উপবাস বা উপোস থাকার উপকারিতা।

উপবাস একটি অনুশীলন যা বহু শতাব্দী পূর্ববর্তী এবং বহু সংস্কৃতি ও ধর্মে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সমস্ত বা কিছু খাবার বা পানীয় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখাই উপবাস। আপনি বিভিন্ন ভাবে উপবাস করতে পারেন।

সাধারণত, বেশিরভাগ ধরণের উপবাস ২৪-২৫ ঘন্টা ধরে করা হয়। উপবাস ওজন হ্রাস থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের উন্নতিতে কার্যকারি ভূমিকা রাখে।

এখনকার দিনে তিরিশে পৌঁছেই গড়পরতা একজন যত না ফিট থাকেন, তার চেয়ে অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত অনেক সুস্থ জীবন কাটিয়ে গিয়েছে যারা উপবাস করতেন। কারণ এই উপবাস থাকার অনেক উপকারিতা রয়েছে।

বিজ্ঞানের দ্বারা সমর্থিত উপবাস থাকার কয়েকটি স্বাস্থ্য উপকারিতা নিচে দেওয়া হলো-

ওজন কমাতে সাহায্য করে:

ওজন কমানোর অন্যতম নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হল উপোস করা। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা উপোস করলে অনেক বেশি ক্যালোরি ক্ষয় হয়।

এনার্জির জন্য শরীর ফ্যাট সেলগুলোকে ভেঙে দেয়। এমনকি নিয়মিত ডায়েটিং করার থেকেও ক্যালোরি ক্ষয়ের জন্য মাঝেমধ্যে উপোস অনেক বেশি কার্যকরী।

যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে:

উপোসর ফলে হজম ক্ষমতা আরও ভালো হয়। উপোস ভঙ্গের পর আমরা যা খাই, তার থেকে পুষ্টি সহজেই শরীরে শোষিত হয়।

শরীর ঠিকমতো পুষ্টি পাওয়ায় বার্ধক্যের ছাপ দেরিতে পড়ে।

হার্টের জন্য উপকারী:

মাঝে মধ্যে উপোস করলে তা রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায়। আপনি আপনার ডায়েট এবং জীবনযাত্রার মান স্বাস্থ্যকর রাখার মাধ্যমে হার্টের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেন।

একটি ছোট্ট গবেষণায় দেখা গেছে যে উপবাসের ফলে “খারাপ” LDL কোলেস্টেরল এবং রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড যথাক্রমে ২৫% এবং ৩২% হ্রাস পেয়েছে।

রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাছাড়া ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি লিপোপ্রোটিনের ঘনত্ব কমায়। এই দুটি উপাদানই বিভিন্ন হার্টের রোগের ঝুঁকির কারণ।

ইনসুলিনের ক্ষমতা বাড়ায়:

বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে উপবাস রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণকে উন্নত করতে পারে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষত কার্যকর।

টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে স্বল্প-মেয়াদী উপবাস রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে

নির্দিষ্ট সময়সীমার উপোস শরীরে ইনসুলিনের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এর ফলে শরীরে কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের ক্ষমতা অনেকটাই বাড়ে।

পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে উপোসের পর ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়ে ও শরীরের কোষগুলি রক্ত থেকে অনেক বেশি পরিমাণে গ্লুকোজ সংগ্রহ করতে পারে।

ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে ও রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে আনতে সহায়তা করে। এতে করে নানা ধরনের রোগের ঝুঁকিও কমে আসে।

ক্ষুধা বৃদ্ধি করে:

একবার ভাবুন তো, ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা অন্তর খাবার খেলে কখনও ঠিকমতো ক্ষিদে অনুভব করতে পারেন কি? নিশ্চয় নয়।

১২ বা ২৪ ঘণ্টার উপোস রাখলে ক্ষিদের অনুভূতি শক্তিও বাড়ে। এর ফলে শরীরে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় হরমোন সঠিক ভাবে ক্ষরণ হয়।

ত্বক পরিস্কার করে:

উপোসের ফলে শরীর থেকে বেশি পরিমাণে ক্ষতিকর টক্সিন বেরিয়ে যাওয়ায় ত্বক পরিস্কার হয়। লিভার, কিডনির কাজ আরও ভালো হওয়ায় ত্বকে দাগছোপ, ব্রন নির্মূল হয়।

খাওয়ার ধরণ উন্নত করে:

মাঝেমধ্যেই টুকটাক মুখ চালানোর অভ্যাস থাকলে, মাঝেমধ্যে উপোস আপনার সেই বদ অভ্যাস ছাড়িয়ে দিতে পারে।

যেমন, আপনি যদি বিকেলে অনেক কিছু খেয়ে ফেলেন, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই রাতে খাবার খেতে দেরি হবে।

রাত করে খেলে তা হজম ক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে। কিন্তু বিকেল থেকে সন্ধের কয়েক ঘণ্টা উপোস দিলে, সহজেই রাতে আপনার খিদে পাবে।

মস্তিষ্কের জন্য ভালো:

পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে উপোসর ফলে মস্তিষ্কের ক্রিয়া আরও উন্নত হয়। উপোসর মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়িয়ে তুলতে এবং নিউরোডিজেনারেটিভ ডিসঅর্ডারগুলি রোধ করতে পারে।

বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে উপবাস মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে।

১১ মাস ধরে মাঝে মাঝে উপবাস করায় মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং মস্তিষ্কের কাঠামো উভয়ই উন্নত হয়।

এছাড়া নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা উপোস দিলে নিউরোট্রফিক নামে বিশেষ প্রোটিন অধিক উত্‍পন্ন হয়। এই প্রোটিন মস্তিষ্ককে আরও সজাগ করে তুলতে সাহায্য করে।

শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:

উপোসের ফলে শরীর থেকে বেশি মাত্রায় টক্সিন বেরিয়ে যায়। ফলে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিক্যাল কম উত্‍পন্ন হয়।

ফ্রি-রেডিক্যাল কমে যাওয়ায় শরীরের প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়ে। এমনকি নিয়মিত উপোসে শরীরে মরণঘাতি ক্যান্সারের বাসা বাঁধার সম্ভাবনাও কমে।

মনঃসংযোগে সাহায্য করে:

উপোসের পর অনেক সময়ই শরীর ও মন বেশি একাগ্র হয়ে ওঠে। এই কারণেই সম্ভবত পুজোর আগে উপোস থাকা রীতি রয়েছে। যাতে ঈশ্বরের পুজার্চনায় অধিক মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে।

প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে:

দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ আপনার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে। গবেষণা দেখায় যে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের কারণে হতে পারে হার্টের রোগ, ক্যান্সার এবং রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, উপবাস প্রদাহের মাত্রা হ্রাস করতে। ৫০ স্বাস্থ্যকর প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, উপবাস প্রদাহ চিহ্নিতকারীর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

হরমোন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে:

হরমোন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, যা বৃদ্ধি, বিপাক, ওজন হ্রাস এবং পেশী শক্তি জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হিউম্যান গ্রোথ হরমোন (HGH) এক ধরণের প্রোটিন হরমোন যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম।

বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে উপবাস স্বাভাবিকভাবেই HGH স্তর বাড়িয়ে তুলতে পারে।

১১ জন স্বাস্থ্যকর প্রাপ্ত বয়স্কদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ২৪ ঘন্টা উপবাসের ফলে HGH এর মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

অনেক রকম উপকারিতা থাকলেও হুট করে উপোস শুরু না করাই ভাল। টানা বেশ কয়েক ঘণ্টা কিছু না খেয়ে থাকার আগে কয়েকটি সাবধানতা নেওয়া জরুরি। পুরোপুরি উপোস না করেও, যেগুলি করা যেতে পারে –

  • পুরোপুরি না খাওয়ার বদলে মাঝেমধ্যে শুধু ফল খেয়ে দিন কাটান।
  • একদিন শুধু শাকসবজি খেয়ে থাকুন।
  • ফল বা সবজি থেকে তৈরি স্মুদি খেয়ে এক দিন কাটান।
  • সবজি বা ফলের রস খেয়ে একদিন থাকুন।
  • একদিন শুধু স্যালাদ খেয়ে থাকুন।
  • রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সারুন। পরদিন সকালে দেরি করে ব্রেকফাস্ট করুন। যাতে ডিনার ও ব্রেকফাস্টের মাঝে ১৬ ঘণ্টার গ্যাপ থাকে।

উপবাস কি চর্বি কমাতে পারে?

হ্যাঁ উপবাস চর্বি কমাতে পারে। কিছু গবেষণা দেখায় যে, মাঝে মাঝে উপবাস থাকার ফলে ৬-২৪ সপ্তাহের মধ্যে পেটের চর্বি ৪-৭% হ্রাস পেয়েছিল।

একটি পর্যালোচনা অনুসারে, উপবাসের ফলে ৩-২ সপ্তাহের মধ্যে শরীরের ওজন ৮% পর্যন্ত হ্রাস এবং শরীরের মেদ ১৬% পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছিল।

রেফারেন্স: