গোলাপ চা প্রাকৃতিকভাবে ক্যাফিন মুক্ত, মাসিকের ব্যথা কমাতে পারে ও মানসিক চাপ এবং হতাশা দূর করে।

গোলাপকে ফুলের রানী বলা হয়। গোলাপ দেখতে যতটাই সুন্দর ততটাই মনোমুদ্ধকর এর ঘ্রাণ।

প্রাচীনকাল থেকে নানান প্রেমের গল্প, কবিতা এবং জীবনের সব ধরণের শৈল্পিক ও সৃষ্টিশীলতায় গোলাপ ফুল অবধারিত ভাবে তার জায়গা করে নিয়েছে। গোলাপ তার সৌন্দর্য ও সুগন্ধ দিয়ে মানুষের মন কেড়ে নিয়েছে বারবার।

ফুল মানে নম্রতা, হৃদয়ের পবিত্রতা, সৌন্দর্য, সম্পদ, মর্যাদা, আভিজাত্য, নিরপরাধতা এবং বিশুদ্ধতা। ফুল এমন একটি জিনিস যার রং, রূপ, গন্ধ আমাদের মন ভালো করে দেয়। কিছু ফুল আছে ভক্ষণযোগ্য এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

গোলাপ ফুল আপনাকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কত রকমের উপকার দিতে পারে। প্রাচীনকাল থেকেই স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্যও গোলাপের চর্চা হয়ে আসছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই গোলাপ ফুল খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। গোলাপের পাপড়ি হোক বা কুড়ি সবই খাদ্য গুণে ভরপুর।

প্রায় ১০০ প্রজাতির বিভিন্ন বর্ণের গোলাপ ফুল (Rose) রয়েছে। গোলাপের চা কিন্তু একটি অসাধারণ পুষ্টিকর পানীয়।

গোলাপ চা আলসার, অ্যাজমা, ডিহাইড্রেশন সহ বিভিন্ন রোগ নিরাময় করতে সহায়তা করে। গোলাপ চা পিত্তথলি ও যকৃতকে ভালো রাখে। এছাড়া গোলাপ চা ওজন কমাতে সাহায্য করে।

ওজন কমাতে চাইলে গোলাপ চা প্রতিদিনের ডায়েটে যোগ করার জন্য অন্যতম সেরা ভেষজ চা। তবে, এটি চায়ের একমাত্র স্বাস্থ্য উপকার নয়।

এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি করতেও সহায়তা করে এবং হজমের পক্ষেও ভাল। গোলাপের গন্ধ আমাদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে এটি একটি স্ট্রেস বুস্টার এবং মেজাজ-বর্ধকও।

ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন চারটি প্রজাতির গোলাপ নিরাপদ হিসাবে স্বীকৃতি দেয় R. alba (White rose), R. centifolia (Cabbage rose), R. damascena (Damask rose), and R. gallica (French rose). ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষধে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় Rosa rugosa ব্যবহৃত হয়।

গোলাপ চা কিভাবে তৈরি করবেন

বাড়িতে খুব সহজেই প্রস্তুত করা যায় গোলাপ চা। গোলাপ চা তৈরির জন্য যে পাপড়ি বেছে নেয়া হবে তা যেন অবশ্যই কীটনাশক মুক্ত হয়। নিজের গাছের গোলাপ হলে নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারবেন।

আর যদি কেনা গোলাপ হয় তাহলে বাইরের দিকের পাপড়ি ব্যবহার না করে একদম ভেতরের পাপড়ি ব্যবহার করুন। ব্যবহারের আগে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।

তাজা ও শুকনো পাপড়ি দিয়ে চা তৈরি করা যায়। গোলাপের তাজা পাপড়ি পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে বয়ামে ভরে রেখে দিতে পারেন।

২ কাপ ধোয়া গোলাপের পাপড়ি। ২ কাপ ধোয়া গোলাপের পাপড়ি ৩ কাপ পানি দিয়ে প্রায় ৫ মিনিট ধরে জ্বাল দিন। জ্বাল হয়ে গেলে কাপে ছেঁকে নিন এবং স্বাদের জন্য এক টেবিল চামচ মধু দিতে পারেন।

গোলাপ চায়ের উপকারিতা

আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক, গোলাপ ফুলের চায়ের উপকারিতা সম্পর্কে-

মাসিকের ব্যথা কমাতে পারে:

গোলাপ চা ঋতুস্রাবের সময় পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, পিঠে ব্যথা, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা কমাতে সহায়তা করে। গোলাপ চা ঋতুস্রাবের ব্যথা চিকিৎসার জন্য ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষধে ব্যবহার করা হয়েছে।

তাইওয়ানের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পিরিয়ডের ১ সপ্তাহ আগে প্রতিদিন ২ কাপ গোলাপ চা পান করায় পেটে ব্যথা কম অনুভব করেছিল।

মানসিক চাপ এবং হতাশা দূর করে:

হতাশা এবং মানসিক চাপ সাধারণত আসে অনিদ্রা এবং বিশ্রামহীনতার অভাবে। গোলাপের পাপড়ি এবং এর চা এই ধরনের সমস্যা দূর করনে কার্যকরি।

গোলাপ চায়ের দারুণ মিষ্টি গন্ধে মানসিক চাপ কমে হয় এবং মন ভালো থাকে।

ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে:

গোলাপের পাঁপড়িতে ৯৫% পানি আছে। তাই এর ক্যালোরি কাউন্ট অত্যন্ত কম। এছাড়া গোলাপের পাপড়িতে বিদ্যমান যৌগ মেটাবলিজমকে উন্নত করে এবং শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয় যা ওজন কমাতে খুবই কার্যকরি।

