সরিষার তেল ব্যাথা কমায়, নিদ্রাহীনতা ও হৃদরোগ প্রতিরোধক।

আমাদের বাঙালিদের কিছু কিছু নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি রয়েছে যেগুলো আমাদের ঘর বা রান্নাঘরের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত।

বিভিন্ন আঞ্চলিক সুস্বাদু খাবার তৈরিতে কেবল এগুলি অপরিহার্য নয়, তাদের ব্যবহার বহুগুণে এবং রান্নাঘরের সীমানার বাইরেও প্রসারিত। সরিষার তেল তাদের মধ্যে অন্যতম।

হাজার বছর ধরে বাঙালি সমাজে এই তেল সকল কাজে যেভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে তাতে এই তেলের সাথে অন্য কোনো তেলের তুলনা হয় না।

সরিষার তেল (Mustard oil) একটি চর্বিযুক্ত উদ্ভিজ্জ তেল যেটি আমরা সরিষা বীজ পিষে পেয়ে থাকি।

এটি একটি প্রয়োজনীয় তেল যা বীজ (Mustard seeds) পিষে প্রস্তুত করা হয়। এটি একটি তীব্র, গরম এবং বাদামের স্বাদযুক্ত এবং মেরিনেট ও স্বাদ বাড়াতে খাবারে ব্যবহৃত হয়।

অন্যান্য তেলের ব্যবহার বাড়লেও বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা ও উত্তর ভারতে বাড়িতে সরিষার তেল ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যাই না।

প্রতিদিনকার আলু ভর্তা থেকে শুরু করে অন্য সকল প্রকার ভর্তা খেতে সরিষার তেল বাঙালির চা ই চাই। ঝাল মুড়ি মাখা খাবেন সরিষার তেল লাগবেই।

কদবেল বা চালতা মাখা খাবেন, সরিষার তেল না হলে ঠিক জমে না। ভোজনপ্রিয় বাঙালি বিভিন্ন স্বাদের খাবার তৈরিতে একেবারে সিদ্ধহস্ত। তার মধ্যে আঁচারের কথা না বললেই নয়।

কতো শত মজাদার আঁচার আমরা খেয়ে থাকি এই সর্ষের তেলের কল্যাণে। সর্ষের তেল বা সরিষার তেল ছাড়া আঁচারের কথা ভাবাই যায় না।

আয়ুর্বেদে সরিষার তেল খাবার হিসাবে এবং ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

সরিষার তেলের স্বাস্থ্য উপকারিতা নীচে উল্লেখ করা হল

এটির অলৌকিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয় এবং তাই এটি ঠান্ডা নিরাময়ের প্রতিকার হিসাবে, চুলের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করার জন্য, ত্বকে পুষ্টি সরবরাহ করার জন্য বিশেষত ব্যবহৃত হয়।

ভিটামিন “ডি” এর ডোজ এবং হাড়গুলিকে শক্তিশালী করতে, ওরাল স্বাস্থ্য, এবং আরও অনেক কিছু।

সরিষা তেল শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় যা হৃদরোগের আশঙ্কা কমায়। নিদ্রাহীনতা ও ক্যান্সার প্রতিরোধক। শরীরে ব্যথা কমায়।

শ্বাসকষ্টের প্রদাহ হ্রাস করে। রক্ত সঞ্চালন, হজম প্রক্রিয়া এবং হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সরিষার তেল আপনার শরীরের পাচক রস নিঃসরণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ক্ষুধা বাড়ে।

MUFA এর ভালো উৎস:

মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Monounsaturated fatty acids) হল একটি স্বাস্থ্যকর ফ্যাট। MUFA গুলি রক্তনালীগুলির কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়তা করে।

কিছু গবেষণা দেখায় যে এমইউএফএ (MUFA) গুলি ইনসুলিন স্তর এবং রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, যা টাইপ 2 ডায়াবেটিসে সহায়ক হতে পারে।

হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে :

আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশন দ্বারা করা একটি গবেষণা অনুসারে, আপনি যদি নিয়মিত ডায়েটে সরিষার তেল রাখেন তাহলে আপনার হার্টের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী হতে পারে।

এটি শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করে, এইভাবে রক্তের চর্বিগুলির মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে এবং রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে।

এটি রক্ত চলাচল বা প্রচলন বাড়ায় :

সরিষার তেলটিতে সাধারণ pungent বা তীব্র স্বাদ এবং গরম শক্তি রয়েছে। সরিষার তেল প্রচণ্ড উত্তেজক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ভাল কারণ এটি বিভিন্ন অঙ্গগুলিকে আরও দ্রুত হারে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত ​​সরবরাহ করে, তাদের সাধারণ কার্যকারিতা এবং উৎপাদনশীলতা বা সংবহন উন্নত করে।

এটি গ্যাস্ট্রিক রস নিঃসরণ এবং যকৃত এবং প্লীহা থেকে পিত্তরসের প্রসারণকে উৎসাহ দেয়, আপনার হজম ব্যবস্থা ভালো রাখে।

আয়ুর্বেদের মতে, শরীরের ম্যাসাজের জন্য সরিষার তেল ব্যবহার রক্ত সঞ্চালন, ত্বকের টেক্সচার উন্নত করে এবং পেশী উত্তেজনা প্রকাশ করে।

এটি ঘাম গ্রন্থিগুলিও সক্রিয় করে এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হতে সহায়তা করে।

ত্বকের জন্য ভালো :

সরিষার তেলে ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ভিটামিন “ই” রয়েছে। অতএব, ত্বকে প্রয়োগ করার সময়, সূক্ষ্ম রেখা এবং বলিরেখা কমাতে বলা হয় এবং এটি সানস্ক্রিন হিসাবে কাজ করে।

ঐতিহ্যগতভাবে, ভারতের এবং বাংলাদেশের, শিশুদের প্রায়শই সরিষার তেল গায়ে মাখানো হয়। তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে সরিষার তেলের ম্যাসেজ সীমিত পরিমাণে করা উচিত।

দিল্লি-ভিত্তিক পুষ্টিবিদ ডঃ আনশুল ভাটনগর বলেছেন, “সরিষার তেলের অনেকগুলি টপিকাল ব্যবহার রয়েছে এবং এটি বিভিন্ন উপায়ে ভাল তবে, তৈলাক্ত ত্বকের সাথে মুখের উপর এটি মালিশ করা এড়ানো উচিত।”

চুলের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে :

সরিষা তেল চুলকে ঝলমলে করে তোলে, খুশকি দূর করে এবং চুল বৃদ্ধি করে।

প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সরিয়া তেল চুল এবং মাথার তালুতে ম্যাসাজ করুন। এটি চুল পাকা রোধ করবে। 

“সরিষার তেলতে বিটা ক্যারোটিন থাকে যা চুলের বৃদ্ধির জন্য মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করতে পারেন।

এটি নিয়মিত মাথার তালুতে ম্যাসাজ করার ফলে নিয়মিত নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে। ত্বকের কালো দাগ দূর করতে সরিষার তেল অনেক কার্যকরী।

সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে :

সরিষার তেলে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়া, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ভাইরাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর বাহ্যিক পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে হজম সংক্রমণ সহ সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একাধিক উপায়ে সহায়তা করার কথা বলা হয়।

সরিষা তেল মাথা ব্যথা কমায়। শুষ্ক ত্বক মসৃণ ও কোমল করে। ঠোঁটের শুষ্কতা দূর করে এবং ত্বকের প্রদাহ দূর করে।

শীতের সময় সরিষার তৈল মাখলে ত্বক সুন্দর থাকে। পোকামাকড় সরিষার তেল সহ্য করতে পারে না। এই তেল ব্যবহার করে পোকামাকড় থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে সরিষা তেল। নাকের বদ্ধভাব দূর করে। কানের ব্যথায় কানের ড্রপের বিকল্প। সামান্য কাটা ছেঁড়ায় অ্যান্টিসেপটিকের কাজ করে।

নিয়মিত এই তেল মালিশ করলে বাতের ব্যথায় উপকার পাওয়া যায়। দাঁত মজবুত করে এবং ব্যথা কমাতে সাহায্য করে সরিষা তেল।

ওমেগা আলফা ৩ ও ওমেগা আলফা ৬ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন “ই” ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ উৎস হওয়ায় সরিষার তেলকে স্বাস্থ্যকর তেল বলা হয়।

এর ঔষধি গুণাগুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে এই তেল। ত্বক, চুল ও স্বাস্থ্যের জন্য সরিষার তেলের অসাধারণ উপকারীতার বিভিন্ন দিক প্রমাণিত একটি বিষয়।

সতর্কতাঃ

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।

আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করলে বা বিভিন্ন ওষুধ গ্রহণ করলে অবশ্যাই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।