দুধের “ঘোল” ক্যান্সার প্রতিরোধে, ওজন কমাতে ও ত্বক উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে।

কেউ চেনেন “ঘোল” নামে আবার কেউ “মাঠা”। কেউ চেনেন ছাছিকা বা ছাছ নামে। আবার কেউ চেনেন লাবাং ও আইরান নামে। যে যে নামেই চেনেন না কেনো, এটি তৈরির প্রধান উপকরণ হলো দুধ। অত্যন্ত পুষ্টিকর এই খাদ্যটি সারা পৃথিবী ব্যাপী অসংখ্য মানুষের প্রিয়।

ঘোল বা মাঠা আমাদের বাঙালিদের কাছে অতি পরিচিত একটি শব্দ। খুব ভোরে ব্যায়াম করার পরে এবং গরমে তৃস্না মেটানোর জন্য ঘোল বা মাঠার কোনো তুলনা হয় না।

প্রোটিনের পাশাপাশি এর রয়েছে এন্টিভাইরাস, এন্টিব্যাকটেরিয়াল ও এন্টিকান্সার উপাদান। এর ইংরেজি নাম Whey. গুগলে Whey protein লিখে সার্চ দিলে আপনি ঘোল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। দুধ হতে ছানা অপসারণ করার পরে যা অবশিষ্ট থাকে তাকে ঘোল বলে বা দুধ থেকে সব ফ্যাট বা ক্রীম বা ননি উঠানো হয়ে গেলে যে দুধটি থাকবে সেটাই হলো ঘোল।

হাজার বছর ধরে বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে দুধের ঘোল বিক্রি হয়ে আসছে। গোয়ালারা একটি কাঠের বা বাঁশের ফ্রেমের দুইপাশে বিরাট মাটির হাঁড়িতে ঘোল ভরে বিক্রির উদ্দেশ্যে হাঁক দিতেন ‘এই ঘোল-মাখন’ রাখবে “ঘোল-মাখন” বলে। হাঁড়িতে ঘোল থাকতো এবং ঘোলের উপরে মাখন ভেসে বেড়াতো।

এছাড়া হাঁড়ির উপরে একটি আলাদা পাত্রেও থাকত হাতে তোলা মাখন। একটি ছোট মাটির পাত্রে লবণও থাকতো খানিকটা। গোয়ালারা দুটি কাঁচের গ্লাস এবং ঘোল তোলার জন্য টিনের হাতলওয়ালা একটি ছোট মগ আনতেন। ছোটবেলায় গোয়ালাদের কাছ থেকে ঘোল বা মাঠা খাবার অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে। এক গ্লাস ঘোলের মধ্যে এক টুকরো মাখন এবং অল্প লবন ছিটিয়ে পরিবেশন করা হতো। ঘন, ক্রীমি এবং অত্যন্ত সুস্বাদু এই ঘোলের কথা ভোলার মতো নয়।

ঘোল হলো মাখন বা পনির উৎপাদনের একটি উপজাত। ঘোলের মাঝে দুধের প্রায় সকল উপাদানই বিদ্যমান। তাই এর পুষ্টিগুন প্রায় দুধের মতই। নিয়মিত ঘোল বা মাঠা পান করলে শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমে। দুধের প্রোটিনের উপস্থিতির জন্য যারা দুধ খেতে পারেন না তারা দুধের বদলে ঘোল বা মাঠা খেতে পারেন।

ঘোলের বা মাঠার স্বাস্থ্য উপকারীতা

ঘোলের বা মাঠার butter milk বা Whey প্রোটিনের কিছু স্বাস্থ্য সুবিধা রয়েছে। আসুন ঘোলের উপকারীতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:

প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করে :

এটি একটি সম্পূর্ণ, উচ্চ মানের প্রোটিন যা সমস্ত প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড ধারণ করে। এটি খুব সহজে হজম হয়। অন্যান্য প্রোটিনের  তুলনায় দ্রুত অন্ত্র থেকে শোষিত হয়। এছাড়া যারা অপুষ্টিতে ভুগছেন, তাদের জন্য ঘোল খুব কার্যকরী।

পেশি বৃদ্ধি করে :

পেশীর ভর স্বাভাবিকভাবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যায়। ঘোলে উচ্চ মানের প্রোটিন যা লেউচিন নামক ব্রাঞ্চ-চেইন অ্যামিনো অ্যাসিড সমৃদ্ধ। এই কারণে, ঘোল বয়সের সাথে সম্পর্কিত পেশী ক্ষতি প্রতিরোধের পাশাপাশি উন্নত শক্তি এবং একটি উন্নত চেহারার দেহের জন্য কার্যকর। পেশী বৃদ্ধির জন্য Whey প্রোটিনকে (ঘোল) অন্যান্য প্রোটিনের তুলনায় কিছুটা ভাল দেখা গেছে যেমন: কেসিন বা সয়া মিল্ক।

ত্বকের যত্নে :

ঘোল ত্বকের যত্ন নিতে ব্যবহার করা যায়। ঘোলের সাথে গোলাপজল ও আলমন্ড মিক্স করুন। ভালো করে তিনটে উপকরণ মিশিয়ে নিন। মুখে মিশ্রণটি লাগিয়ে ৩০মিনিট থেকে ১ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। এরপর ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে নিন। এটি আপনার ত্বকে ক্লিনজারের কাজ করবে।

ঘোলে থাকা ল্যাটিক অ্যাসিড ও প্রাকৃতিক পুষ্টি ত্বকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ত্বক চকচকে বা উজ্জ্বল করতে ঘোল ব্যবহার করতে পারেন অনায়াসে।

হজমশক্তি বাড়ায় :

দইকে পাতলা করেই ঘোল বানানো হয়। তাই ঘোল অনেক সহজে হজম হয়। জলীয় উপাদান বেশি থাকায় ঘোল দইয়ের থেকে শরীরের বেশি হাইড্রেট করে। এসিডিটি কমাতে ঘোল বা মাঠা বেশ ভালভাবেই সাহায্য করে। এর কারণ হলো টকদই বেশ হজম উপকারী। টক দইয়ে লেবুর রস, পুদিনা পাতার রস, আদার রস, সামান্য লবণ এবং প্রয়োজনমত চিনি বা মধু মিশিয়ে ঘোল বানাতে হয়। খাওয়ার পর এক গ্লাস মাঠা শরীরের সকল ক্লান্তি দূর করে হজমে বেশ সাহায্য করে।

তেল-মশলাদার খাবার খাওয়ার পরে এক গ্লাস ঘোল পাকস্থলীকে আরাম দেয়। মশলাদার খাবার হজম করতে সাহায্য করে ঘোল।

শরীরের চর্বি কমায় :

শরীরের ফ্যাট গলাতেও সাহায্য করে  ঘোল। উচ্চ কোলেস্টেরল, বিশেষত এলডিএল (LDL) কোলেস্টেরল হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজনের ব্যক্তিদের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে ১২ সপ্তাহের জন্য প্রতিদিন ৫৪ গ্রাম ঘোল খাবার ফলে এলডিএল (“খারাপ কোলেস্টেরল”) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।

ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ :

দুধের ঘোল শরীরের পুষ্টির জন্য খুবই উপকারী। ঘোল বা মাঠায় রয়েছে ভিটামিন এ,বি ও সি। ঘোলের মধ্যে থাকা ভিটামিট শরীরের জন্য উপকারী। ঘোলে থাকা পুষ্টি শরীরের বৃদ্ধির পাশাপাশি ত্বকের যত্নে সাহায্য করে। এতে প্রচুর মাত্রায় জিঙ্ক,আয়রন থাকে। যা মানবদেহের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান।

দুধে সমস্যা আছে, এমন মানুষরাও ঘোল খেতে পারেন। যারা ল্যাকটোস ইনটলারেন্ট, তারাও ক্যালসিয়ামের জন্য নিয়মিত ঘোল খেতে পারেন।

ক্যান্সার প্রতিরোধী :

বিশেষ করে যাদের বয়স একটু বেড়ে গেছে তাদের অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজনের ঝুঁকি(যেমনঃ কোলন ক্যান্সার) বেড়ে যায়। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছেন বা ব্যায়াম শেষ করার পরে ঘোল খেতে পারেন। ঘোলের মধ্যে অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিক্যান্সার উপাদান রয়েছে। তাই নিয়মিত ঘোল খেলে ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে ও অসুখ-বিসুখ কম হয়।

রক্তচাপ কমায় :

যারা হাই ব্লাডপ্রেসারে ভোগেন তাদের জন্যও ঘোল উপকারী। এর প্রোটিনগুলি উচ্চ রক্তচাপের লোকদের মধ্যে রক্তচাপ কমিয়ে দিতে পারে।

টাইপ-2 ডায়াবেটিসে ভালো :

টাইপ-2 ডায়াবেটিস হল ব্লাড সুগার এবং ইনসুলিনের প্রতিবন্ধী ফাংশন দ্বারা চিহ্নিত একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ। ঘোল রক্তে শর্করাকে সংযত করতে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে, ইনসুলিনের মাত্রা এবং এর প্রভাব সংবেদনশীলতা উভয়ই বাড়িয়ে তোলে।

ঘোল বা মাঠা তৈরীর উপকরণঃ

দুধে খাদ্য উপযোগী অম্ল জাতীয় পদার্থ যেমন লেবুর রস প্রভৃতি যোগ করলেই দুধের কেজিন প্রোটিন জমাট বেঁধে যায়। জমাট বাঁধা অংশটুকুই ছানা হিসেবে পনির তৈরির জন্য অপরাসারণ করা হয়। অবশিষ্ট তরল পদার্থই ঘোল। মাঠায় চিনি, মসলা যোগ করা হয় বলে ঘোল থেকে একটু আলাদা।

দুধ – ৩ লিটার, চিনি – ৪ টেবিল চামচ, পেস্তা বাদাম বাটা – ৩ টেবিল চামচ, লবণ- পরিমাণমতো, বরফ কুচি- পরিমাণমতো

একসময় ঘোল সবার কাছে যতটা পরিচিত ও প্রিয় ছিল বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে ঘোল অতটা পরিচিত নয়। সবার কাছে দই খুব পরিচিত। তবে কিছু কিছু অঞ্চলে এখনও গোয়ালারা ঘোল নিয়ে বের হয়।

তবে বাঙালির অস্তিত্বের শেকড়ের সাথে মিশে রয়েছে ঘোষ ডেইরি বা ঘোষ সম্প্রদায়ের মিষ্টির দোকান। খুলনা, যশোর, বাগেরহাট-দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোসহ দেশের অনেক জেলার মিষ্টির দোকানে সুস্বাদু ঘোল(মথিত দধি) মানুষের রসনার তৃপ্তি মিটিয়ে যাচ্ছেন।