মেহেদি পাতা ব্যথা কমায় এবং চুল পাকা ও চুল পড়া রোধে দারুন কর্যকরী।

মেহেদি পাতা চেনে না এমন লোক হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। প্রায় সব জায়গায়ই এই পাতার অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে। প্রাকৃতিক ভাবে চুল রং করতে এবং চুলের গোড়া মজবুত করতে মেহেদি পাতা অতুলনীয়। মেহেদি বলতে প্রথমেই মাথায় আসে রাঙ্গা হাতের বাহারি নকশা।

মেহেদি পাতাতে রয়েছে ফাঙ্গাল, এন্টি মাইক্রোবিয়াল, এন্টিব্যাকটেরিয়াল, এন্টিইনফ্লেমেটরি, কুলিং, হিলিং ও সিডেটিভসহ আরও অনেক গুণ।

ইংরেজিতে: Henna এবং বৈজ্ঞানিক নাম: Lawsonia inermis. অনেকে আবার চুলের যত্নে মেহেদি পাতাকেই প্রথম সারিতে রাখে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না হাত সাজানো আর চুলের যত্ন ছাড়াও মেহেদি পাতা শরীরের জন্য অনেক উপকারী। এর পাতার পাশাপাশি ফুল, ফল ও মূলও ব্যবহৃত হয়।

পৃথিবী থেকে আমরা প্রাকৃতিক ভাবে যা পেয়েছি তা প্রায়শই সর্বোত্তম ওষুধ। মেহেদি পাতা তার মধ্যে একটি।

ব্রোঞ্জ যুগ থেকেই রঞ্জক হিসেবে মেহেদি ব্যবহার করে আসছে। বহু দেশে মেহেদি উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে ঈদ ও বিয়ে উপলক্ষে এর ব্যবহার অনেকটা আবশ্যিকরূপে প্রচলিত। ভারতীয় আদালতে চুলের রঙ হিসেবে মেহেদির ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে যেটা প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টাব্দের।

ছত্রাক-রোধী হিসেবেও মেহেদি কার্যকর। এছাড়া মেহেদি গাছের ফুল থেকে সুগন্ধী তৈরি হতো বহু প্রাচীনকাল থেকেই, বর্তমান যুগে এর উৎপাদন আবার শুরু হয়েছে। মেহেদি পাতায় লসোন (lawsone) নামক এক প্রকার পদার্থ রয়েছে যা মেহেদির রঙের জন্য দায়ী। যে গাছের পাতায় লসোন বেশি সে গাছের ফলে বীজ কম হয়।

গত কয়েক দশকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে মেহেদী শিল্প ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চুল কালার করা বা হাত এবং পায়ে শোভাময় রূপ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে মেহেদি পাতা। এর বোটানিকাল নাম: লসোনিয়া ইনার্মিস (Lawsonia Inermis).

হেনা বা মেহেন্দি বা মেহেদি একটি চিরসবুজ উদ্ভিদ। এটি লুজস্ট্রিফ (Loosestrife) পরিবারের সদস্য। মেহেদি মূলত মিশর থেকে আসে। মিশর এমন একটি দেশ যা এখনও উদ্ভিদের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী। মেহেদি গাছটি সাধারণত ভারত, উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্য প্রাচ্যের শুষ্ক আবহাওয়ায় বৃদ্ধি পায়।

এর সবচেয়ে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা গুণটি হল এটি প্রাকৃতিক কুলিং অর্থাৎ ঠান্ডা বা শীতল প্রভাব রয়েছে। এই শীতল প্রভাবের কারণে মরুভূমির লোকেরা দেহ শীতল করতে মেহেদী পাতা ব্যবহার করত।

মেহেদি পাতার উপকারিতা

সম্প্রতি এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, কেবল রং নয়, হাত ও নখের স্বাস্থ্যের জন্যও এটি বেশ উপকারী। এটি ব্যবহারে হাতের ত্বক হয় মসৃণ। জেনে নিন, মেহেদি পাতার ভেষজ গুনাগুন এবং উপকারিতা-

মাথাব্যথা নিরাময় করে:

