পিত্তথলিতে পাথর-কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিন।
আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই লিভারের গায়ে লাগানো একটা পিত্তথলি আছে যার মধ্যে পিত্তরস জমা থাকে। Peer shape organ অর্থাৎ নাশপাতির মতো দেখতে এই অঙ্গটি লিভারের নিচের দিকে থাকে। আমাদের লিভারে যে পিত্তরস উৎপন্ন হয়, লিভার থেকে ওটা বের হয়ে এসে পিত্তথলিতে জমা হয়।
মজার বিষয় হলো, আমরা যখন চর্বিজাতীয় খাবার খায় তখন আমাদের নার্ভ ও মাংসপেশির সহায়তায় পিত্তথলিটা সঙ্কুচিত হয়ে এই রসটাকে খাদ্যনালীতে পাঠিয়ে দেয় এবং খাবার হজমে (বিশেষতঃ চর্বিজাতীয়) সহায়তা করে।
পিত্তর উপাদান যেমন: কোলেস্টেরল এবং বিলিরুবিন একত্রে মিলিত হয়ে পাথর গঠন করে। চর্বি আর পিত্তলবন এ দুটোর একটা সামঞ্জস্য থাকে আমাদের শরীরে। কোনো কারণে এ দুটোর তারতম্য ঘটে গেলে চর্বিটা বেড়ে গিয়ে এই সমস্যা হতে পারে।
পিত্তথলিতে পাথর কেন হয়?
ঠিক একটি কারণে গলব্লাডার স্টোন হচ্ছে তা নয়। একাধিক কারণে এটি হয়ে থাকে। এটি multifactorial রোগ হিসাবে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের করা গবেষণায় যে কারণগুলি বেরিয়ে এসেছে তা নিম্নরূপ:
- অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার খেলে। যে ব্যক্তি অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার বেশি বেশি খাবে তার পিত্তথলিতে চর্বির পরিমান এতো বেশি বেড়ে যাবে যে, পিত্তরস আর ঠিকমতো কাজ করতে পারবে না। এই চর্বি পিত্তরসের সাথে জমাট বেঁধে একসময় পাথরে পরিণত হবে।
- অত্যধিক আরাম আয়েশে যারা থাকে অর্থাৎ শারীরিক পরিশ্রম কম করে।
- যেসব মহিলারা Hormone Therapy অর্থাৎ স্ট্রোজেন নেয়। পিল খায়।
- মেয়াদউত্তীর্ণ ঔষধ ও খাবার খেলে। বছরের পর বছর গ্যাসের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে। পান ও বেশি পরিমানে চুন খেলে।
- হঠাৎ করে বেশি পরিমান ওজন কমিয়ে ফেললে।
- কারো কারো ক্ষেত্রে জেনেটিক্যালি-ও হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আগে থেকে সতর্ক হতে হবে।
মহিলাদের কি এই রোগ বেশি হয়?
হ্যা, মহিলাদের এই রোগ বেশি হয়ে থাকে। পুরুষদের কম হয়। ৪০-এর কোঠার মেয়েদের বেশি হয়ে থাকে। মোটাসোটা মহিলাদের ঝুঁকি বেশি। Obesity- এই রোগের অন্যতম একটি কারণ। সমগ্র আমেরিকানদের ১০-১৫ ভাগ লোক পিত্তথলির পাথর নিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। আমাদের দেশেও এই রোগ প্রচুর পরিমানে বেড়ে গিয়েছে।
কেন বেড়েছে ?
তেল-চর্বিযুক্ত ফার্স্ট ফুড খাওয়া বেড়েছে। বেগুনী, আলুরচপসহ বিভিন্ন তেলেভাজা আমরা প্রতিদিনই খাচ্ছি। গরুর মাংস, খাসির মাংস, বড় মাছ ছাড়া আমাদের একটা দিন যেন চলেই না। অন্যান্য কারণগুলো তো আছেই।
বাচ্চাদেরও হতে পারে। যেসব বাচ্চাদের রক্তে সমস্যা আছে মানে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায়। যেমনঃ থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বাচ্চাদের হতে পারে।
পিত্তথলিতে পাথর রোগের লক্ষণগুলো কি কি?
- পিত্তথলি লিভারের কাছাকাছি থাকে। পেটের ডানপাশে উপরের দিকে প্রচন্ড ব্যাথা করবে। এই ব্যাথা কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা ধরে আপনাকে যন্ত্রনা দিতে পারে। ব্যাথাটা আস্তে আস্তে পিঠের দিকে চলে যাবে।
- যেকোনো খাবার খেলেই বমি হবে।
- শরীরে সবসময় হালকা জ্বর থাকবে।
- জন্ডিস দেখা দিতে পারে।
- পায়খানার রং সাদা হয়ে যাবে।
কোন পরীক্ষা করলে বুঝতে পারবো পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে?
Ultrasonography (আলট্রাসনোগ্রাফি) করলে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। খুবই কম খরচে সহজলভ্য একটি চিকিৎসা এই আলট্রাসনোগ্রাফি।
আলট্রাসোনোগ্রাফি রিপোর্ট দেখার পরে ডাক্তার সাহেব যখন বলেন, আপনার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে, তখন প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তার মুখটা কালো হয়ে যায়। মনটা খারাপ হয়ে যায়। অপেরেশনের কথাতো এখনো বলাই হয়নি।
অপারেশনতো করতে হবে অবশ্যই। অপারেশন না করলে বিপদ আরো বেশি সামনে অপেক্ষমান। এক্ষেত্রে, কাউন্সেলিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ভয়ের কিছু নাই। ল্যাপারোস্কোপিক মেশিনের সাহায্যে চারটা মাত্র ফুটো করে পুরো পিত্তথলির পাথর অপারেশন করা সম্ভব। Recovery-ও খুব দ্রুত। রোগীকে দুদিন পরেই ছেড়ে দেয়া হয়। It is called golden standard of treatment.
যে পিত্তথলিতে পাথর হয় সে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম হারিয়ে ফেলে। তাই এটাকে রেখে দিলে ঝামেলা আরো বেশি। ঘরের ভিতর সাপ বা সাপের ডিম্ থাকলে তাকে বের করে দেয়া বা মেরে ফেলাই উত্তম।
অপারেশন-ছাড়া ওষুধ খেয়ে বা অন্য কোনোভাবে পিত্তথলির পাথর অপসারণ করা কি সম্ভব?
ওষুধ দিয়ে পাথর গলানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। অপারেশন ছাড়া MRCP- নামে একটা পদ্ধতি বাইরের দেশে চালু আছে। গলার ভিতর পাইপ ঢুকিয়ে করে। তবে এটা খুব বেদনাদায়ক ও সময়সাপেক্ষ্য।
অপারেশন কি অজ্ঞান করে করা হয়? অপারেশন পরবর্তী সমস্যা ও খাবার-দাবারের নিয়ম কি?
হ্যা, রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করা হয়। পেটে গ্যাস দেওয়া হয়। অনেকে সহ্য করতে পারে না। এজন্য অজ্ঞান করে নেওয়াই ভালো।
অপারেশনের পরে প্রথম ১-২ মাস অল্প অল্প করে বার বার খেতে হবে।
চর্বিযুক্ত খাবার কি খাওয়া যাবে?
চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া যাবে তবে অপারেশন পরবর্তী ১-২ মাস পার হবার পরে পরিমিত পরিমানে খাবেন। যতদূর সম্ভব রেড মিট, তেলে ভাজা, ফার্স্ট ফুড এড়িয়ে চলুন। অপারেশন পরবর্তী বেশিরভাগ রোগীর তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় দিনের পর দিন পাতলা পায়খানা হচ্ছে। দিন-রাত মিলিয়ে ৬-৭ বার। এক্ষেত্রেও চিকিৎসা আছে। আপনি দ্রুত আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।
পাথর আছে জেনেও অনেকে অপারেশন না করে দেরি করে, ভয় পায়।এতে কি কোনো ক্ষতি আছে?
এতে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। রোগীর গলব্লাডার ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে। আলট্রাসনোতে যখন পাথর ধরা পড়লো সে তো আর জানে না, কতদিন ধরে পাথরটা তার ভেতরে রয়েছে। ৫-বছর হতে পারে বা ১০-বছরও হতে পারে। Friction হয়, ঝিল্লীটা পরিবর্তন হয়, যে কারণেই হোক না কেন, ক্যান্সার হতে পারে। সময় সুযোগ বুঝে প্ল্যান করে অপারেশন করে নেওয়াই ভালো।
পাথর পিত্তনালিতে আটকে গেলে মারাত্মক জন্ডিস হতে পারে। পিত্তথলির পাশের অগ্ন্যাশয়েরও ক্ষতি করতে পারে। Pancreatitis -খুবই মারাত্মক একটি সমস্যা।
তেল-চর্বি কম খান। ফাইবারযুক্ত বা আঁশজাতীয় খাবার বেশি বেশি করে খাবেন। শারীরিক পরিশ্রম করুন। ওজন বাড়তে দিবেন না। গাজর, বীটরুট, ও শসার রস নিয়মিত খাওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলে প্রাকৃতিক বা ঘরোয়াভাবে এই সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভিটামিন “সি”-এর উচ্চ রক্তের মাত্রাযুক্ত মহিলাদের মধ্যে পিত্তথলির রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ভিটামিন “সি” বেশি থাকে এমন খাবারের মধ্যে রয়েছে আমড়া, বাঁধাকপি, ব্রাসেলস স্প্রাউটস, ফুলকপি, ব্রকলি, সবুজ শাক, টমেটো, সাইট্রাস ফল, পেয়ারা, আমলকি, কিউই ফল, স্ট্রবেরি এবং আনারস।