এক গ্লাস গরম পানিতে ১০-১৫টি গোলাপের পাপড়ি ছেড়ে দিন এবং অপেক্ষা করুন যতক্ষন পর্যন্ত পানি গোলাপি রং ধারন না করে।

এর মধ্যে আপনি সামান্য পরিমাণ মধু এবং এক চিমটি দারুচিনি গুড়া মিশিয়ে নিন। এই পানি পান করুন প্রতিদিন সকালে যা আপনার দেহের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে সাহায্য করবে।

পানিশূন্যতা দূর করে:

গোলাপ চাতে পানি বেশি থাকে। এই কারণে, প্রতিদিন এক বা একাধিক কাপ পান করা আপনার মোট পানি পানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান না করলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে, যা ক্লান্তি, মাথাব্যথা, ত্বকের সমস্যা, পেশী বাধা, নিম্ন রক্তচাপ এবং দ্রুত হার্ট রেট হতে পারে।

পানি বিপাকীয় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ওজন হ্রাসে সহায়তা করতে পারে। এছাড়া পানি পরিপূর্ণতা বোধ করে এবং ক্যালোরি গ্রহণ হ্রাস করে ওজন কমাতে পারে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ:

অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এমন যৌগ যা ফ্রি র‌্যাডিকালের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে। ফ্রি র‌্যাডিকাল সেলুলার ক্ষতির কারণ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের দিকে পরিচালিত করে। গোলাপ চাতে পলিফেনল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে।

পলিফেনল সমৃদ্ধ ডায়েট নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সার, হার্টের রোগ এবং টাইপ-2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করার পাশাপাশি মস্তিষ্ককে অনেক ধরণের রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, গোলাপ চাতে গ্রিন টি এর সমান বা তার বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়াকলাপ রয়েছে।

গোলাপ চা বিশেষত গ্যালিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এই অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যৌগটি চায়ের মোট ফিনোল (phenol) সামগ্রীর ১০-৫৫% অবদান রাখে এবং অ্যান্টিক্যান্সার, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যানালজেসিক প্রভাব হিসাবে পরিচিত।

চাটি অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ, যা মূত্রনালী এবং চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, উন্নত মেমরি, স্বাস্থ্যকর বয়স এবং কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়

হজমশক্তি বর্ধন:

শরীরে জন্য হজমশক্তি বর্ধক হিসেবে কাজ করে গোলাপ চা। ওজন কমানোর জন্য পরিপাকতন্ত্র ঠিকমতো কার্যকর রাখা জরুরি।

এই চা আপনার পাচনতন্ত্রে ভাল ব্যাকটিরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়ারোহিয়ার হার্বাল প্রতিকার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

প্রাকৃতিকভাবে ক্যাফিন মুক্ত:

কফি, চা এগুলিতে ক্যাফিন থাকে। যদিও ক্যাফিন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তারপরও এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ক্যাফিন রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে এবং কিছু লোকের মধ্যে উদ্বেগের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।

গোলাপ চা প্রাকৃতিকভাবে ক্যাফিন মুক্ত। গোলাপ চা বানাতে আপনি গোলাপের তাজা পাঁপড়ি ব্যবহার করতে পারেন আবার শুকিয়ে সংরক্ষন করতে পারেন।

ত্বকের সুরক্ষায়:

গোলাপের পাপড়ি ত্বকের যত্নে খুবই কার্যকর। গোলাপের সুগন্ধ ত্বককে সতেজ করে। এতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা ফ্রি র‌্যাডিকেলসের ক্ষতি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। বিভিন্ন দূষণ, জীবাণু ও ইরিটেশন থেকে ত্বককে রক্ষা করে।

এক চা চামচ গোলাপের পাপড়ি বাটা বা গুঁড়োর সঙ্গে পরিমাণমতো পানি ব্যবহার করে লাগালে ত্বক সজীব হয়ে উঠবে। পানির বদলে মধুও ব্যবহার করা যেতে পারে।

এছাড়া ত্বকের সুরক্ষায় গোলাপ জল অনেক উপকারী বিশেষ করে সেনসিটিভ ত্বকের রুক্ষতা দূর করতে, ত্বকের তৈলাক্ততা সমাধানে, ত্বককে সফট করতে খুবই কার্যকরি।

ব্যথানাশক হিসেবে:

গোলাপে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই গোলাপ চা ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে।

টক্সিন অপসারণে সহায়তা করে:

গোলাপ চা এর ডিটক্স এবং মূত্রবর্ধক বৈশিষ্ট্যের কারণে মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধ করতে সহায়তা করতে পারে। মূত্রবর্ধক বৈশিষ্ট্যের কারণে মূত্রনালীর সংক্রমণ রোধ করে লিভার ডিজিজের চিকিৎসা করতে পারে।

ত্বকের জন্য ভাল:

ভিটামিন “এ” এবং ভিটামিন “ই” তে পূর্ণ গোলাপ চা। গোলাপের পাপড়ি ভিটামিন “সি” এর একটি ভাল উৎস, এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যের জন্যও পরিচিত।

সুগন্ধযুক্ত গোলাপ চা পান করা ইমিউন সিস্টেমের সহায়তা করে এবং স্বাস্থ্যকর ত্বক এবং চুলের জন্য প্রোটিন, কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে।

গোলাপ চা ত্বকের যত্নের একটি নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক সমাধান। প্রতিদিন চেহারা উন্নত করতে এবং বার্ধক্যজনিত লক্ষণগুলি হ্রাস করতে গোলাপ চা পান করতে পারেন।

সতর্কতা:

আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই খাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

রেফারেন্স: