দীর্ঘায়ু লাভের বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত উপায়।

আমরা যেমন রন্ধনপ্রিয় বাঙালি ঠিক তেমনি খাদ্য রসিক। আর একটি শব্দ আমাদের সাথে যায় সেটা হলো অলসতা। অলসতা, অতিরিক্ত খাওয়া, অতিরিক্ত ধূমপান করা, অতিরিক্ত আমিষভোজী হওয়া, শারীরিকভাবে সক্রিয় না হওয়া, মানসিক চাপ এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহোল গ্রহণ করা সব কিছুই অকাল মৃত্যুর কারণ।

আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করেন, প্রায় নয় হাজার ব্যক্তি যারা ২৪ বছরব্যাপী গবেষণাকালে মারা যান, তাদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়। এদের মধ্যে শতকরা ২৮ ভাগ মারা যান ধূমপানজনিত কারণে।

শারীরিক নিস্ক্রিয়তায় ১৭ ভাগ, অতিরিক্ত ওজনের ফলে ১৩ ভাগ, খাদ্যাভাস যথাযথ না হওয়ায় ১৩ ভাগ এবং মদ্যপান করার কারণে শতকরা ৭ ভাগ লোক মারা যায়।

গবেষকরা এটাও বলেছেন, মাত্র পাঁচটি মৌলিক নিয়ম মেনে চললে শতকরা ৫৫ ভাগ মৃত্যু এড়ানো যায়। এসব নিয়ম হলো- ধূমপান না করা, নিয়মিত শরীর চর্চা করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া যেমনঃ সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ কমানো।

দীর্ঘায়ু লাভের বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত উপায়

অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন:

যদি আপনি বেশি দিন বাঁচতে চান, তাহলে অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস কমাতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা কম খায় তারা বেশি কর্মঠ এবং দীর্ঘায়ু হয়ে থাকে। জাপানের আদিবাসিরা তাদের ক্ষুধার ৮০% পর্যন্ত খায়। তারা কখনোই পেট ভরে খায় না। তাই জাপান আজ বিশ্বে অন্যতম উন্নত এবং পরিশ্রমি একটি জাতি। তাই পেট ভরে খাওয়া আজ থেকেই বাদ দিন।

বাদাম খান:

বাদাম হল পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস। বাদামে প্রোটিন, ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এছাড়া এটি কপার, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, ফোলেট, এবং ভিটামিন বি 6 এবং ভিটামিন “ই” এর মতো বেশ কয়েকটি ভিটামিন এবং খনিজ আছে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাদামের হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বিপাক সিনড্রোম, পেটের চর্বির স্তর এবং এমনকি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা রয়েছে।

হলুদ ব্যবহার করুন:

বার্ধক্যতা দূর করতে হলুদ একটি দুর্দান্ত উপকরণ। কারণ হলুদে কার্কুমিন নামক একটি শক্তিশালী যৌগ রয়েছে। অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য এর কারণে। কার্কিউমিন মস্তিষ্ক, হার্ট এবং ফুসফুস ভালো রাখার পাশাপাশি ক্যান্সার এবং বয়সজনিত রোগ থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। আয়ুর্বেদ অনুসারে হাজার হাজার বছর ধরে চিকিৎসায় হলুদের ব্যবহার হয়ে আসছে।

নিরামিষ ভোজী হন:

এটা সত্য যে নিরামিষ ভোজীরা আমিষ ভোজীদের তুলনায় বেশি দিন বাচেঁন। বিজ্ঞানীদের মতে, অধিক ফ্যাট সমৃদ্ধ আমিষ গ্রহণের ফলে ধমনীতে জাঙ্ক তৈরি হয়, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। নিরামিষ জাতীয় খাবার আমাদের শরীরে এই ধরণের সমস্যাগুলি হতে দেয় না বা এই ধরণের রোগগুলির সম্ভাবনাকে কম করে। অন্যদিকে যারা প্রচুর পরিমাণে সবজি ও ফলমূল গ্রহণ করেন তাদের শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস থাকে। এটি শরীরের বার্ধক্য মেরামত করতে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে ‘নিরামিষ জাঙ্ক ফুড’ ফ্যাট সমৃদ্ধ আমিষের মতই বিপজ্জনক।

শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন

শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা বা ব্যায়াম আমাদের সুস্থ রাখতে পারে এবং আমাদের জীবনে কয়েক বছর যোগ করতে পারে। প্রতিদিন ১৫ মিনিটের ব্যায়াম আমাদের আয়ু ৩ বছর বৃদ্ধি করতে পারে এবং অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ৪% কমে যেতে পারে। সাম্প্রতিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যেসকল ব্যক্তিরা ব্যায়াম করে তাদের অকাল মৃত্যুর ২২% কম ঝুঁকি রয়েছে।

অতিরিক্ত অ্যালকোহোল গ্রহন ও ধূমপান:

অতিরিক্ত অ্যালকোহোল কখনোই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। যারা দিনে তিন গ্লাসের অধিক অ্যালকোহোল পান করেন তাদের ব্যক্তিগত জীবন কখনোই সুখের হয় না। এটি আমাদের পারস্পারিক সম্পর্ক এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে মারাত্বক প্রভাব ফেলে। এতে হৃদরোগের ঝুকি রয়েছে। তাই অতিরিক্ত অ্যালকোহোল এড়িয়ে আমাদের স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা উচিত। এতে আমরা দীর্ঘ জীবন পেতে পারি। অন্যদিকে প্রতিবছর শুধুমাত্র ধূমপানের কারণে প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যায়। ধূমপান হচ্ছে- ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, দীর্ঘস্থায়ী ব্রঙ্কাইটিসসহ অন্তত ১৩ প্রকার ক্যান্সারের মূল কারণ। ধূমপান ত্যাগ করলে উক্ত রোগগুলোতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৯০ শতাংশে কম যাবে।

সুখকর কাজকে প্রাধান্য দিন:

হাসি, আনন্দ ও সুখী জীবন যাপন আমাদের দীর্ঘায়ু করতে পারে। সুখী ব্যক্তিদের মধ্যে ৫ বছর ধরে চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা সুখী তাদের মধ্যে অকাল মৃত্যুর হার ৩.৭% কম ছিল। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা কম সুখী তাদের তুলনায় প্রকৃতপক্ষে যারা সুখী তারা ১৮% পর্যন্ত বেশি বেঁচে থাকে।

দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ ও উদ্বেগ এড়িয়ে চলুন

উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ আমাদের আয়ু উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে পারে। যারা একটু রিলাক্স জীবন যাপন করে তাদের তুলনায় মানসিক চাপযুক্ত মানুষের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি তিনগুণ বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা যায় যে জীবন নিয়ে হতাশ ও উদ্বিগ্ন ব্যক্তিদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে আশাবাদী ব্যক্তিদের তুলনায় ৪২% বেশি অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। তবে, হাসি এবং জীবনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি উভয়ই মানসিক চাপ হ্রাস করতে পারে এবং আমাদের জীবনকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।

সামাজিক বন্ধন ধরে রাখুন:

সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন ভাল থাকলে তা আমাদের জীবনকে ৫০% বেশি দীর্ঘায়িত করতে পারে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ভাল সামাজিক বন্ধন অটুট থাকলে আমাদের হার্ট, মস্তিস্ক, হরমোন, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদির ইতিবাচক পরিবর্তন আনে যা দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে।

কফি এবং চা:

কফি এবং চা দুটিই দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমায়। গ্রিন টিতে পলিফেনল এবং ক্যাটচিন রয়েছে যা ক্যান্সার, ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। একইভাবে, কফি টাইপ 2 ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, ক্যান্সার এবং মস্তিষ্কের অসুস্থ্যতার ঝুঁকি হ্রাস করে। যে সব লোকেরা কফি এবং চা পান করেন না তাদের তুলনায় যারা কফি এবং চা পান করেন তাদের ২০-৩০% কম মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। তবে অত্যধিক ক্যাফিন গ্রহণ করলে ঘুম কমে যেতে পারে। তাই দিযে ৪ কাপের বেশি খাওয়া যাবে না।

পর্যাপ্ত ঘুমান

বেশি দিন বাচঁতে হলে একটানা দীর্ঘদিন কম না মঘুমিয়ে দৈনিক টানা কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। কোষের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ এবং সুন্দর দেহ গঠনে সহায়তা করার জন্য ঘুম গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় জানা গেছে যে, দীর্ঘায়ুত্বে নিয়মিত ঘুম যেমন প্রতিদিন একই সময়ে বিছানায় যাওয়া এবং প্রতিদিন একই সময় জেগে ওঠা। প্রতি রাতে ৫-৭ ঘন্টারও কম ঘুমানো অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি ১২% বেশি। প্রতি রাতে ৮-৯ ঘন্টা ঘুমানো অকাল ৩৮% পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। খুব কম ঘুম ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ এবং স্থূলত্বের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

গান শুনুন, বাগান করুন, মাঝে মাঝে প্রকৃতির কাছা-কাছি যান, ঘুরতে যান এক কথায় মন যেটা চাই। যেটা করলে আপনার মন ভালো থাকে সেটা করার চেষ্টা করুন। এবং উপরের কথা গুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন।