শাপলা বা নাল সবজি শরীর ঠান্ডা রাখে, কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ও হৃদযন্ত্র সবল করে।

যদি না ফুটতো শাপলা, হারাতো সৌন্দর্য বাংলার পুকুর, দীঘি, বিল তথা জলাশয়। তাঁরা কি শুধু আকাশে জ্বল জ্বল করে? না। তাঁরা বাংলার ভূমি তথা জলাশয়েও জ্বল জ্বল করে। রাতে বড়ো দীঘি, ঘের বা বিলে যখন হাজার হাজার শাপলা ফুল ফোঁটে তখন চাঁদের আলো পড়লে অবিকল তাঁরার মতো মনে হয় এবং মনে হয় জলাশয়ে তাঁরার মেলা বসেছে।

লম্বা সরু জলের নিচে বিদ্যমান ডাটা বা কান্ডটি পরম যত্নে ফুলটিকে জলের উপর ধরে রাখে। এই ডাটা বা নাল সবজি হিসাবে খাওয়া হয় এবং এর স্বাস্থ্যসুবিধা অনেক। চিংড়ি মাছ ও নারকেল দিয়ে শাপলার তরকারি বা ঘন্ট এককথায় অমৃত। এছাড়া শুঁটকি মাছ দিয়ে শাপলা, শাপলার বড়া দিয়ে মসুরীর ডাল কোনটা রেখে কোনটা বলবো।

আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে শহরের মানুষের কাছেও এখন এটি খুবই সহজলভ্য। ছোট্ট বেলা থেকে একেবারে কণ্ঠস্থ শাপলা আমাদের তথা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। বড়োরা ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে আর ছোটরা (শিশু,কিশোর- কিশোরী, তরুণ-তরুণী) মজা করে তালের ডিঙ্গী অথবা নৌকায় করে বের হয় শাপলা এবং শাপলা ফুলের ফল (ঢেপ) সংগ্রহ করে খেতে। এটি বেশ মজার ও উপভোগ্য।

প্রচলিত নাম- শাপলা। আয়ুর্বেদিক নাম- নীলোৎপল। ইংরেজী নাম- Water Lily বৈজ্ঞানিক নাম- Nymphaea nouchail Burm.F  পরিবার- Nymphaeaceae . প্রায়শই এটি Nymphaea স্টেলাটা সমার্থক দ্বারা পরিচিত।

এটি এশিয়ার দক্ষিণ এবং পূর্ব অঞ্চলে স্থানীয় এবং এটি বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় ফুল। সংস্কৃততে এটি উতপাল। সাধারণ নামে নীল পদ্ম, তাঁরা পদ্ম, লাল জলের লিলি, নীল জলের লিলি, নীল তারা জলের লিলি বা ম্যানেল ফুল নিম্পিয়া জেনাসের একটি জলের লিলি।

শাপলাতে গ্যালিক এসিড ও তার বিভিন্ন যৌগ, ফ্লেভনল গ্লাইকোসাইড ও লিগনিন বিদ্যমান। সাধারণত ফুল ও রাইজোম মানবদেহের বিভিন্ন রোগে যেমন- স্নিগ্ধ কারক, শীতল কারক, পিত্ত প্রশমক, হৃদযন্ত্রের শক্তি কারক ও পিপাসা নিবারক। তাছাড়া প্রসাবের জ্বালা পোড়া, আমাশয় ও পেট ফাঁপায় উপকারী।

শাপলা গাছের বিভিন্ন অংশের পুষ্টিমান বিভিন্ন রকম:

  • জলীয় উপাদান সবচেয়ে বেশি থাকে মোথা বা কন্দে (২০.৪%) ও সবচেযে কম থাকে বীজে (৪.১৮%)। ফ্যাট বেশি থাকে বীজে। প্রোটিন সবচেয়ে বেশি আছে পাতায় (২৫.৪%) ও সবচেয়ে কম আছে ডাঁটায় (১০.০%)।
  • খাদ্য আঁশ আছে ৯.৫-১৫.১%। ডাঁটায় খনিজ উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে পটাশিয়াম (১.৫৬- ৪.৬৩%) ও সোডিয়াম (১.৯-৪.২১%)। এ ছাড়া রয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম, জিংক, আয়রন ও সোডিয়াম।

প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলার লতায় রয়েছে:

  • খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, আঁশ ১.১ গ্রাম, ভিটামিন ১৪২ কিলোক্যালোরি, প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭৬ মিলিগ্রাম।

শাপলার ওষুধী গুন:

গ্রাম অঞ্চলে একসময় শাপলা গাছের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। এর শুকনো ফুলের গুঁড়ো ঠাণ্ড ও কষায় উপকার করে। কলেরা, জ্বর ও যকৃতের অসুখ সারাতে শাপলার ফুল ব্যবহৃত হয়। বীজ বিভিন্ন চর্মরোগ এমনকি কুষ্ঠ রোগের ঔষধ। ডাঁটা বা নাল খেলে পাকস্থলী থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। তবে সবচেয়ে উপকারী হলো শাপলা মোথা বা মূল। অর্শ, অজীর্ণ, শুক্রতারল্য ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে মোথা কাজে লাগে।

স্বাস্থ্যের জন্য শাপলার পুষ্টিগুণের উপকারীতা:

বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র, খাল, বিল, পুকুর, ডোবায় পাওয়া যায়। বীজ থেকেও চারা করা যায়। এন নোচালী শোভাময় ফুলের কারণে শোভাময় উদ্ভিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিক উৎসবে সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। এটি “বামন লিলি” বা “বামন লাল লিলি” নামে অ্যাকোরিয়াম উদ্ভিদ হিসাবেও জনপ্রিয়। এন নওচালিকে অ্যাম্বল নামে ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ওষুধের ঔষধি গাছ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

কোষ্টকাঠিন্য দূর করে:

শাপলার ডাটা যেটি আমরা সবজি হিসাবে খেয়ে থাকি সেটি প্রচুর পরিমানে খাদ্য আঁশ সমৃদ্ধ। আঁশ জাতীয় খাবার  আমাদের অন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এটি কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে এবং হজম স্বাস্থ্য ভালো রাখে।

পুষ্টির ভান্ডার:

ভিটামিন “সি” একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।  ভিটামিন “সি” শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

প্রোটিন শরীরের ত্বক, চুল, নখ, হাড় বিকাশে প্রোটিন প্রয়োজন। ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া থেকে শরীরকে প্রতিরক্ষা করে। ক্যালসিয়াম শরীরের হাড় এবং দাঁত মজবুত করতে সহায়তা করে। ভিটামিন বি ১ শরীরকে কার্বোহাইড্রেটকে শক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে সক্ষম করে। এটি গ্লুকোজ বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এটি স্নায়ু, পেশী এবং হার্টের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

হৃদযন্ত্র সবল করে:

হৃদযন্ত্রের দুর্বলতায় ও হৃদকম্পের রোগের জন্য শাপলা ফুল ১০ গ্রাম, সাথে পাঁচ গ্রাম গোলাপ ফুল মিশিয়ে দুই কাপ পানিতে জ্বাল করে ছেঁকে নিয়ে প্রয়োজন মত চিনি মিশিয়ে প্রতিদিন ২ বার এভাবে ১ মাস নিয়মিত খেলে বিশেষ উপকারে আসবে।

শরীর ঠান্ডা রাখে:

প্রসাবের জ্বালা পোড়া ও পিত্তাধিক্য রোগে শাপলা ফুলের শুকনো অংশ ১০-১৫ গ্রাম পাঁচ গ্রাম ধনিয়া আধা চূর্ণ করে, দুই কাপ পানিতে মিশিয়ে জ্বাল করে ছেঁকে নিয়ে প্রয়োজন মত চিনি সহ দিনে ২ বার ১৫-২০ দিন খেলে উপকার হবে।

শাপলায় উপস্থিত ফ্লেভনল গ্লাইকোসাইড যা মাথার রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে । তাই আপনার মাথা যদি ঘন ঘন গরম হয়ে যায়, তাহলে শাপলা খাওয়া অভ্যাস করুন ।

ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে:

রক্তে শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। শাপলা ফুল ইনসুলিনের স্তর স্থিতিশীল রেখে রক্তে শর্করা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে। যকৃতের ক্ষতি প্রতিরোধ করে লিভার নিরাময় করতে সহায়তা করে।

ড্রাই ত্বক ময়শ্চারাইজ করে। ত্বক খুব শুকনো হলে শাপলা ফুল সর্বোত্তম। এটি ত্বকের ময়শ্চারাইজিং, কন্ডিশনারের কাজ করে । ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। চুল প্রাণবন্ত করে তুলতে শাপলা ফুলের উপকারিতা অনেক। স্ক্যাল্পের সমস্যা দূর করে চুল করে তোলে স্বাস্থ্যকর । শাপলাতে রয়েছে গ্যালিক এসিড এনজাইম। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে।

তবে নীল রঙের ভিন্ন প্রজাতির শাপলাও পাওয়া যায়। পাতার গোঁড়ার দিক হৃদপিন্ডাকৃতির এবং পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো। ফলগুলো স্পঞ্জের মত দেখতে এবং ফলের ভিতর অনেকগুলো কোষ। প্রতিটি কোষে সরিষার ন্যায় বীজ থাকে। সাদা শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। শাপলার ফল দিয়ে মজাদার খই তৈরি হয়।