ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে কোন খাবারগুলি।

ডায়াবেটিস (diabetes) একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। যখন অগ্ন্যাশয় আর ইনসুলিন তৈরি করতে সক্ষম হয় না বা যখন শরীর তার উৎপাদিত ইনসুলিনের ভাল ব্যবহার করতে পারে না তখন তাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। আমরা যেসব খাবার খাই সেসব খাবার থেকেই গ্লুকোজ পেয়ে থাকি।

ইনসুলিন একটি হরমোন যেটা অগ্ন্যাশয় (pancreas) থেকে উৎপন্ন হয়। এই ইনসুলিন খাবার থেকে প্রাপ্ত গ্লুকোজকে ভেঙে শক্তি উৎপন্ন করে যা, আমাদের শরীরের কোষ দ্বারা ব্যবহৃত হয়।

যখন আমাদের শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, গ্লুকোজ তখন আমাদের রক্তে থাকে এবং আমাদের কোষেও পৌঁছায় না। রক্তে খুব বেশি গ্লুকোজ থাকা স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

ডায়াবেটিসের প্রধানত তিন প্রকার রয়েছে:

  • টাইপ-1
  • টাইপ-2 এবং
  • গর্ভকালীন

বর্তমানে গবেষণা করলে দেখা যায় যে, প্রতেকটি ঘরে অন্তত একজন করে সুগারে (ডায়াবেটিস) আক্রান্ত রোগী আছে। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না।

এটি এমন একটি রোগ যা মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। ডায়াবেটিস বেড়ে গেলে যেমন আমাদের নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় আবার একেবারে কমে গেলেও কিন্তু বিপদ। তাই আমাদের উচিত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা।

ডায়াবেটিস হলে কোন খাবারটা খাব কোনটা খাব না তা নির্ধারণ করা একটু কঠিন হতে পারে। মূল লক্ষ্য হল রক্তে শর্করার মাত্রা ভাল-নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে এমন খাবার খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ যা ডায়াবেটিস জনিত সকল ধরণের জটিলতা রোধ করতে সহায়তা করতে পারে। এরকম কয়েকটি খাবার নিচে দেওয়া হলো-

রসুন:

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রসুন খুবই কার্যকরী উপাদান। রসুন ইনসুলিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে এবং ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটি টাইপ-2 ডায়াবেটিস ব্যক্তিদের মধ্যে রক্তে শর্করার এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা হ্রাস করতে পারে।

শাকসবজি:

শাকসবজি অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং এতে ক্যালোরির পরিমাণ খুবই কম। পালং শাক, কলমি শাক ও অন্যান্য শাকসবজি ভিটামিন “সি” সহ বেশ কয়েকটি ভিটামিন এবং খনিজ এর উৎস। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভিটামিন “সি” গ্রহণের ফলে টাইপ-2 ডায়াবেটিস ব্যক্তিদের রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে।

দারুচিনি:

দারুচিনি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়াকলাপ সহ একটি সুস্বাদু মশলা। বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে দারুচিনি রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করতে পারে এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করতে পারে। দারুচিনি টাইপ-2 ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা, কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের স্তর উন্নত করতে পারে।

আপেল সিডার ভিনেগার:

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি ঘটে। এই রোগের কারণে শরীর প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না, তাই রক্তে দেখা দেয় উচ্চমাত্রার চিনির উপস্থিতি।

টাইপ-2 ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য আপেল সিডার ভিনেগার খুবই উপকারী। টাইপ-2 ডায়াবেটিস ইনসুলিন তৈরির অক্ষমতার কারণে হয়। ৫ জন সুস্থ লোকের একটি ছোট্ট সমীক্ষায় দেখা গেছে ৫০ গ্রাম সাদা রুটির সাথে ভিনেগার খাওয়ার ফলে রক্তে সুগার ৩১.৪% হ্রাস পেয়েছিল।

ওমেগা-3 সমৃদ্ধ মাছ:

ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড মাছ অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিড DHA এবং EPA এর দুর্দান্ত উৎস, যা হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়। যেসব ডায়াবেটিস রোগীদের যাদের হার্টের রোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি রয়েছে তাদের জন্য নিয়মিত ওমেগা-3 সমৃদ্ধ মাছ খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

মটরশুটি:

মটরশুটিতে বেশ কয়েকটি উপাদান রয়েছে যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। প্রথমত, তুলনামূলকভাবে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) রয়েছে, যা খাবার খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার পরিমাণ কত দ্রুত বেড়ে যায় তার পরিমাপ করে।

ডায়েটে যেসব খাবারে নিম্ন-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) সে সব খাবার রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া মটরশুটির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং প্রোটিন রয়েছে, যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে উপকারী। কারণ ফাইবার কার্বস শোষণের হারকে ধীর করে দেয় যা রক্তের শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে।

অ্যাভোকাডো:

অ্যাভোকাডোতে চিনি কম থাকে, উচ্চ ফাইবারযুক্ত এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকে। তাই অ্যাভোকাডো রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করে না। অ্যাভোকাডো ডায়াবেটিস প্রতিরোধে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, অ্যাভোকাটিন বি (avocatin B) শুধুমাত্র অ্যাভোকাডো থেকে পাওয়া ফ্যাট।

অ্যাভোকাটিন বি পেশী এবং অগ্ন্যাশয়ের অসম্পূর্ণ জারণকে বাধা দেয় যা ইনসুলিন প্রতিরোধের হ্রাস করে। তবে অ্যাভোকাডো ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কার্যকরী এই কথা আরও জোরালো করতে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

ডিম:

ডিম খুবই স্বাস্থ্যকর একটি খাবার। দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরিয়ে রাখার জন্য সেরা খাবারগুলির মধ্যে ডিম একটি। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাইপ-2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাই-প্রোটিন ডায়েটের খাবার হিসাবে প্রতিদিন ২ টি ডিম খেলে কোলেস্টেরল এবং রক্তে শর্করার মাত্রায় উন্নতি ঘটে। ডিম হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়, রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ রাখে।

হলুদ:

হলুদ শক্তিশালী একটি মশলা। এর সক্রিয় উপাদান, কারকুমিন রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে। কারকুমিন ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনির জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। কিডনির সমস্যা ডায়াবেটিস রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। হলুদে কার্কিউমিন রয়েছে যা রক্তে শর্করার মাত্রা, প্রদাহকে হ্রাস করতে পারে এবং হার্ট ও কিডনির রোগ থেকে রক্ষা করে।

টক দই:

টক দই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য একটি ভালো খাবার। এটি রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ করতে এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে টক দই এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবারগুলি টাইপ-2 ডায়াবেটিসযুক্ত ব্যক্তিদের ওজন কমাতে পারে।

বাদাম:

বাদাম সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর একটি স্ন্যাক্স। বাদামে হজমযোগ্য কার্বহাইড্রেট কম থাকে এবং রক্তে শর্করার, ইনসুলিন এবং খারাপ কলেস্টেরলের (LDL) মাত্রা হ্রাস করতে সহায়তা করে।

সব ধরণের বাদামে উচ্চ পরিমাণে ফাইবার থাকে এবং কার্বস কম থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, নিয়মিত বাদাম গ্রহণের ফলে প্রদাহ এবং রক্তের শর্করার হ্রাস করতে সহায়তা করে।

টাইপ-2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত লোকেদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাদাম খাওয়া (যেমন আখরোট, চীনাবাদাম, পেস্তা) তাদের মধ্যে হার্টের রোগ হওয়া ও মৃত্যুর সম্ভাবনা কমায়।

ব্রকলি:

বর্তমানে গবেষণা করলে দেখা যায় যে, প্রতেকটি ঘরে অন্তত একজন করে সুগারে আক্রান্ত রোগী আছে। সুগার বেড়ে গেলে যেমন সমস্যা আবার একেবারে কমে গেলেও কিন্তু বিপদ। তাই দরকার নিয়ন্ত্রনে রাখা। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ পরিমাণে ডায়াটারি ফাইবার রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। ব্রকলি ফাইবারের একটি ভালো উৎস। ব্রকলিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ফাইবার রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে।

স্ট্রবেরি:

স্ট্রবেরি খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর একটি ফল। এতে অ্যান্টোসায়ানিনস নামে একধরনের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট রয়েছে। স্ট্রবেরি কোলেস্টেরল এবং ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাস করতে পারে। এটি টাইপ-2 ডায়াবেটিস এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। যেকোন টক জাতীয় ফলই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।

করলা:

গবেষণায় দেখা গেছে, করলার মধ্যে এমন উপাদান রয়েছে যা অ্যান্টি-ডায়াবেটিক এবং ইনসুলিন ইনজেকশনের থেকেও বেশি কার্যকর। ডাক্তারদের মতে, কাঁচা করলা বা করলার রস নিয়মিত খেতে পারলে ডায়াবেটিসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন।

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের জটিলতা অনেক। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে অতিসত্বর ডাক্তারের পরামর্শ নিন।