লেবু বা লেবুর শরবত কিডনি পাথর প্রতিরোধে, ত্বকের সৌন্দর্যে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে দারুণ কার্যকরী।

গরমে লেবুর শরবত! এই কথা মনে করতে তৃষ্ণা যেন হাজার গুনে বেড়ে গেল। প্রচন্ড রোদে বাইরে থেকে ফিরে এসে এক গ্লাস ঠান্ডা ঠান্ডা লেবুর শরবত খেতে কার না মন চাই। এটি তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে বহু গুন।

শরীরের দৈনিক ভিটামিন “সি”-এর চাহিদার ৩০ শতাংশ লেবুর শরবত পূরণ করতে পারে। আদর্শ স্বাস্থ্যসম্মত পানীয়র মধ্যে লেবুর শরবত অন্যতম।

লেবুকে বলা হয় ‘সুপার ফুড’। লেবুতে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন এবং ভিটামিন “এ”, “সি” ও “বি” কমপ্লেক্স, কার্বোহাইড্রেটস ও প্রোটিন এছাড়া রয়েছে ব্যাপক পরিমাণ অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল উপাদান সাইট্রিক অ্যাসিড।

এগুলোই মূলত রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। খুব সহজেই বাড়িতে বসে আমরা লেবুর শরবত তৈরি করতে পারি। কিন্তু তারপরও কখনও কখনও রাস্তার পাশ থেকে অস্বাস্থ্যকর লেবুর শরবত কিনে খেয়ে থাকি, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।

মানুষের দেহ প্রায় ৬০ শতাংশ পানি, তাই লেবুর শরবত স্বাস্থ্যের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পানি আমাদের শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি বের করে পানিশূন্যতা রোধ করে এবং আমাদের প্রাণবন্ত ও সতেজ রাখতে সাহায্য করে।

পানি ও ফলেরসহ প্রতিদিন কমপক্ষে আট গ্লাস তরল পান করা জরুরী। সেখানে প্রতিদিন ১ গ্লাস লেবুর শরবত আমরা রাখতে পারি।

লেবু কি কিডনি পাথর প্রতিরোধে কার্যকরী?

হ্যাঁ, লেবু কিডনি পাথর প্রতিরোধে বেশ কর্যকরী। কারণ, সাইট্রিক এসিডের লবণ সাইট্রেট ক্যালসিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে ‘ক্যালসিয়াম অক্সালেট’ পাথর গঠনে বাধা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন আধা কাপ বা দুটি লেবুর রস পান করলে মূত্রের সাইট্রেট বৃদ্ধি করে এবং কিডনির পাথরের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

লেবুর শরবতের উপকারীতা

প্রচন্ড গরমে এক গ্লাস লেবুর শরবত আপনাকে করে তুলবে তরতাজা ও প্রাণবন্ত। এই পানীয়টি পানি শূন্যতার হাত থেকে রক্ষা করে এবং দেহ থেকে ক্ষতিকর বর্জ্য বের করে দেয়। নিচে আরও কিছু উপকারীতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ওজন কমায়:

যারা ওজন কমাতে চান তাদের জন্য লেবুর শরবত আদর্শ। লেবুতে থাকা ভিটামিন “সি” শরীরের বাড়তি চর্বি কমাতে এবং পেকটিন ফাইবার খিদে কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে উঠে গরম পানির সাথে লেবুর রস, স্বাদমতো লবণ এবং মধু দিয়ে শরবত বানিয়ে খেলে সারাদিন ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। পেকটিন ফাইবার নামক এই উপাদানটি শরীরে প্রবেশ করার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। যার ফলে ওজন কমতে শুরু করবে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:

লেবুতে ভিটামিন “সি” প্রচুর পরিমাণে থাকে। ভিটামিন “সি” এমন একটি পুষ্টি যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে। এছাড়া ভিটামিন “সি” শ্বেত রক্ত কোষের উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে, যা আমাদের শরীরকে সংক্রমণ এবং রোগের বিরুদ্ধে রক্ষা করতে সহায়তা করে।

এক্ষত্রে প্রতিদিন এক গ্লাস লেবুর শরবত খেলে সর্দি-কাশি, মুখে ঘা হওয়া ইত্যাদির মতো নানা সমস্যা থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। এছাড়া লেবুর শরবত ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য ভালো।

দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে:

ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে লেবুর শরবত খেলে দেহের ভেতরে পি এইচ (PH) লেভেলের ভারসাম্য ঠিক থাকে। সুস্থ্য কর্মচঞ্চল জীবনের জন্য আমাদের রক্তে সর্বদা পি এইচ (PH) লেভেল ৭.৩৬৫ থাকা ভালো। লেবুর মধ্যে থাকা সাইট্রিক এসিড রক্তের পি এইচ (PH) ব্যালান্স ঠিক রাখে। ফলে ভেতর এবং বাইরে থেকে শরীর এতটাই চাঙ্গা হয়ে ওঠে যে দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে সময় লাগে না।

ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায়:

ত্বকের সৌন্দর্য বাড়ায় এটা আমরা সবাই জানি। হাজারো বিউটি প্রডাক্ট যা করে উঠতে পারেনি, তা লেবু করে ফেলতে পারে। লেবুতে থাকা ভিটামিন “সি” ও অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ত্বকের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে। সেই সঙ্গে বয়সের ছাপ কমানোর পাশাপাশি ব্ল্যাকহেডস এবং বলিরেখা কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

৪,০০০ এরও বেশি মহিলাদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, যারা বেশি ভিটামিন “সি” খেয়েছেন তাদের বয়স বাড়ার কারণে ত্বকে ভাঁজ পড়া এবং ত্বকের শুস্কতা কম ছিল। এছাড়া গরমকালে ত্বককে ঠাণ্ডা এবং ঘামমুক্ত রাখতে লেবুর পানি দিয়ে বারে বারে মুখটা ধুতে পারেন বা লেবুর শরবত খেতে পারেন। ভালো ফলাফল পেতে প্রতিদিন লেবুর শরবত খাওয়ার অভ্যাস করুন।

কিডনি পাথর প্রতিরোধ করে:

লেবুর মধ্যে থাকা সাইট্রিক এসিড কিডনি পাথর প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। অনেক সময় কিডনিতে জমে থাকা পাথর ভাঙ্গতে সাহায্য করে। এমনকি লেবুতে উপস্থিত সাইট্রিক অ্যাসিড কিডনিতে ‘ক্যালসিয়াম অক্সালেট’ নামক পাথর গঠনে বাধা দেয়।

‘ক্যালসিয়াম অক্সালেট’ সবচেয়ে সাধারণ কিডনি পাথরগুলোর মধ্যে একটি। এছাড়া লেবুতে বিদ্যমান সাইট্রিক এসিড কোলন, পিত্তথলি ও লিভার থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করতে সাহায্য করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে লোকেরা বেশি পরিমাণে সাইট্রাস ফল খেয়েছিল তাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি কম ছিল।

মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়:

কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা রসুন বা মাছ খাওয়ার পরে অনেক সময় মুখ থেকে তীব্র গন্ধ বের হয়। যা অন্যের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। এক গ্লাস লেবুর শরবত বা লেবুর পানি এই সমস্যা থেকে আপনাকে মুক্তি দিতে পারে।

হার্ট ভালো রাখে:

লেবু ভিটামিন “সি” এর খুব ভাল উৎস। আমরা জানি ভিটামিন “সি” যুক্ত যে কোনো খাবার হার্টের রোগ এবং স্ট্রোক এর ঝুঁকি কমায়। লেবুর রস রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমান কমিয়ে দিয়ে হার্টকে ভালো রাখে।

ক্যান্সার ঝুঁকি কমায়:

গবেষণা করে দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত লেবু খায় তাদের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি কম থাকে। টেস্ট-টিউব সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, সাইট্রাস ফলগুলি কোলন ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, অগ্ন্যাশয় ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমায়।

আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি করে:

আমাদের শরীরে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে এবং অক্সিজেন পরিবহনের জন্য আয়রন একটি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। ভিটামিন “সি” জাতীয় উচ্চমাত্রার খাবার যেমন লেবুর শরবত আয়রনের শোষণ উন্নত করে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতা রোধ করতে পারে।

নিরামিষ ডায়েট অনুসরণকারী লোকদের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারের পাশাপাশি এক গ্লাস লেবুর পানি বা শরবত পান করলে আয়রনের শোষণকে ৭০% পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে।

লেবুর শরবতের কিছু সতর্কতা:

  • কেউ যদি দীর্ঘদিন ধরে লেবুর শরবত খায় তবে লেবুর শরবত খেয়ে কিছুক্ষন (২০-৩০ মিনিট) পর পানি দিয়ে কুলকুচি করা বা ব্রাশ করা দাঁতের এনামেল (দাঁতের টিস্যু) এর জন্য ভালো।
  • লেবুর বীজটা খুব একটা উপকারী নয়, তাই লেবুর শরবত তৈরীর সময় লেবুর বীজটা ফেলে দেওয়া ভালো।
  • লেবুর শরবত তৈরীর সময় অতিরিক্ত চিনি বা মধু মিশালে লেবুর কার্যকারীতা কমে যায়।