চীনাবাদাম স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, ক্ষুধা কমায়, ক্যান্সার প্রতিরোধ ও বয়সের ছাপ দূর করে।
সব ধরণের বাদামের মধ্যে সবথেকে সহজলভ্য বাদাম হলো চীনাবাদাম। গল্প-আড্ডা, সময় কাটানোর জন্য মুচমুচে গরম গরম চীনা বাদামের জুড়ি নেই।
ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি যে খেলাই হোক না কেনো দর্শকসারিতে বসে খেলা দেখছি আর সাথে সুস্বাদু চীনাবাদাম থাকবে না- ভাবাই যাই না।
সকল বাঙ্গালীর খুব পছন্দের এই চীনাবাদাম অবসরে পার্কে ঘুরে বেড়ানোর সময়, ভ্রমণের সময়, হাঁটতে হাঁটতে, কিংবা গল্প করার ফাঁকে চাই-ই-চাই।
চিনাবাদাম আয়ুর্বেদে “কালয়া” নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক ভাষায় “Arachis hypogeal” আর ইংরেজীতে peanuts.
পাঁচ হাজার বছর (৫০০০)-আগে ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু এই অঞ্চলে চিনাবাদামের চাষ শুরু হয়।
পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের দ্বারা ১৫০০ শতাব্দীতে এশিয়াতে এই বাদামের আগমন ঘটে। বর্তমানে ৮০টিরও বেশি দেশে চীনাবাদামের চাষ হয়।
চীনাবাদাম উদ্ভিদ-ভিত্তিক প্রোটিনের একটি ভালো উৎস, ১০০ গ্রাম চীনাবাদামে ২৫.৮ গ্রাম প্রোটিন আছে।
কোনও ব্যক্তির দৈনিক প্রোটিনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সরবরাহ করে। ডায়েটরি ফাইবারেরও ভাল উৎস চীনাবাদাম।
প্রতি ১০০ গ্রাম চীনবাদামে ৮ গ্রাম ফাইবার থাকে, যা একজন পুরুষের প্রস্তাবিত ফাইবার গ্রহণের এক-চতুর্থাংশ বা একজন মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ থাকে।
কাঁচা বাদাম ভাজা বাদামের তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যকর। কারণ কাঁচা বাদাম আমরা স্কিন সহ খাই। বাদামের স্কিনে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।
অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ফ্রি র্যাডিকেলের ক্ষতি থেকে দেহের কোষগুলিকে রক্ষা করতে সহায়তা করে।
ভাজা বাদামে স্কিন ফেলে দিয় আর লবণ দিয়ে খাই। এতে বেশি পরিমাণে সোডিয়াম সেবন করা হয় যা উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের রোগের জন্য ক্ষতিকর। তাই কাঁচা বাদাম বেশি স্বাস্থ্যকর।
চীনাবাদামের পুষ্টিগুণ
চীনাবাদামে অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। তারমধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান নিচে দেওয়া হলো –
- ক্যালোরি: ৫৬৭
- প্রোটিন: ২৫.৮ গ্রাম
- কার্বস: ১৬.১গ্রাম
- চিনি: ৪.৭ গ্রাম
- ফাইবার: ৮.৫ গ্রাম
- ফ্যাট: ৪৯.২ গ্রাম
- স্যাচুরেটেড: ৬.২৮ গ্রাম
- মনস্যাচুরেটেড: ২৪.৪৩ গ্রাম
- পলিউনস্যাচুরেটেড: ১৫.৫৬ গ্রাম
- ভিটামিন “ই”: ৪৪%(DV)
চীনাবাদামের স্বাস্থ্য উপকারীতা
সবার পছন্দের চীনাবাদাম স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী। নিচে এর উপকারী দিক গুলো দেওয়া হলো –
রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে:
ডায়াবেটিস আছে এমন ব্যক্তিদের জন্য চীনাবাদাম একটি দুর্দান্ত খাদ্য। চীনাবাদাম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম থাকে যার অর্থ রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করে না।
বরং এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে কারণ এতে শর্করা তুলনামূলকভাবে কম তবে প্রোটিন, ফ্যাট এবং ফাইবার বেশি। ফাইবার, হজম প্রক্রিয়াগুলিকে ধীর করে দেয়।
গবেষণায় দেখা যায় যে চীনাবাদাম টাইপ-2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাসে সহায়তা করতে পারে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে:
আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চীনাবাদাম ভূমিকা রাখতে পারে। চীনাবাদাম স্বাস্থ্যকর ফ্যাট, প্রোটিন এবং ফাইবারে পরিপূর্ণ তাই এটি স্বাস্থ্যকর।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, চীনাবাদাম গ্রহণ স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে এবং স্থূলতার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
অন্যান্য খাবারের তুলনায় এটি অনেক সময় ধরে পেট ভরিয়ে রাখতে পারে ফলে ক্ষুধা কম লাগে এবং বেশি খাওয়ার প্রবণতা হ্রাস করে।
এছাড়াও চীনাবাদামে প্রোটিন এবং মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ক্যালরি বার্ন বাড়িয়ে তুলতে পারে। এতে করে ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে:
যেকোনো বাদামই স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। চীনাবাদামে ভিটামিন বি-3 বা নিয়াসিন রয়েছে। নিয়াসিন আমাদের স্মৃতিশক্তি উন্নত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যার কারণে চীনাবাদামকে “মস্তিষ্কের খাদ্য” হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তাই বাদাম ছোট শিশুদের খাবারের তালিকায় রাখতে ভুলবেন না।
বয়সের ছাপ দূর করে:
বাদামে উপস্থিত প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন “ই” থাকে। যা আমাদের দেহের কোষের কর্মক্ষমতার বৃদ্ধি করে। ফলে বয়স বাড়লেও চেহারাতে বয়সের কোনো প্রভাব পড়েনা।
এছাড়া চীনাবাদাম ফসফরাসের এর একটি ভাল উৎস, এটি একটি খনিজ যা শরীরের টিস্যুর বৃদ্ধি এবং রক্ষণাবেক্ষণে একটি অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করে।
স্বাস্থ্যকর ফ্যাট রয়েছে:
চীনাবাদামের বেশিরভাগ ফ্যাট হল মনস্যাচুরেটেড এবং পলিঅনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, যা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন এর মতে, মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং পলিঅনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত খাবার একজন ব্যক্তির রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রাকে ভালো করতে পারে।
এর ফলে, হার্টের রোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
হার্টের জন্য ভালো:
সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, চীনাবাদাম খাওয়ার অভ্যাস হার্টের রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। চীনাবাদামে উচ্চ মাত্রার পলিআনস্যাচুরেটেড এবং মনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা, হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর।
খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে, ভাল কোলেস্টেরলের (HDL) মাত্রা বৃদ্ধি করে হার্টের রোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভালো:
চীনাবাদাম মধ্যে ফোলেট সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ফোলেট সুস্থ্য লাল রক্তকণিকা তৈরি করতে এবং গর্ভাবস্থায় খুব ভালো।
তবে অবশ্যই গর্ভাবস্থায় চীনাবাদাম খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
দুর্বলতা দূর করে:
দুর্বলতা এবং নিদ্রাহীনতা দূর করতে চীনাবাদাম কার্যকরী। শরীরে সঠিক পরিমানে পুষ্টি না থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
তাই চীনাবাদাম শরীরের দুর্বলতা এবং নিদ্রাহীনতা দূর করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:
বাদামে উচ্চ পরিমাণে বিটা-সিটোস্টেরল আছে যা শরীরের টিউমার বৃদ্ধিতে বাধা দিয়ে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, সপ্তাহে দু’বার চীনাবাদাম খাওয়া পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে যথাক্রমে ২৭% এবং ৫৮% ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে সক্ষম।
ত্বক ও চুলের জন্য:
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে বাদাম খুবই উপকারী। বাদামে থাকা অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টি আমাদের বয়সের ছাপ কমাতে সাহায্য করে। ত্বকের দাগ, মুখের ব্রণ, ব্ল্যাকহেডস কমিয়ে ত্বককে মসৃণ করে।
বাদাম এ প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন “ই” থাকে যা চুলের গোড়া শক্ত করে, নতুন চুল গজাতে এবং চুল পড়া বন্ধ করতে সাহায্য করে।
সতর্কতা
বাদাম খুবই স্বাস্থ্যকর একটি স্নাক্স। তবে অনেকের বাদামে এলার্জি থাকতে পারে।
তবে আপনি যদি জটিল কোনো রোগে আক্রান্ত হন বা অন্য কোনো কারণে রেগুলার কোনো মেডিকেল কোর্স-এর মধ্য দিয়ে যান তাহলে অবশ্যই খাওয়ার আগে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।