মেহেদি গাছের ফুল মাথাব্যথা দূর করতে সাহায্য করে। এই ফুল পেস্ট করে এর সঙ্গে ভিনেগার মিশিয়ে নিন। এটি কপালে অথবা ব্যথার স্থানে লাগিয়ে রাখুন। এছাড়া আপনি মেহেদির পেস্টও ব্যবহার করতে পারেন। এতে মাথাব্যথা উপশম হবে।

বাতের ব্যথা কমায়:

মেহেন্দি পাতাতে প্রাকৃতিক ভাবে শীতল বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই এটি হাতে বা পায়ে ব্যবহার করলে এটি স্নায়ুতে শীতল প্রভাব ফেলে যা শরীরকে শিথিল করতে সাহায্য করে, ফলে আর্থ্রাইটিসের বা বাতের ব্যথা হ্রাস পায়।

খুশকি দূর করে:

খুশকি দূর করতে মেহেদি বেশ কার্যকরী। সরিষা তেল, মেথি, মেহেদি পাতা সেদ্ধ একসঙ্গে যোগ করে এটি চুলে ব্যবহার করুন। এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে ফেলুন। এটি খুশকি দূর করে চুলকে করবে ঝলমলে সুন্দর।

চুলকানি বা ঘা শুকাতে সাহায্য করে:

এই পাতার ঐতিহ্যগত ঔষধি ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে খোস পাঁচড়ার ক্ষত শুকাতে সহায়তা করে। মেহেদির পেস্ট পিঠ, ঘাড় এবং ঘামাচি আক্রান্ত অন্যান্য স্থানে লাগান। এটি ঘামাচির চুলকানি এবং জ্বালাপোড়া হ্রাস করতে সাহায্য করে। কারণ মেহেন্দির তাজা পাতাতে ছত্রাকজনিত বা ব্যাকটেরিয়াল বিশিষ্ট্য রয়েছে। তাই এই পাতা এন্টিসেপটিক হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

সৌন্দর্য চর্চায়:

সৌন্দর্য চর্চায় মেহেদী পাতার ব্যবহার আজ নতুন নয়। সুদূর প্রাচীন কাল থেকেই এর ব্যবহার চলে এসেছে। বাঙ্গালী নারীর সৌন্দর্য চর্চায় অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান হল মেহেদি পাতা।

সৌন্দর্য চর্চায় নখ ও হাত রাঙ্গাতে আবহমান কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে মেহেদি পাতা। আর বৈজ্ঞানিক ভাবে ও দেখা গেছে যে অনেকের নখকুনি হয়। তারা যদি দিনে দু বার নখে মেহেদি পাতা দেয় তাহলে নখকুনি দূর হয়ে যায় আর হাতে দিলে হাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি হাতের ত্বক ও মসৃন থাকে।

চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে:

ঘন কালো চুল কে না পছন্দ করে। কিন্ত কাজের ব্যাস্ততার কারনে চুলের যত্ন ঠিক মত নেওয়া হয়ে ওঠে না। তাই চুল কালো করার সহজ উপায় হিসাবে ব্যবহার করুন মাহেদি পাতার রস। মাহেদী পাতার রস ব্যবহারে আপনি সহজে পেতে পারেন ঘন কালো চুল।

পা ফাটা দূর করে:

মেহেদী পাতার অনেক উপকারিতার মধ্যে পা ফাটা দূর করাও একটি। শীতকালে দেখা যায় অনেকেরই পা ফাটে। আবার অনেকের সারা বছরই পা ফাটে। যাদের পা ফাটে তারা যদি মেহেদী পাতা ফাটা স্থানে ব্যবহার করে তাহলে তাদের পা ফাটা দূর হয়ে যাবে।

চুল পাকা ও চুল পড়ারোধে:

অনেক ধরণের শ্যাম্পু বাজারে পাওয়া যায়। দেখা যায় এসব শ্যাম্পু মাথার চুল পড়া রোধ করতে পারে না। আবার অনেক সময় ত্বকের সাথে মানানসই শাম্পু পাওয়া যায় না। মেহেদী পাতা ব্যবহার করলে আপনার ৯০ ভাগ চুল পড়া কমে। এক মুটো মেহেদী পাতার সাথে একটি হরিতকি সামান্য বেটে মাথায় দিলে চুল উঠা রোধ হবে এবং চুল পাকা ও অনেকাংশে দূর হবে। তবে এভাবে আপনাকে সপ্তাহে দু বার লাগাতে হবে।

