কিছু কিছু অভ্যাস আছে যেগুলো মস্তিষ্ককের জন্য ক্ষতিকর।

অভ্যাস এক ভয়ানক জিনিস। হুট করে কোনো অভ্যাস গড়ে ওঠে না, আবার হুট করে অভ্যাস ত্যাগ করা যায় না। ভালো অভ্যাস যেমন আমাদের ব্যক্তিত্ব কতটা শক্তিশালী প্রমাণ করে, তেমনি খারাপ অভ্যাস আমাদের মধ্যে কতটা দুর্বলতা আছে তা প্রকাশ করে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই অভ্যাস গড়ে ওঠে।

ভালো অভ্যাসের মতোই খারাপ অভ্যাসগুলো আমাদের মধ্যে তৈরি হয়। ইচ্ছে করলেই অভ্যাস পরিহার করা যায় না, কিন্তু চেষ্টা করলে নিজেকে ইতিবাচক উপায়ে বদলে ফেলা সম্ভব। কেউ যদি খারাপ অভ্যাস থেকে বের হয়ে আসতে চায় তবে তার জন্য প্রয়োজন প্রচেষ্টা এবং পরিকল্পনা।

এছাড়াও খারাপ অভ্যাস গুলো আমাদের মস্তিষ্কেও নানা ভাবে প্রভাব ফেলে থাকে। যার ফলে আমাদের স্মৃতি শক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ারও অনেক সম্ভাবনা থাকে। আর তাই নিজেকে খারাপ অভ্যাসের থেকে বদলে ফেলতে চাইলে এখন থেকেই ভালো অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।

জেনে নিন যে খারাপ অভ্যাস আমাদের মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে-

অনিদ্রা:

বর্তমান প্রজন্মের একটি সাধারণ অভ্যাস হচ্ছে অকারণে রাত জাগা। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ব্রেইন সেল বা নিউরন ধ্বংস করে। ফলে স্মৃতিশক্তি, সমন্বয় ও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়াও ডায়াবেটিস, স্থূলতা, বিষণ্ণতা ও হৃদরোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সাথে এটি সম্পর্কযুক্ত। আচরণের উপরেও এটি ব্যাপক প্রভাব ফেলে- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। বয়সভেদে গড়ে দৈনিক কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।

অতিরিক্ত সেলফোন ব্যবহার:

একটি গবেষণায় দেখা গেছে ব্রেইন ক্যান্সারের সাথে মোবাইল ফোন সম্পর্কযুক্ত। ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে যে রশ্মি বিকিরিত হয় তা আমাদের মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় ইয়ারফোন বা স্পিকার ব্যবহার করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, অনেকেই রাতে ঘুমানোর সময় বালিশের পাশে ফোন রেখে ঘুমায়। এই অভ্যাস অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে।

ধূমপান ও মদ্যপান করা:

ধূমপান ও মদ্যপান দুটোই মস্তিষ্কের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর একটি অভ্যাস। বিশেষ করে ধূমপান মস্তিষ্কের জন্য অভিশাপ। ধূমপানের কারণে মস্তিষ্কের শিরাউপশিরা সংকুচিত হয়। এতে পুষ্টি, রক্ত, অক্সিজেন ইত্যাদির সরবরাহও সঠিকভাবে হয় না। তাতে স্মৃতিশক্তি লোপের মতো মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় মস্তিষ্ক। সেই সাথে ডিমেনশিয়া ও আলজেইমার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয় ধূমপান। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক ও উচ্চ রক্তচাপের আশঙ্কা বৃদ্ধি করে ধুমপান।

অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস:

দীর্ঘ দিন থেকে অতিরিক্ত খাবার খেলে মানুষ মোটা হয়ে যায়। যা আলজেইমারের সাথে সম্পর্কযুক্ত রোগ যেমন হার্টের রোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও আমরা অনেকেই একবেলা খাবার বাদ দিয়ে পরের বেলা একবারে বেশি করে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। এটি দেহের জন্য যতোটা খারাপ, ততোটাই মস্তিষ্কের জন্য আরও বেশি মারাত্মক হতে পারে। একবারে অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে হুট করে দেহে সুগারসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বেড়ে যেতে পারে। এতে করে মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা শক্ত করে ফেলে। যে কারণে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড খাওয়ার অভ্যাস:

ফাস্ট ফুড খেতে বেশ সুস্বাদু হলেও এটি আমাদের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে আমাদের মস্তিষ্কের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেক বেশি। এছাড়াও ফাস্ট ফুডের আরও অনেক মারাত্মক প্রভাব রয়েছে যা সৃষ্টি করে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ। এটি ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয় চিন্তা করার ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, শেখার ইচ্ছা। নিয়মিত যে সমস্ত মানুষের খাদ্য তালিকায় বার্গার, ফ্রাই, পটেটো চিপস বা কোমল পানীয়ের মত খাবার রাখেন তাদের কগনিটিভ মেমরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনেক সম্ভাবনা থাকে।

ব্যয়াম না করা:

নিয়মিত ব্যয়াম না করা না করলে ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। শুধু মস্তিষ্কের রোগই নয় এর ফলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। আর এর সবগুলোই আলজেইমারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর থেকে মুক্তি পেতে ম্যারাথনের মত দৌড়ের প্রয়োজন নেই। পার্কে বা বাসার আশপাশে আধ ঘণ্টার হাঁটাই এর জন্য যথেষ্ট। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

হেডফোনে উচ্চ শব্দে গান শোনা:

হেডফোনে উচ্চ ভলিউমে গান মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে একজনের শ্রবণশক্তি লোপ ঘটাতে পারে। এতে ভবিষ্যতে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়ার সাথে মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি হতে পারে। তাই ডিভাইসের ভলিউম ৬০% এর বেশি বা একটানা দুই ঘণ্টার বেশি গান শোনা এড়িয়ে চলুন।

অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া:

দীর্ঘ সময়ের অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি গ্রহণ আমাদের দেহের প্রোটিন এবং পুষ্টি গ্রহণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পুষ্টির অভাব মস্তিষ্কের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়। আমাদের শরীরে রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টির অভাব রয়েছে মানে আমাদের মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করতে পারবে না। অতিরিক্ত চিনি আপনার স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাভাবনার ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে, তাই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ মিষ্টি যেমন রাস্পবেরি এবং ডার্ক চকোলেট বেছে নিতে পারেন।

নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাওয়া:

অনেকেই ঘুমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ খেয়ে থাকেন। নিয়মিত ঘুমের ওষুধ গ্রহণ করতে থাকলে তা মস্তিষ্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে পূর্ণবয়স্ক মানুষ টানা তিনমাসের বেশি সময় রোজ ঘুমের ওষুধ খেতে থাকলে তার স্মৃতিলোপজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পানিশূন্যতা:

অনেকেই হয়তো জানেন না যে, মস্তিষ্ক ৭৫ শতাংশ পানি দিয়ে তৈরি। এ কারণে শরীরে পানিশূন্যতা হলে মস্তিষ্কেও সমস্যা দেখা দেয়। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

অলস মস্তিষ্ক:

কথায় আছে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” মস্তিষ্ককে সুন্দর চিন্তায় ব্যস্ত না রাখলে শুধু যে কুচিন্তা ভীড় করে তাই নয়, বরং তা মস্তিষ্কের জন্যেও ক্ষতিকর। যেকোনো যন্ত্র যত বেশি ব্যবহার করা হয় তা তত বেশি সচল ও কর্মক্ষম থাকে। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি প্রযোজ্য। নিউরনের উদ্দীপনার জন্য চিন্তা-ভাবনা করা অত্যন্ত জরুরি। যত বেশি সৃষ্টিশীল চিন্তায় মনোযোগ দিতে পারবে, তোমার মস্তিষ্কের কোষ তত বেশি উদ্দীপিত হবে। আরো বেশি দক্ষ ও মনোযোগী হতে পারবে যেকোনো কাজে। চিন্তাহীন ব্রেইন ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে ব্রেইনের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।

মাথা ঢেকে ঘুমানো:

মাথাঢেকে ঘুমালে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং অক্সিজেনের ব্যবহার হ্রাস পায়। অক্সিজেন মস্তিষ্কের সঠিক ক্রিয়াকলাপের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মস্তিষ্ক যদি অক্সিজেন পর্যাপ্ত পরিমাণ না পায় তাহলে মস্তিষ্কের কোষগুলি ক্ষতি হয়।

আপনি অবশ্যই ভাবছেন যে এগুলি খুব সাধারণ জিনিস যা আপনি প্রায়শই প্রতিদিন করেন। এখন সময় এসেছে ব্রেনের প্রতি যত্নশীল হওয়ার। আমাদের উচিত এসব খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করা।