নিয়মিত ধ্যান বা যোগব্যায়াম করুন। সকল রোগকে দূরে রাখুন।
আজকের এই অতি আধুনিক বিশ্ব বিভ্রান্তি দ্বারা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। আমাদের মন ও শরীর সবসময় দৌড়াচ্ছে। তারা যেন দৌড় প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী।
কেন দৌড়াচ্ছে? চাহিদা ও ইচ্ছা পূরণের বাসনা। এতো চাহিদা আমাদের এবং এতো বাসনা তা বলতে গেলে মুখও ব্যাথা হয়ে যাবে।
বিরতিহীন কাজ। শুধু কাজ করো। শুধু ছুটে চল। আর তুমি যদি এটা না কর তাহলে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তুমি বিপন্ন হবে। কেন এই মানসিকতা?
শান্তি ও বিশ্রাম এমন জিনিস যা আমরা সবাই খুঁজি কিন্তু সহজে পাইনা কারণ আমাদের মন বিভিন্ন চিন্তাধারা ও উদ্বেগের সাথে জড়িত থাকে।
চিন্তা ও উদ্বেগের ফলাফল-কঠিন চাপ, ধকল,অস্থিরতা, ভীতিগ্রস্ত, উৎকন্ঠিত, উত্তেজিত।
অনেক রকম চেষ্টা ও পদ্ধতি অবলম্বনের পরও আমরা এর থেকে মুক্তি পাই না। মন শান্তির জন্য চিৎকার করে। শান্তির জন্য হাহাকার করতে থাকে।
শরীর শক্তি ও বিশ্রাম চায়। যখন মন চায় শান্তি ও শরীর চায় বিশ্রাম ও শক্তি, তখন আপনার চোখ বন্ধ করুন এবং যোগব্যায়াম ও ধ্যান অনুশীলন করুন।
যোগ ধ্যান অনুশীলন মনের শান্ত ও নিয়ন্ত্রণ অনুশীলন। এটি সত্যিকারের আত্ন অনুসন্ধান এবং শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপন করার একটি কার্যকর উপায়।
এতো কিছু চিন্তা না করে, এতো না ছুটাছুটি করে, চোখ বন্ধ করে আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর মনোযোগ দিন।
কয়েক মিনিটের ধ্যান আপনার বিরক্তিকর চিন্তাগুলিকে দূর করে। উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, হতাশা যাই বলুন যেগুলি আপনাকে সুখী হতে বাধা দেয়, আপনার শান্তিকে কেড়ে নিয়েছে, সেগুলি নাশ করে।
আপনার ভয়ানক মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। মস্তৃষ্ক সুস্থ্য ও সক্রিয় রাখতে এটি সবচেয়ে কার্যকরী প্রাকৃতিক ঔষধগুলির মধ্যে একটি।
yoga বা ইয়োগা বা যোগা একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ হলো –শরীর ও মনের সমন্বয়। গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস এর সাথে শারীরিক অঙ্গবিন্যাস(আসন), মানসিক সচেতনতা, শারীরিক চেতনা সঙ্গে আধ্যাত্বিকতা।
জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মতে, প্রায় ১০% আমেরিকানরা যোগ ব্যায়াম অনুশীলন করে। শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হলে যোগব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই।
শরীরের নমনীয়তা বৃদ্ধি:
যোগব্যায়ামের উপকারিতার কথা বলতে গেলে সর্বপ্রথম যে কথাটি চলে আসে বা যেটি না বললেই নয়। সেটি হলো- যোগব্যায়াম শরীরকে নমনীয় করে।
একজন যোগব্যায়ামকারী সহজে এবং সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি অনুধাবন বা বুঝতে পারে। আপনি দু-চারদিন হলো যোগব্যায়াম করা শুরু করছেন।
আপনি সামনে কাত হয়ে হাত দুটো পায়ের পাতায় ছোঁয়াবেন বা পা ছড়িয়ে বসে কপালটা হাঁটুতে স্পর্শ করবেন। আপনি সক্ষম হবেন না।
কিন্তু আপনি যদি চেষ্টা করতে থাকেন দেখবেন ধীরে ধীরে কত সহজে আপনি এটা করতে পারছেন।
প্রথম প্রথম আপনি অনেকটা ব্যাথা ও যন্ত্রনা অনুভব করবেন। মনে হবে, আপনার মাংসপেশি, শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
নিয়মিত যোগব্যায়াম অভ্যাস করলে হঠাৎ করেই বা কাকতালীয়ভাবে ব্যাথা উধাও হয়ে যাবে। হাঁটু, মেরুদন্ড, কোমর, কটিদেশীয় মেরুদন্ড এগুলির নমনীয়তা বাড়বে।
পেশি এবং সংযোগকারী টিস্যু যেমন-Fascia and Ligament যদি নমনীয় না হয় তাহলে আমরা শরীরকে কিভাবে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিবো অর্থাৎ যোগব্যায়াম করবো।
শক্ত পেশী তৈরি করে:
শক্তিশালী পেশি ভালো চেহারা থেকে মূল্যবান। প্রচলিত এই কথাটি বা ধারণাটি অনেকেই গুরুত্বসহকারে মেনে চলে।
নিয়মিত যোগব্যায়াম অভ্যাস আমাদের পেশিকে শক্ত ও দৃঢ় করে। আপনাকে অনেক টাকা খরচ করে জিমে যাওয়া লাগবে না বা lifting করা লাগবে না।
আপনি বাড়িতে বসে সহজে সুন্দরভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবেন।
মাংসপেশীর পুষ্টিসাধনের জন্য নানারকম ব্যায়াম অভ্যাস করা যায়। বারবেল নিয়ে ব্যায়াম, প্যারালাল বার, রিং, কুস্তি, নতুন নতুন আবিষ্কৃত যন্ত্রপাতি ইত্যাদি।
কিন্তু যৌগিক ব্যায়াম দেহ অভ্যান্তরের স্নায়ুগুলিকে, গ্রন্থিগুলিকে ও অন্যান্য যন্ত্রগুলিকে যে রকম পুষ্ট ও সবল করতে পারে অন্য কোনো ব্যায়াম সে রকম করতে পারে না।
স্নায়ুমন্ডলী আমাদের এই দেহযন্ত্রকে চালিত করে। মস্তিষ্ক স্নায়ুমণ্ডলীর কেন্দ্রস্থল। এই স্থান থেকে বিভিন্ন স্নায়ুর সাহায্যে যে আদেশ প্রেরিত হয়- তা মাংসপেশী ও বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গকে চালিত করে।
রক্তপ্রবাহ বাড়ায়:
সবথেকে কার্যকরী ও অধিক জনপ্রিয় একটি আসন হলো- শীর্ষাসন। আজও দেশি-বিদেশী এমন কোনো ব্যাবস্থা বা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি, যা মস্তিষ্কের মধ্যে প্রচুর রক্ত প্রবাহিত করে মস্তিষ্ককে সবল ও অধিক কর্মক্ষম করতে পারে।
যোগব্যায়াম মস্তিষ্কে অধিক রক্ত পাঠিয়ে মস্তিস্ককে সবল ও অধিক কর্মক্ষম করে তোলে।
সর্বাঙ্গাসন ও মৎস্যাসন এনডোক্রিন গ্রন্থিসমূহ যথা থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড ইত্যাদি গ্রন্থিগুলোকে রক্তস্নাত করে এদের যেমন সঞ্চারিত করে অন্য কোনো ব্যায়াম সে রকম করতে পারে না।
মানসিক চাপ ও টেনশন কমায়:
পীড়ন, ধকল ও কাজের চাপ কমিয়ে relax করতে চান। তাহলে যোগব্যায়াম করা শুরু করুন।
স্ট্রেস হ্রাস করে এবং কার্ডিওভাসকুলার ফাংশন উন্নত করে। শ্বাস প্রশ্বাসের অন্যতম প্রধান সুবিধা হল এটি স্ট্রেস কমাতে পারে।
যোগিক শ্বাস প্রশ্বাসের অভ্যাসগুলি ফুসফুসের কার্যকারিতা এবং শ্বাস প্রশ্বাসের সহনশীলতা উন্নত করতে পারে। হার্ট rate কমায় ও আমাদের আমাদের সুস্থ্য রাখে।
প্রকৃতপক্ষে একাধিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, এটি করিটোস (প্রাথমিক স্ট্রেস হরমোন)- এর স্রোত হ্রাস করতে পারে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ২৪-জন মহিলার উপর যোগব্যায়ামের কার্যকারিতার পরীক্ষা চালানো হয়।
পরীক্ষা শেষে ফলাফল খুবই সন্তোষজনক ছিল। তিনমাস ধরে যোগব্যায়াম কর্মসূচী শেষে, নারীদের করোটিসলের মাত্রা কমে যাই। ফলে তাদের চাপ, উদ্বেক, ক্লান্তি, বিষন্নতাও কমে যায়।
১৩১-জন ব্যাক্তির উপর আরেকটি গবেষণায় অনূরূপ ফলাফল পাওয়া যায়। মাত্র ১০ সপ্তাহের যোগব্যায়াম স্ট্রেস এবং উদ্বেগকে হ্রাস করতে সাহায্য করেছে।
সাথে সাথে এটি জীবন ও মানসিক স্বাস্থ্যের গুণগত মান উন্নত করতে সাহায্য করেছে।
মানসিক নির্মলতা বা পরিচ্ছন্নতা:
আপনি খুব ভোরে উঠে প্রকৃতির শান্ত নিবিড় পরিবেশ যোগাসনে বসে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। কিছুক্ষন বাতাস রেখে দিয়ে আবার নিঃশ্বাস ছেড়ে দিচ্ছেন।
পদ্মাসন, হলাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসন অভ্যাস করছেন। অর্থাৎ যোগ- ব্যায়ামের একটি পরিপূর্ণ সুস্থ্য ডোজ আপনার মস্তৃষ্ক তীক্ষ্ণ এবং পরিষ্কার রাখবে।
সহজ যোগব্যায়াম অনুশীলন এবং শ্বাস কৌশল আপনার মনের দূর্বলতাকে বা গোলমেলে অবস্থাকে শক্তিশালী ও শৃঙ্খলিত করবে।
ধীরে ধীরে শ্বাস এবং যোগব্যায়াম অভ্যাস আপনার স্মৃতিশক্তি উন্নত করবে এবং চিন্তাধারা সুশৃঙ্খলিত হবে।
মনোযোগ ও একাগ্রতা বাড়ায় :
প্রতিদিন আমাদের কত কাজই না করতে হয়। বেঁচে থাকতে গেলে কাজের কোনো বিকল্প নেই।
কিন্তু অনেকের মুখেই শোনা যাই, কাজে ভালোভাবে মন দিতে পারছি না। মনোনিবেশের অভাব বা একাগ্রতার অভাব একটি বাচ্চা বা মামুলি জিনিস নয়।
লক্ষ লক্ষ মানুষ concentration বা একাগ্রতার অভাবে জীবনে পিছিয়ে পড়ছে। নিয়মিত ধ্যানের বিশেষ সুবিধার মধ্যে একটি হলো এটি মনোযোগ ও একাগ্রতা বৃদ্ধি করে।
ভালো ফোকাস এবং একাগ্রতা আপনার জ্ঞানীয় দক্ষতা উন্নতির পাশাপাশি জীবনের সামগ্রিকমানের উন্নতি ঘটায়।
ভালো ঘুম আনে :
সুস্থ্য, সুন্দর জীবনযাপন করার জন্য আপনাকে যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে যাতে আপনি পরের দিন সুন্দরভাবে আনন্দসহকারে কাজ করতে পারেন।
আপনার ভালো ঘুম হয় না এবং আপনি কি অনেক দিন ধরে অনিদ্রাজনিত সমস্যায় ভুগছেন ?
সেক্ষেত্রে yoga এবং মেডিটেশনের কোনো বিকল্প নেই।প্রতিদিন ৩০ মিনিট থেকে এক ঘন্টা যোগব্যায়াম করুন। প্রতিদিন না পারেন সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ দিন করুন। ছুটির দিনে একটু সময় বেশি দিন।
হজম শক্তি বৃদ্ধি করে :
খাবার পর বজ্রাসন, এটা কেমন যেনো ইউনিভার্সাল হয়ে গেছে। জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ঘুরিয়ে, পাকিয়ে বা মুচড়িয়ে বা নাড়িয়ে চারিয়ে অর্থাৎ পাচক সিস্টেম বরাবর খাদ্য সরানো, গ্রন্থিরস নিঃসরণ অর্থাৎ যোগব্যায়ামের এই প্রক্রিয়াগুলোর কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ও স্বীকৃত।
ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ কমায় :
যোগব্যায়াম রক্তচাপ কমায়। হাই ব্লাড প্রেসারের কিছু রোগীকে শুধুমাত্র সঠিকভাবে শবাসন করানো হয়। ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। সবারই ব্লাড প্রেসার কমতির দিকে।
যোগব্যায়ামের উপকারিতা বলে শেষ করা কঠিন। নিয়মিত কিছুদিন যোগব্যায়াম করলে মস্তিষ্কের ধারণ শক্তি বাড়ে। স্নায়ু সতেজ ও মাংসপেশী সবল হয় এবং কোষ্টবদ্ধতা , বহুমূত্র, অর্শ ও শুক্রতারল্য প্রভৃতি দূরারোগ্য ব্যাধি সেরে যায়।
যৌগিক আসন অভ্যাসে শক্তিক্ষয় কম হয় ও শক্তিবৃদ্ধি পায়, দেহ রোগমুক্ত হয়, যৌবন ও সৌন্দর্য দীর্ঘ্যস্থায়ী হয়, স্বাস্থ্য, বীর্য এবং দীর্ঘজীবন লাভ হয়। এছাড়া মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করতে ও একাগ্রতা বৃদ্ধিতে যোগব্যায়াম অদ্বিতীয়।
যোগব্যায়াম মানুষের মন, হৃদয় এবং আত্মার শান্তি বাড়ায়। এছাড়াও শরীরকে সুস্থ্য রাখতে যোগব্যায়াম বিশ্ব নন্দিত ও সায়েন্টিফিকালি প্রমাণিত।
তাই, প্রত্যেকের জীবনে যোগব্যায়াম দরকার। প্রতিটি মানুষ যেন সুস্থতার সঙ্গে মানসিক শুদ্ধতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠে সেই বার্তা ছড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক যোগ দিবস।