পারলে মন উৎফুল্ল হয়ে উঠবেই।

প্রকৃতির মাঝে থাকার উপকারিতা

প্রকৃতি কীভাবে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত থাকতে সাহায্য করে। তা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো –

আয়ু বৃদ্ধি করে:

মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি পেতে চাইলে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যান। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা বেশি সবুজ আবহাওয়ায় থাকেন।

কিন্তু যারা শহরাঞ্চলে ইট-কাঠ-পাথরের মাঝে জীবনযাপন করেন, তাদের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের মানুষজন বেশি দীর্ঘায়ুসম্পন্ন এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকেন।

তাদের মানসিক পীড়া তুলনামূলক কম থাকে। এটিই তাদের দীর্ঘায়ু হওয়ার মূল কারণ।

মনের অন্তর্দহন থেকে মুক্তি দেয়:

যাদের রয়েছে অনিদ্রা সমস্যা, তা অনেকটা দূর করতে সাহায্য করে সকালের সূর্যালোক রশ্মি।

ভোরের আলো আমাদের শরীর এমনকি মনের মাঝেও এক বায়োলজিক্যাল ঘড়ি হিসেবে কাজ করে, যা আমাদের দেহকে সময় মেনে কাজ করার জন্য বার্তা পাঠায়।

সকালে নির্দিষ্ট একটা নিয়ম মেনে ঘুম থেকে উঠলে খেয়াল করে দেখবেন রাতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপনা-আপনিই ঘুম চলে আসে। আর সে নিদ্রা সুখনিদ্রাই হয় বটে।

nature walking

হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে:

আমেরিকাতে প্রায় ৪ জনের মধ্যে ১ জন হার্টের রোগে আক্রান্ত হয়। একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কার্ডিওভাসকুলার শিথিলকরণের জন্য বনের প্রকৃতি পরিবেশে হাঁটাচলাচল করতে বলা হয়েছিল।

দেখা গেছে শহুরে থাকা গ্রুপের তুলনায় যারা বনের প্রকৃতি পরিবেশে বেড়ান তাদের হার্ট রেট কম ছিল।

অন্য একটি গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা যারা প্রায় ১৫ মিনিটের জন্য বনের পরিবেশে বসেছিলেন তাদের মধ্যে রক্তচাপ ১.৭% কম ছিল।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়:

হাস্যকর হলেও সত্য। প্রকৃতি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারে হাজার গুণ।

২০০৯ সমীক্ষায় দেখা গেছে, জাপানী প্রাপ্ত বয়স্করা যারা বন অঞ্চলে তিন দিন, দু-রাতের ভ্রমণে কাটিয়েছেন তাদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এছাড়া তাদের মধ্যে “natural killer” (NK) বৃদ্ধি পেয়েছিল। NK হল এক ধরণের শ্বেত রক্তকণিকা যা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্যগুলি মানব দেহের ক্ষতিকারক কোষগুলিকে মেরে ফেলতে সহায়তা করে।

ভিটামিন “ডি”:

ভিটামিন “ডি” আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন “ডি” এর মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে এবং অভাব বেড়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কিছু রাজ্য কার্যকর ভিটামিন “ডি” সংশ্লেষণের জন্য শীতের মাসে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায় না।

সূর্যের আলোর সংস্পর্শের মাধ্যমে শুধু মাত্র ভিটামিন “ডি” আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রেই উপকারী তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে এটিতে ব্যথার প্রকপ কমাতেও সহায়তা করে।

মানসিক চাপ কমায় এবং মনযোগ বাড়ায় প্রকৃতি:

মানসিক চাপ ও মনযোগ বাড়াতে চাই প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্য। বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় প্রমাণ দিয়েছেন, মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতার মতো মানসিক ব্যাপারগুলোর সবচাইতে বড় ওষুধ হচ্ছে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা।

গবেষকদের পরামর্শ অনুযায়ী, মানসিক চাপগ্রস্ত ব্যক্তি চরম হতাশ মুহূর্তে মাত্র ১০ মিনিটের জন্যেও যদি কোনো পার্ক বা খোলামেলা হাওয়াযুক্ত সবুজ পরিবেশ থেকে হেঁটে আসেন, তাহলেও তার মানসিক বিকারগ্রস্ততা কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও উপশম হয়।

কারণ, এতে মস্তিষ্কে তৈরি হয় কিছু ভালো লাগার হরমোন যা মানসিক চাপ উপশমে অসাধারণ কাজ দেয়।

nature road

ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় বাতলে দেয় প্রকৃতি:

ক্যান্সার প্রতিরোধে ও মনকে উদ্দীপ্ত করতে সবুজ প্রকৃতিই শ্রেষ্ঠ ঔষধ।

কঠিন অসুখ থেকে সেরে ওঠার জন্য অনেক সময় ডাক্তাররা প্রেসক্রাইব করে থাকেন রোগী যেন পছন্দসই কোনো ছায়া নিবিড় শান্ত পরিবেশে কিছু সময় কাটিয়ে আসেন।

একথার পেছনে রয়েছে খুব সুন্দর যুক্তি ও নানা গবেষণালব্ধ ফলাফল।

জাপানের কয়েকজন গবেষক বিষয়টির উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, প্রকৃতির নির্মল পরিবেশ, বনের সবুজ ছায়া, পাখির কিচির-মিচির বিষয়গুলো ক্যান্সার প্রতিরোধী প্রোটিনকে উদ্দীপ্ত করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত ধূমপানের অভ্যাস থেকে মুক্তিলাভের জন্য যদি প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারেন, তাহলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে:

দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা বৃদ্ধিতে সবুজের কোনো বিকল্প নেই। মায়োপিয়া হলো এমন একধরনের চোখের অসুখ যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ক্রমশ কাছের জিনিস কম দেখতে শুরু করেন।

তখন তাদেরকে চশমা ব্যবহার করতে হয়। যাদের এই সমস্যা হয় তাদের গবেষকরা আউটডোর অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

এক বছর পর তার ফলাফল হলো, মায়োপিয়া আক্রান্তের হার ১৭.৬৫% এ নেমে এসেছে। সুতরাং দুচোখ ভরে সবুজ দেখুন। একটু সময় নিয়ে সবুজের মাঝে বসে থাকুন।

যারা শহরে থাকে তাদের এই সুযোগটা কম। তাই তারা বেলকনিতে গাছ লাগাতে পারেন।

শর্ট টার্ম মেমরি ইম্প্রুভমেন্ট:

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিজ্ঞানী কিছু মানুষের উপর জরিপ চালান।

গবেষণার জন্য এসব মানুষদেরকে দু’ভাগে ভাগ করে একদলকে সবুজ ছায়ায় ঘেরা উদ্যানে, আরেক দলকে শহরের চেনা পরিবেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

যখন তারা ফিরে আসেন, তখন তাদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, যারা সবুজের মাঝে ছিলেন, তাদের স্মৃতিশক্তি আগের তুলনায় ২০ শতাংশ উন্নতি ঘটেছে।

আর যারা ছিলেন শহরের পরিবেশে, তাদের কোনো উন্নতিই ঘটেনি। এথেকে বোঝা যায় যে, প্রকৃতি মানুষকে তার স্মৃতি পুনরুদ্ধারে কতটা সাহায্য করে থাকে।

প্রকৃতির আছে কিছু অতুলনীয় গুণ। আর এই গুণগুলোই মানুষকে আকর্ষণ করে। প্রকৃতির কাছ থেকে কিছু শিক্ষা মানুষেরও নেয়া উচিত। তাতে জীবনের চলার পথটাকে অনেকটাই সহজ ও অকৃত্রিম মনে হবে।

রেফারেন্স: