লাউ শরীর ঠান্ডা রাখে, মূত্রবর্ধক, হজমকারক ও হার্টের বন্ধু।
বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় প্রতিটি রান্না ঘরে পাওয়া যাবে “লাউ” নামক সবজিটি। আফ্রিকা-এর উৎপত্তিস্থল হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলিতে এটির বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
বাংলাদেশে লাউ বা কদু, ইংরেজিতে “bottle gourd” হিন্দিতে “লাউকি” এবং তামিল ভাষায় “সোরাকাই” নামে পরিচিত। এই লাউ পশ্চিমা বিশ্বে তেমন জনপ্রিয় নয়।
Cucurbitaceae -পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই ফলটি Lagenaria গোত্র বা শ্রেণীর। বৈজ্ঞানিক নাম: Lagenaria siceraria।
লাউ একটা খুব ভালো ডিটক্সিফায়ার যা নাক থেকে রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করে ও ত্বকে কোনও রকম ফুসকুড়ি বা আলসার হতে দেয় না। শরীর থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ সরিয়ে দিতে সহায়তা করে ডিটক্সিফায়ার।
এতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম রয়েছে যা আমাদের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে ও শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
গরমকালে আমরা খুব ঘামি বলে আমাদের শরীর থেকে পানির সঙ্গে ইলেক্ট্রোলাইট বেরিয়ে যায় তাই লাউ খেলে ক্লান্তি দূর হয়।
শীতের সকালে গরম ভাতের সঙ্গে লাউ আর আলু দিয়ে শোল মাছের ঝোল খেতে কি যে ভালো লাগে তা বলে বোঝানো যাবে না।
শুধু শোল কেন, কৈ, শিং, মাগুর, ট্যাংরা ইত্যাদি আরো অনেক মাছ দিয়ে খেতে লাউয়ের কোনো তুলনা হয়না।
বাংলার আর একটি বিখ্যাত খাবার ঘুসো চিংড়ী বা ছোট্টো চিংড়ি ও কচি লাউ।
লাউ ঘন্ট (কুমড়োবড়ি, চিংড়ি মাছ ও টমেটো )-কোনটা রেখে কোনটা বলবো। মজাদার এসব খাবার থেকে নিজেকে কন্ট্রোল করা কঠিন।
রস করে খান তাহলে ওষুধের মতো কাজ করবে
রান্না না করে এই সবজিটি রস করে খান। লাউয়ের রস সবাই খেতে পারেন, বিশেষ করে যাঁরা ডায়াবেটিসে ভোগেন তাঁদের জন্য তো লাউয়ের রস খুব উপকারী।
কারণ এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ কম করে ও রক্তচাপের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
কীভাবে বানাবেন
লাউয়ের ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে কেটে ব্লেন্ডারে দিয়ে রস করে নিন। এবার এর সঙ্গে একটু গোলমরিচ, পরিমাণ মতো লবণ ও পুদিনা পাতা মিশিয়ে নিন।
এর সঙ্গে চা-চামচের এক চামচ আদাবাটা যোগ করুন। শেষে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস যোগ করতে পারেন।
দৈহিক পরিশ্রমের পর লাউয়ের রস খেলে উপকার হয়। কারণ, কোনও দৈহিক পরিশ্রমের পর আমাদের শরীরে গ্লুকোস ও কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কম হয়ে যায় সেটাকে আবার ঠিক করতে সাহায্য করে।
এছাড়া শরীরে ইলেক্ট্রোলাইট ফেরায় লাউ।
লাউয়ের স্বাস্থ্য উপকারীতা
লাউয়ে রয়েছে অনেক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ যেমন: ভিটামিন “সি”, ভিটামিন “বি”, ভিটামিন “কে”, ভিটামিন “এ”, ভিটামিন “ই”, আয়রন, ফোলেট ও ম্যাঙ্গানিজ।
আমরা অনেকেই এটা হয়ত জানি না যে লাউতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন “সি” রয়েছে।
২৫০ গ্রাম লাউ থেকে আমরা ২৫ এমজি ভিটামিন “সি” পাই, আমাদের সারা দিনে যতখানি ভিটামিন “সি” লাগে তার প্রায় অর্ধেক। নিচে লাউয়ের কিছু গুরত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য উপকারীতা দেওয়া হলো –
ওজন কমে ও অন্ত্র ঠিক রাখে:
যেহেতু লাউ খুব সহজে হজম হয়ে যায় তাই গরমকালে যখন আমাদের পাচনতন্ত্র একটু দুর্বল থাকে তখন লাউ খেলে তা খুব সহজেই হজম হয় যায়।
লাউয়ে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় ফাইবার আছে বলে সবজিটি হজমে সহায়তা করে। তাই লাউ খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, গ্যাস-অম্বল দূর করতে সাহায্য করে ও অর্শ সারায়।
লাউয়ে পানি ও ফাইবার মাত্রা বেশি থাকে বলে এটা আমাদের পাচনতন্ত্র ও অন্ত্র ঠিক রাখে।
বেশ কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, যে কোনও ভাবেই হোক, তা তরকারি বানিয়ে অথবা রস হিসেবে, লাউ খাওয়া শুরু করলে শরীরে ফাইবারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
ফলে খিদে কমে যায়। সেই সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কমে খাওয়ার পরিমাণও। আর কম খেলে ওজন যে দ্রুত কমে, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে।
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে ও মন-মেজাজ ভালো রাখে:
অনেককেই হয়ত বিশ্বাস করবেন না যে লাউ শরীরকে ঠান্ডা করে ও আরাম দেয়। মস্তিস্ক সতেজ রাখে তাই মানসিক অস্থিরতা, বিষণ্ণতা ও অন্যান্য কোনও মানসিক চঞ্চলতা হয় না।
মস্তিস্ক সতেজ রাখতে ও মনমেজাজ ভালো রাখতে লাউয়ের মতো সবজির তুলনা হয় না।
লাউয়ে রয়েছে কোলিন নামক এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যা শরীরে প্রবেশ করা মাত্র মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্ট্রেস লেভেল তো কমেই। সেই সঙ্গে ডিপ্রেশনসহ একাধিক মেন্টাল ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও যায় কমে।
ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে ও হার্ট ভালো রাখে:
লাউয়ে ভিটামিন “সি” রয়েছে। ভিটামিন “সি”-তে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে সেটা রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা ঠিক রাখে।
উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের ডায়েটে লাউ দিয়ে তৈরি কোনও না কোনও পদ থাকা জরুরি!
কারণ এতে রয়েছে এমন কিছু পুষ্টিকর উপাদান, যা রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আর রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকলে হার্টের স্বাস্থ্যও ভাল হয়ে ওঠে। আর হার্ট যখন চাঙ্গা হয়ে ওঠে তখন সার্বিকভাবে আয়ুও যে বৃদ্ধি পায়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে।
কনস্টিপেশন এবং নানাবিধ পেটের রোগের প্রকোপ কমে:
অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়ার কারণে বদ হজম এবং গ্যাস-অম্বল তো বাঙালির নিত্যদিনের সঙ্গী। তার উপর কনস্টিপেশনের মতো সমস্যা তো আছেই।
এমন পরিস্থিতিতে পেটকে চাঙ্গা করে তুলতে লাউয়ের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে।
কারণ লাউতে থাকা পানি এবং ফাইবার, হজম ক্ষমতার উন্নতি তো ঘটায়ই, সেই সঙ্গে কনস্টিপেশনের মতো রোগের প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
ইনসমনিয়া দূরে পালায়:
বেশ কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, বাজে খাদ্যাভ্যাসের কারণে সিংহভাগ বাঙালিরই ঠিক মতো ঘুম হয় না।
ফলে দিনের পর দিন এমনটা হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ইনসমনিয়া বা অনিদ্রার মতো সমস্যা ঘাড়ে চেপে বসে।
তাই আপনিও যদি এমন রোগে আক্রান্ত হতে না চান, তাহলে লাউয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে দেরি করবেন না।
কারণ একাধিক গবেষণায় এ কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে, নিয়মিত লাউ খাওয়া শুরু করলে, বিশেষত লাউয়ের রস, অনিদ্রার সমস্যা দূর হয়।
ফলে বিনিদ্র রাত্রি যাপনের আশঙ্কা আর থাকে না বললেই চলে। আয়ুর্বেদ মতে, তিলের তেল লাউয়ের রসের সাথে মিশ্রিত করে খেলে অনিদ্রার সমস্যা নিরাময়ে সহায়তা করে।
ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ে ও ব্রণ কমায়:
লাউ থেকে আমরা যে ভিটামিন “সি” এবং জিংক পাই তা ত্বকের অকাল বার্ধক্য ও কুঁচকে যাওয়াকে রোধ করতে সাহায্য করে। মস্তিষ্ক সচল রাখে এবং শরীরে কোলাজেন উৎপাদন করে।
কোলাজেন একটি প্রোটিন যা আমাদের শরীরের টিসুকে শক্তিশালী বানায়। লাউয়ে থাকে ভিটামিন “বি” যা চুলের অকালপক্ক্যতা রোধ করায় কার্যকরী। সেই সঙ্গে তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যাও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
এই কারণেই তো প্রতিদিন লাউয়ের রস বা এই সবজিটি দিয়ে তৈরি কোনও না কোনও খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত, লাউ খাওয়া শুরু করলে আরও বেশ কিছু উপকার মেলে।
যেমন ধরুন মাত্রতিরিক্ত ঘাম হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সেই সঙ্গে ব্রণের মতো ত্বকের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও আর থাকে না।
শরীর ঠাণ্ডা করে:
অনেক সময়ই শরীরের ভিতরের তাপমাত্রা বেশ বেড়ে যায়, যা একেবারেই ভাল নয়। তাই তো সপ্তাহে ২-৩ দিন নিয়মিত লাউয়ের রস খাওয়া উচিত!
আসলে এই সবজিটিতে যেমন রয়েছে প্রচুর মাত্রায় পানি, তেমনি রয়েছে প্রচুর পরিমাণ খনিজও, যা শরীরকে ঠাণ্ডা রাখার পাশাপাশি দেহের ভিতরে উপস্থিত ক্ষতিকর টক্সিক উপাদানদেরও বার করে দেয়।
ফলে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে। তেমনি দেহের ভিতরে তাপমাত্রা বা প্রাদাহ বাড়ার সম্ভাবনাও আর থাকে না।
ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশনের মতো রোগের প্রকোপ কমে:
বছরের এই সময়ে পরিবেশে নানাবিধ ক্ষতিকর জীবাণুর মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সংক্রমণের মতো রোগের প্রকোপ খুব বৃদ্ধি পায়।
বিশেষত মেয়েদের মধ্যে ইউরিনারি ট্রাক্ট ইফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যায়। যে কোনও ধরনের সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে লাউয়ের কোনও বিকল্প হয় না বললেই চলে।
শুধু তাই নয়, এই সবজিতে প্রচুর মাত্রায় পানি থাকার কারণে এটি খেলে প্রস্রাব খুব ভাল হয়, ফলে ‘ইউ টি আই’ এর মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা এমনিতেই অনেকটা কমে যায়।
লাউ অতিরিক্ত পিত্ত বেরোনো বন্ধ করে বলে বদহজম কম হয়। যকৃৎ ভালো রাখে লাউ।
এ যুগে যখন আমরা অনেক ধরণের ক্ষতিকর খাবার দাবার খাই তখন যকৃৎ সুস্থ্য রাখা খুব দরকার। আয়ুর্বেদের মতে লাউ যকৃৎ ভালো রাখে এবং যকৃতের ফোলা রোধ করে।
শীত মানেই তাপমাত্রার অসহনীয় ওঠানামা। আজকে ১০ ডিগ্রী তো কালকে ১৫, তার পরের দিন ২২।
পৃথিবী নামক গ্রহে জীবাণুর আক্রমণে আমরা অসহায়। সারাবছর জীবাণুর দাপাদাপিতে আমরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছি। এই অবস্থায় লাউ হতে পারে জীবাণুর সাথে লড়াই করার হাতিয়ার।