চালকুমড়ার উপকারীতা: চালকুমড়া খান, বয়স ধরে রাখুন।
গোটা বিশ্বের সকল বাঙালীর খুবই পছন্দের একটি সবজি হলো চালকুমড়া। আগে ঘরের চালে এই সবজি লাগানো হতো বলে এটি চালকুমড়া নামে পরিচিত।
চালকুমড়া তরকারি হিসেবে খাওয়া ছাড়াও মোরব্বা, হালুয়া, পায়েস ও কুমড়োবড়ি তৈরি করে খাওয়া যায়।
চালকুমড়া ভাজি, ঘন্ট, নিরামিষ বিভিন্ন পদ শুধু নয়, চিংড়ী মাছ, নোনা ইলিশ মাছ সহ বিভিন্ন মাছ দিয়ে খেতে খুব মজা লাগে। চালকুমড়ার হালুয়া, চালকুমড়ার মোরব্বা, চালকুমড়ার দুধ মোরব্বা বাচ্চাদের খুবই পছন্দের খাবার।
শুধু চালকুমড়াই নয় এর কচি পাতা ও ডগা শাঁক হিসেবে খাওয়া যায়। চালকুমড়া একটি পুষ্টিকর সবজি। এতে বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, মিনারেল, শর্করা ও ফাইবার রয়েছে, তাই চাল কুমড়ার উপকারীতা অনেক।
চালকুমড়া বিভিন্ন হজমজনিত, মানসিক এবং মূত্রথলির সমস্যাযুক্ত রোগীদের জন্য খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। মুখের ত্বক এবং চুলের যত্নেও চাল কুমড়ার রস অনেক সাহায্য করে।
চালকুমড়ার রস নিয়মিত চুল ও ত্বকে মাখলে চুল চকচকে হয় এবং ত্বক সুন্দর হয়, বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করতেও চাল কুমড়া সাহায্য করে।
চালকুমড়া কোথায় বেশি জন্মায়:
তবে চালকুমড়া শুধু চালে নয় এই সবজি এখন মাচায় এবং জমিতে চাষ করলেও ফলন ভাল হয়। এখন বিশেষতঃ মাছের ঘেরের ভেড়ির উপর গাছ লাগিয়ে ঘেরের পাড় দিয়ে মাচা বানিয়ে চাষ করা হয়।
ওয়াক্স গার্ড (Wax gourd) বা চালকুমড়া এখন প্রায় সারাবছর ধরে বাজারে পাওয়া যায়। এর পাতা বড় এবং ফুল হলুদ রঙের। গাএ বা খোসা সবুজ, লোমশ পৃষ্ঠ এবং গুঁড়ো সাদা পদার্থের একটি স্তর থাকে।
চালকুমড়ার বিভিন্ন পরিচিতি:
বাংলায় সাঁচি কুমড়া, চুণা কুমড়া, সাদা কুমড়া, গিমি কুমড়া, ডিমি কুমড়া প্রভৃতি নামে পরিচিত হলেও এটি চালকুমড়া বা জালিকুমড়া হিসেবে জনপ্রিয়।
উদ্ভিদতত্ত্বিক নাম Benincasa cerifera। চালকুমড়ার ইংরেজী নাম “Wax Gourd” বা “Ash Gourd” এবং বৈজ্ঞানিক নাম Benincasa hispida।
চালকুমড়া এক ধরণের কোমল কান্ডবিশিষ্ট বর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ। এর কান্ড দৃঢ় হালকা, সবুজ, লোমে আবৃত। চালকুমড়া ফল কিছুটা লম্বাটে গোলাকার।
এটি কচি অবস্থায় তীক্ষ্ণ লোমে আবৃত হলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে লোম ঝরে পড়ে এবং আলাদা মোমের একটা আস্তরণ সৃষ্টি হয়।
চালকুমড়ার ইতিহাস :
চালকুমড়া সম্ভবত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোনো স্থানে উৎপত্তি হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলে চাষ হয়ে আসছে। প্রাচীন ভারতীয় ও চীনা সাহিত্যে এর উল্লেখ আছে।
এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের জঙ্গলে চাল কুমড়া জন্মে থাকে।
চালকুমড়ার ব্যবহার:
কচি অবস্থায় সবজিরূপে এবং পাকা অবস্থায় মোরব্বা, হালুয়া ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
চালকুমড়ার জাত:
দুই ধরণের কুমড়া দেখা যায়।
- ডিম্বাকার জাত
- লম্বাটে জাত
চালকুমড়ার পুষ্টিগুণঃ
চালকুমড়া নানা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম চালকুমড়ায় রয়েছে –
- খাদ্যশক্তি: ১৩ কিলোক্যালরি
- আমিষ: ০.৪ গ্রাম
- ফাইবার: ২.৯ গ্রাম
- ভিটামিন সি: ১০.১ মিলিগ্রাম
- পটাশিয়াম: ১৫০ মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: ১১ মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: ২৬ মিলিগ্রাম
- সোডিয়াম: ২ মিলিগ্রাম
- কোলেস্টেরল: ০ মিলিগ্রাম
- আয়রন: ০.২ মিলিগ্রাম
- জিংক: ০.৭ মিলিগ্রাম
- ফসফরাস: ১৩ মিলিগ্রাম
চলুন জেনে নেয়া যাক আরও কিছু উপকারীতা:
পাকস্থলীর আলসার :
আলসারেটিভ কোলাইটিসের মতো পরিস্থিতিতে পেপটিক আলসার নিরাময়ে চালকুমড়া খুবই উপকারী। এটি হজমে খুবই সহায়ক তাই প্রায়শই হজমজনিত অসুস্থ্যতায় চিকিৎসকরা চালকুমড়া খেতে সুপারিশ করেন।
এটি অত্যন্ত ক্ষারীয় এবং শরীর ঠান্ডা করে। মানবদেহে এর দারুন শীতল প্রভাবগুলির কারণে যারা হার্ট বার্ন বা অ্যাসিডিটিতে ভোগেন তাদের জন্য উপযুক্ত একটি খাবার এটি।
চাল কুমড়া এন্টি মাইক্রোবিয়াল এজেন্ট হিসাবে পেট এবং অন্ত্রের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে। এটি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ইনফেকশন বা আলসার রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
এটি মসলাযুক্ত খাবার বা দীর্ঘদিনের জন্য উপবাসের কারণে পাকস্থলিতে তৈরি হওয়া এসিড দূর করতে সাহায্য করে।
প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক গ্লাস চালকুমড়ার রস পানি মিশিয়ে পান করুন। এটির 1-2 ঘন্টা পরে আপনার প্রথম খাবার খান। ভাত বা রুটির সাথে চালকুমড়ার তরকারি সবজি হিসাবে খাওয়ার চেষ্টা করুন।
মানসিক অসুখঃ
চালকুমড়া একটি খুবই স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর সবজি। ক্ষারযুক্ত খাবার হিসাবে পরিচিত হওয়ার কারণে চাল কুমড়া স্বাস্থ্যের অসুস্থতা যেমন মানসিক অবসন্নতা, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, হতাশা, মাইগ্রেন ইত্যাদিতে খুব ভাল করে।
আয়ুর্বেদ এটিকে মস্তিষ্কের খাদ্য বা ব্রেইন ফুড হিসাবে অভিহিত করেছেন এবং এটি পুনরুদ্ধারের বৈশিষ্ট্যগুলির জন্য পরিচিত। যাঁরা স্ট্রেসে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন তাদের ডায়েটে এটি অবশ্যই রাখা উচিত।
এটি মানসিক শক্তিকে সাম্যবস্তায় আনায়ন করে করে এবং মনকে শিথিল করে। চাল কুমড়া মানসিক রোগীদের জন্য পথ্য হিসেবে কাজ করে, কারন এটি ব্রেইন এর নার্ভ ঠাণ্ডা রাখে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ :
যাদের মূত্রনালীর সংক্রমণ রয়েছে বা প্রস্রাবে অসুবিধা রয়েছে তাদের জন্য চালকুমড়া খুব উপকারী।
আয়ুর্বেদের মতে, লাউ শরীরে পিত্ত দোষ ভারসাম্য করে এবং শীতল প্রভাব সরবরাহ করে। এটি পাথর ভাঙ্গতে এবং সহজেই তা সরিয়ে ফেলতে সহায়তা করে।
ঝলমলে ত্বক এবং চুল :
চালকুমড়ার বিস্ময়কর স্বাস্থ্য উপকারের পাশাপাশি এটি সৌন্দর্য বর্ধনেও আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করে। একটি পাত্রে কিছুটা পরিমানে চালকুমড়ার রস নিন।
এতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশ্রিত করুন এবং কটন সোয়াব দিয়ে মুখে লাগান। কিছুক্ষণ রেখে ধুয়ে ফেলুন। এটি মুখের ত্বকে তাত্ক্ষণিক গ্লো সরবরাহ করে।
এছাড়া চালকুমড়ার বীজে ওলিক অ্যাসিড থাকে, যা ভিভোতে মেলানিন জমানোর কাজ করে এবং এতে ময়শ্চারাইজিং এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করার প্রভাব রয়েছে।
এছাড়াও, চালকুমড়ার বীজে প্রোটিন থাকে এবং সিট্রুলাইন ত্বককে ময়শ্চারাইজ করতে পারে তবে মেলানিন গঠনে বাধা দেয়।
চুলের জন্য বলতে পারি এটি খুশকির জন্য কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার হিসাবে কাজ করে। তুলা বা আঙ্গুলের টিপসের সাহায্যে আপনার মাথার তালু এর রস প্রয়োগ করুন এবং ম্যাসাজ করুন।
1 থেকে 2 ঘন্টা রেখে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন। চিরকালের জন্য খুশকি থেকে মুক্তি পেতে সপ্তাহে এই 2 থেকে 3 বার অনুশীলন করুন।
যক্ষা সারায় ও রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখে :
প্রতিদিন চাল কুমড়ার রস খেলে যক্ষ্মা রোগের উপসর্গ কেটে যায়। চাল কুমড়া রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করে।
এটি রক্ত নালীতে রক্ত চলাচল সহজতর করে।
ফ্যাট হ্রাস এবং ওজন হ্রাস :
চালকুমড়া শরীরের ওজন ও মেদ কমাতে অনেক উপকারী একটি সবজি।
চালকুমড়াতে প্রোপেনিডেওিক(Propanedioic) অ্যাসিড পাওয়া যায়। এটি দেহে চর্বি জমে যাওয়া রোধ করতে পারে। চালকুমড়াতে ডায়েটারি ফাইবারের পরিমাণ খুব বেশি, যা মানব দেহের রক্তে শর্করার স্তরকে কার্যকরভাবে উন্নত করতে পারে।
এছাড়া ডায়েটরি ফাইবার শরীরের কোলেস্টেরলও কমিয়ে দিতে পারে, রক্তের লিপিড হ্রাস করতে পারে, এথেরোস্ক্লেরোসিস প্রতিরোধ করতে পারে।
এছাড়া চাল কুমড়ার বিচি গ্যাস্ট্রিক রোগের উপশম করে। কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা এবং প্রস্রাব কোন কারণে অনিয়মিত হয়ে গেলে চাল কুমড়া খেলে অনেক উপকার হয়।
চালকুমড়া মস্তিষ্কের স্নায়ু ঠান্ডা রাখে। যাদের কাশের সঙ্গে রক্ত বের হয়, চালকুমড়ার রস খেলে ভালো হয়। চালকুমড়া অধিক ক্যালরিযুক্ত খাবারের বিকল্প হিসেবেও খাওয়া যায়।