পুষ্টিগুণে ভরপুর “কুমড়ো বড়ি” খাবারের রুচি বাড়ায়, ক্ষুধা কমায় ও কোষ্টকাঠিন্য দূর করে।
ভোজন রসিক কারা? এককথায় উত্তর: বাঙালিরা। বাঙালিরা যে বরাবরই ভোজন রসিক তা অনেক আগে থেকেই প্রমাণিত। বারো মাস জুড়ে আমাদের খাবারের নতুন নতুন আয়োজন চলতে থাকে। আর শীত মৌসুম এলে তো কথাই নেই।
শীত মৌসুমে খাওয়া-দাওয়ায় একটু বেশিই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বাংলার মানুষ। তাইতো নতুন নতুন খাবার তৈরিতে আবহমান বাংলার নারীরা সবসময়ই ব্যস্ত থাকেন। শীত এলেই পিঠার সাথে সাথে বাংলার রমনীদের হাতের ছোয়ায় তৈরি হয় আরও একটি সুস্বাদু খাদ্যপদ।
হারিয়ে যাওয়ার খাতায় নাম উঠলেও আমরা বাঙালিরা এখনো এটিকে হারাতে দেয়নি। বন্ধুরা, কিছু কি বুঝতে পারলেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ডালের বড়ি বা কুমড়ো বড়ির কথা বলছি।
কিভাবে কুমড়ো বড়ি খাওয়া হয়?
কুমড়ো বড়ি বিভিন্ন নিরামিষ তরকারি (পালং-শাক,বাঁধাকপি, সজনে ডাটা) ও মাছের সঙ্গে রান্না করে খাওয়ার প্রচলন বহু আগের। ভোজন রসিকদের খাবারে বাড়তি স্বাদ এনে দেয় কুমড়ো বড়ি।
দেশি পুঁটি মাছ, মায়া চেলা বা মৌরলা মাছ বা ধরুন ডিম, রুই মাছ কুমড়ো বড়ি দিয়ে রান্না করলে খাবারের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায় শতগুন। সারাবছরই বিভিন্ন তরকারির সাথে রান্না করে খাওয়া যায় কুমড়োর বড়ি। কারণ তৈরিকৃত বড়ি সংরক্ষণ করে রাখা যায় সারা বছর জুড়ে।
কুমড়ো বড়ি তৈরির উপকরণ:
কুমড়ো বড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ হলো চালকুমড়ো (Ash gourd) ও ডাল। এই ডালটি মাষকলাইয়ের ডাল, বিউলির ডাল, উরোদের ডাল-বিভিন্ন নামে পরিচিত।
তৈরির পদ্ধতি:
পাটায় বেটে বা মেশিনে গুঁড়ো করে জল যোগ করে আঁঠালো খামির বানিয়ে নিতে হয়। পানিতে ভিঁজিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে পেস্ট বানিয়ে নিলেও হয়। চালকুমড়া জালি বা অমসৃণ কোনো কিছুতে ঘষে মিহি করে পানি ঝরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর বড়ি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়।
কলুর ডাল বা মাষকলাইয়ের ডাল ও পাঁকা চাল কুমড়ার সমন্বয়ে তৈরি এই খাদ্যপদটির জন্য নারীদের প্রস্তুতি দেখা যায় শীত মৌসুমে শুরু হওয়ার সাথে সাথে।
আরও পড়ুন:
কুমড়ো বড়ির উপকারিতা:
চালকুমড়া একটি পুষ্টিকর সবজি। অন্যদিকে মাষকলাইয়ের ডালও খুব পুষ্টিকর। তাই কুমড়ো বড়ির পুষ্টিগুণ অনেক বেশি, পেটের জন্য বেশ উপকারী, খাবারে রুচি বৃদ্ধি করে। দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে। নিচে কুমড়ো বড়ির স্বাস্থ্য উপকারিতা দেওয়া হলো –
পেশি গঠনে:
আমরা জানি, কুমড়ো বড়ির প্রধান উপাদান মাষকলাইয়ের ডাল। এই ডাল প্রোটিনের চমৎকার উৎস। পেশির কোষের বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে মাষকলাই ডাল। শরীরের বৃদ্ধিতে ডালে থাকা প্রোটিন খুবই দরকারি।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে:
চালকুমড়াতে ডায়েটারি ফাইবারের পরিমান অনেক বেশি। মাসকলাই ডালও খাদ্য আঁশে পরিপূর্ণ। এতে দুই ধরনের ফাইবার আছে। সলুয়েবল বা দ্রবনীয় ও ইনসলুয়েবল বা অদ্রবনীয় খাদ্য আঁশ। কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে ইনসলুয়েবল ফাইবার বা অদ্রবনীয় খাদ্য আঁশ এবং খাদ্য পরিপাকের সহায়তায় সলুয়েবল ফাইবার বা দ্রবনীয় খাদ্য আঁশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ।
হজমশক্তি বাড়ায়:
চালকুমড়া ও কলাইয়ের ডাল দুটোতেই প্রচুর ফাইবার আছে বলে কুমড়ো বড়ি খেলে হজম ভালো হয়।
বলবর্ধক:
এতে প্রচুর লৌহ বা আয়রন আছে বলে এটি স্বাস্থ্যকর। এই ডালের বড়ি শরীরে শক্তি বৃদ্ধি করে, শরীরকে সক্রিয় রাখে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:
চালকুমড়াতে ডায়েটারি ফাইবারের পরিমান খুব বেশি যা রক্তে শর্করার স্তরকে কার্যকরভাবে উন্নত করতে পারে। এপিডিমিওলোজিক্যাল পর্যালোচনা থেকে প্রমান পাওয়া যায় যে, যথেষ্ট পরিমানে শস্য জাতীয় খাবার গ্রহন করলে তা ডায়াবেটিস মেলিটাস (T2DM) এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
যারা প্রতিদিন এই কলাইয়ের ডাল গ্রহন করেছেন তাদের ডায়াবেটিস মেলিটাসে আক্রান্ত হওয়ায় ঝুঁকি ২০-৩০% কম অন্যদের তুলনায়।
ব্যথানাশক:
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মাষকলাই ডালের দারুণ ব্যথানাশক গুণের কথা বলা হয়। অস্থিসন্ধির ব্যথা সারাতে এ ডাল উপকারী।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাতেও কুমড়োবড়িতে বিদ্যমান মাষকলাই ডালের- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি দেখা গেছে। কুমড়ো বড়ির প্রধান উপাদান মাসকলাই ডালে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট আছে যা কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয় যেমন – কোলন ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার।
হার্ট ভালো রাখতে:
হার্ট ভালো রাখতে মাষকলাই ডাল উপকারী। এতে ম্যাগনেশিয়াম থাকায় রক্তপ্রবাহ বাড়ায় এবং হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে।
আজকাল বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা হচ্ছে কুমড়ো বড়ি। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় কুমড়ো বড়ির ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে। কুমড়ো বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে নিজেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদাশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।