সুস্বাদু খাবার “চিড়া-দই” শরীর ঠান্ডা রাখে, হজমকারক ও পেটের বন্ধু।
চিড়া আমাদের বাঙালিদের কাছে একটি বহুল প্রচলিত খাদ্য। আর চিড়ার সাথে দই এ যেনো জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন। পেট ঠাণ্ডা করতে, শরীরে জল বা পানির অভাব পূরণে এবং একই সাথে ক্ষুধা মিটাতে চিড়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
সকালের প্রাতঃরাশ বা নাস্তা বা ব্রেকফাস্ট বা অন্যান্য সময়ের টিফিন বা হালকা খাবার যেটাই বলেন সবথেকে স্বাস্থ্যকর দেশি খাবার হলো চিড়া-দই।
ইংরেজিতে এটি Rice Flakes / Beaten Rice /flattened rice নামে পরিচিত। চেওদা (হিন্দি), পোহা (হিন্দি / মারাঠি), আতুকুলু (তেলেগু), আভাল (তামিল), আভাল (মালায়ালাম; അവൽ), চিউরা (ওড়িয়া), চিড়া (বাঙালি), সিরা (অসমিয়া). উৎপত্তিস্থল অঞ্চল বা রাজ্য: ভারতীয় উপমহাদেশ। প্রধান উপাদান: dehusked rice.
চিড়া এমন একটি খাদ্যপদ যেটির সাথে জল, জলে ভেজানো মানে ঠান্ডা একটা ভাব বা আমেজ জড়িত। চিড়া ভিজিয়ে তাতে দই, কলা, চিনি, গুড় ইত্যাদি মিশিয়ে খাওয়া হয়। চিড়া দিয়ে বিভিন্ন রকম মোয়া ও মজার সব খাবার তৈরি করা যায়।
চিড়া বা flattened rice-কী?
চ্যাপ্টা ধান বা চাল সাধারণত চিড়া নামে পরিচিত। ধানটাকে শুকিয়ে ঢেঁকি বা মেশিনে পিষে চ্যাপ্টা অর্থাৎ হালকা, শুকনো ফ্লেক্সে সমতল করা হয়। জল বা দুধ বা অন্য কোনও তরল (গরম বা শীতল) শোষণ করার সাথে সাথে অর্থাৎ তরলের সাথে যুক্ত হওয়ার সাথে এই ধানের ফ্লেক্সগুলি ফুলে যায়।
“চিড়া-দই” এর স্বাস্থ্য উপকারীতা
আবহমান বাংলার খাদ্য সংস্কৃতিতে চিড়া-দই একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। হাজার বছর ধরে বাংলার জীবনধারার ঐতিহ্য গোয়াল ভরা গরু ও গোলা ভাড়া ধান অর্থাৎ ধান থেকে চিড়া ও গরুর দুধ থেকে দই।
তার মানে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই খাবারটি ভোজনপ্রিয় বাঙালির রসনার স্বাদ মিটিয়ে আসছে। “চিড়া-দই” এর স্বাস্থ্য উপকারীতা আলোচনা করা হলো:
পানিশুন্যতা দূর ও শরীর ঠান্ডা রাখে:
গরমের সময়ে (মার্চ-এপ্রিল) আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায় ঘাম আকারে। গরমকালে অনেকেরই রোদে পুড়ে বিভিন্ন কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। খেটে খাওয়া মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠে যায় এই সময়ে।
সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার “চিড়া-দই” অত্যধিক গরমে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। ক্লান্তি দূর করে। শরীর ঠান্ডা রাখে। পানিশুন্যতাও দূর করে।
সহজে হজম হয়:
চিড়া-দই এমন একটি খাবার যেটা খুব সহজে হজম হয়ে যায়। চিড়া চর্বিমুক্ত, আয়রন, ভিটামিন বি, কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ। এছাড়া আমরা সবাই জানি, দই একটি probiotic অর্থাৎ উপকারী ব্যাকটেরিয়া সমৃদ্ধ খাবার।
অন্ত্রবান্ধব এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। তাই যারা হজমের সমস্যায় ভুগছেন তারা খাবারের মেনুতে “চিড়া-দই” অন্তর্ভুক্ত করুন। সকালে ব্রেকফাস্ট এবং বিকালের টিফিনে চিড়া-দই রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।
ক্ষুধা কমায়:
অনেকে বলেন, ভাই খালি ক্ষুধা লাগে। অনেকে আছেন, ক্ষুধা লাগলে দেরি সর্হ্য করতে পারেন না। ফলে বেশি খেতে খেতে অল্প খাবার খেলে আর পেট ভরে না। চিড়া-দই ল্যাকটোজ মুক্ত, হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং চর্বি মুক্ত। এটি দীর্ঘক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে তাই ক্ষুধা কম লাগে।
শক্তির ও ক্যালসিয়ামের উৎস:
এটি চাল ভিত্তিক হওয়ায় তা তাৎক্ষণিক শক্তির একটি ভাল উৎস। অন্যদিকে দই হলো ক্যালসিয়ামের খনি বা ভান্ডার। ক্যালসিয়াম এমন একটি খনিজ যা শক্তিশালী হাড় ও দাঁত বজায় রাখতে এবং অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করতে দরকারী। প্রায় সমস্ত ক্যালসিয়াম হাড় এবং দাঁতে জমা থাকে, যেখানে এটি তাদের গঠন এবং মজবুত রাখতে সহায়তা করে।
আমাদের শরীরে বিশেষ করে মহিলাদের শরীরে ক্যালসিয়াম অত্যন্ত জরুরী। ৩০ বছর বয়সের পর থেকে অনেক মহিলাদের ক্ষেত্রে হাড়ের সমস্যা দেখা দেয়। তাই সুস্বাদু খাবারের সাথে সাথে যদি আমাদের দাঁত আর হাড় সুরক্ষিত থাকে তাহলে ক্ষতি কি?
কিডনি রোগীর জন্য ভালো:
চিড়ায় পটাসিয়াম এবং সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকার জন্য কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে চিড়া খাওয়া উপকারী। সিলিয়াক ডিডিজের রোগীদের জন্য চিড়া খাওয়ার উপকারীতা রয়েছে।
চালের প্রোটিন প্রোলামিন এবং গ্লুটেলিনের শোষণে কোন সমস্যা না থাকার জন্য এই রোগীদের জন্য চিড়া গ্রহণ করা নিরাপদ।
ওজন কমায়:
চিড়া খেলে পেট ভরা থাকে। বার বার খাবার প্রবণতা কমে। ফলে ওজন বাড়ার ভয় থাকে না। যারা ওজন কমানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন তারা তাদের ডায়েটে চিড়া-দই অন্তর্ভুক্ত করুন।
দইতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকায় দই স্থূলত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে। আমাদের শরীরের চর্বি আমাদের মোটা করার সাথে সাথে অনেক অসুখও বহন করে নিয়ে আসে।
চর্বিতে থাকা কর্টিসল হরমোনটি স্থূলতা বাড়ায় ও আমাদের শরীরে ডেকে আনে বহু রোগ। ক্যালসিয়াম কর্টিসল হরমোন তৈরিতে বাধা দেয় যা শরীরকে ওজন বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায় না। সঠিক পরিমাণে দই নিয়মিত সেবন করলে ওজন কমাতে এবং ফিটনেস বাড়াতে সহায়তা করে।
চিড়া-দই বিষন্নতাকে দূর ও চাপ মুক্ত করে:
আমরা সবাই চাই উদ্যোমী হতে। বিসন্নতা ও মনমরা হয়ে কেউ থাকতে চাই না। আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক ও হাজারো সমস্যা ভারাক্রান্ত সমাজে টেনশন ও চাপমুক্ত থাকা খুবই কঠিন।
দইয়ের উপকারী ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ অন্ত্রবান্ধব ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর উপাদান আমাদের মস্তিকের চাপ কে নিয়ন্ত্রণ করে।
গবেষণা অনুসারে, দই মস্তিষ্কে শিথিলতা এবং সংবেদনশীল ভারসাম্য সরবরাহ করে। নিয়মিত টক দই খেলে মানসিক অশান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
সতর্কতা:
পরিমিত পরিমানে খাওয়া সুস্থ্যতার চাবিকাঠি। কোনো কিছু মোটেও খাবো না সেটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো কিছু অতিরিক্ত পরিমানে খাবো সেটাও ঠিক নয়।
অতিরিক্ত কোনো কিছু ক্ষতিকর। পরিমান মতো খেলে কোনো ক্ষতি নেই। তাই নিজের শরীরের অবস্থা বুঝে পরিমাণমতো খাবেন।
চিড়া খাওয়ার উপকারিতা অনেক থাকলেও বেশি শর্করা এবং উচ্চ গ্লাইসেমিক সূচক সমৃদ্ধ খাবার হওয়ায় ডায়বেটিস থাকলে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।
সূত্রঃ
http://www.healthfooddesivideshi.com/2013/09/chiwda-dahi-beaten-rice-with-yogurt.html