আমাশয়:

আমাশয় নিরাময়ে মেনেন্দি গাছের বাকল অত্যন্ত কার্যকর। এছাড়া এর বীজ গুঁড়ো করে, ঘি এর সাথে মিশিয়ে ছোট ছোট বল করে শুকিয়ে তারপরে পানি দিয়ে খেতে পারেন।

টাক পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমায়:

মেনেন্দি পাতা সিদ্ধ করে তার সাথে সরিষার তেল মিশিয়ে চুলে ব্যবহার করলে চুলের বৃদ্ধি পাই। একটি পরিমান মতো সরিষার তেল নিয়ে তার মধ্যে এই পাতা দিয়ে গরম করে নিন। তারপর একটি কাপড়ে মাধ্যমে ছেকে নিয়ে নিয়মিত ম্যাসেজ করলে নতুন চুল গজাবে।

গলা ব্যথা ও ঘাড় ব্যথা কমায়:

গলা ব্যথা থাকলে মেহেদির রস দিয়ে গড়গড় করতে পারেন। এছাড়াও আমাশয় ও উদরাময় নিরাময়ে কাজ করে এটি। এছাড়াও মেহেদি পাতার রসের সঙ্গে সরিষার তেল মিশিয়ে ঘাড়ে ম্যাসেজ করলে ঘাড় ব্যথা কমে যায়।

ক্ষত সারাতে:

মেহেদি পাতা ত্বককে ইনফেকশন এবং জ্বালাপোড়ার হাত থেকে রক্ষা করে। বহু বছর ধরে এই পাতা পোড়া, কাটা ও বিভিন্ন ক্ষততে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই পাতায় এক ধরনের প্রশান্তিদায়ক উপাদান আছে যা প্রকৃতপক্ষেই ক্ষত স্থানের জ্বালাপোড়া শোষণ করে নেয়।

জ্বর কমায়:

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় জ্বর সারাতে প্রায়ই মেহেদি পাতা ব্যবহার করা হত। প্রচণ্ড জ্বরে অতিরিক্ত শরীরের উত্তাপ যেকোনো অঙ্গের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই তাৎক্ষনিক ভাবে জ্বর কমানো মাঝে মাঝে জরুরী হয়ে পড়ে। মেহেদি পাতা শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।

বার্ধক্যের ছাপ দূর করতে:

মেহেদি পাতা অ্যাস্ট্রোজেন নামক একটি উপাদান বহন করে। এই পাতার রস বলিরেখার উপর লাগালে বার্ধক্যের ছাপ অনেকাংশে কমে আসে। শুধু বার্ধক্যের ছাপই নয়, ক্ষত বা যেকোনো ধরনের ত্বকের দাগ দূর করতে এটি বেশ কার্যকর।

রক্তচাপ ঠিক রাখতে:

মেহেদি এর সবচেয়ে অবমূল্যায়িত প্রভাবগুলির মধ্যে একটি হল হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। মেহেদির রস বা বীজ নিয়মিত খেলে কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেম ও রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে। এটি ধমনীতে রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের হাত থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করে।

নখের যত্নে:

নখ মজবুত ও আকর্ষণীয় করতে মেহেদির জুড়ি নেই। পানিতে কয়েকটি মেহেদি পাতা ভিজিয়ে রাখুন কিছুক্ষন। পানি হালকা লাল হয়ে আসলে ওই পানি খেয়ে নিন।এতে ভালো উপকার পাবেন।

চুলের রং করতে:

চুলকে প্রাকৃতিক রং করতে তাজা মেহেদি পাতা পিষে অথবা মেহেদি পাতার ৫/৬ চামচ শুকনো গুড়োর সাথে চা-পাতার পানি অথবা কফির পানি মিশিয়ে দিলে চুলে সুন্দর গাঢ় লালচে রং হবে। মাসে ২/৩ বার ব্যবহারে রং দীর্ঘস্থায়ী হবে।

সতর্কতা

মেহেদি পাতার তেমন কোন পার্শ প্রতিক্রিয়া নাই। তবে আপনার ত্বকে র‍্যাশ, অ্যালার্জি সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

রেফারেন্স: