খেজুরের রস শক্তি যোগায়, পানি শুন্যতা দূর করে ও হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে।
একঘেয়েমি, অস্বস্তিকর যান্ত্রিকতার জীবনে অনেক পরিবর্তন এনে শীত তার বিচিত্র রূপ ও রস নিয়ে হাজির হয় আবহমান গ্রাম বাংলায়।
শীতের নীরবতায় প্রাণ জুড়ানো সৌন্দর্যে বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রামীণ সংস্কৃতির এক শৈল্পীক ঐতিহ্যে হিসাবে বিবেচিত হয় খেজুরের রস বা খেজুর গাছ।
শীতের ভোরে ঘুম ভেঙে খেজুরের রস। আহা শৈশবের সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
বাংলায় খেজুরের রস, ইংরেজিতে Date sap বা khejur Ras-শীতের সময়ে খেজুর গাছ অর্থাৎ Date or Date palm থেকে প্রাপ্ত মিষ্টি রস।
এটি বাঙালির শীতের প্রতীকী এবং সমার্থক। এই খেজুরের রস গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি শহুরে মানুষের কাছে বিখ্যাত খাবার।
সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, একটু দূরে দেখতে না পাওয়া, কুয়াশার চাদরে ঢাকা শীতের সকালে এইমাত্র গাছ থেকে নামানো এক গ্লাস খেজুরের রসের কোনো তুলনা হয় না।
মধুবৃক্ষ বললেও হয়তো ভুল হবে। এর রস কাঁচা বা জ্বাল দিয়ে খেতে যেমন সুস্বাদু ও পুষ্টিকর তেমনি পুষ্টিকর এর রস থেকে তৈরি গুড় এবং পাটালি।
Arecaceae-পরিবারের এই উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera/ sylvestris (ফিনিক্স ড্যাকটিলিফেরা). একটি খেজুর গাছ ৫ বছর বয়স থেকে রস উৎপাদন শুরু করে।
খেজুরের রসের পরিমান, এর মিষ্টত্ব ইত্যাদির পরিমাণ মাটি, জলবায়ু এবং খেজুর গাছের ধরণের উপর নির্ভর করে।
প্রধানত পুরুষ খেজুর গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে খেজুরের রস বেশি দেয়।
খেজুরের রসের উপকারিতা বা স্বাস্থ্যসুবিধা
কিছুদিন পরই গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে গুড়-পাটালি তৈরির উৎসব।
গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস জ্বালিয়ে পিঠা, পায়েস, মুড়ি-মুড়কী ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়বে।
তারপর পৌষমাসে পিঠা তৈরি করা খেজুরের রস দিয়ে, যাকে রস পিঠা বা দুধ চিতয় পিঠা বলা হয়।
নলেন, ঝোলা ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধ ভোজন। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকে চিনি তৈরি করা হতো।
এই চিনি ‘ব্রাউন সুগার’ নামে পরিচিত ছিল। এই চিনি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো।
শক্তি যোগায়:
খেজুরের রসে উচ্চ প্রাকৃতিক চিনি বিদ্যমান। আপনি কাঁচা অথবা কিছুক্ষণ আগুনে জ্বাল দিয়ে ফুটিয়ে খেতে পারেন।
যেহেতু উচ্চ প্রাকৃতিক চিনি বা গ্লুকোজ বিদ্যমান তাই একে শক্তির পাওয়ার হাউস বা শক্তির ভান্ডার বলা যায়।
যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না, খেজুরের রস তাঁদের জন্য দারুণ উপকারী।
পানিশুন্যতামুক্ত রাখে:
শীতের শুস্কতা, রুক্ষতা আপনাকে কি কষ্ট দিচ্ছে? আপনার ত্বক অথাৎ আপনার চেহারায় মলিন ভাব ফুটিয়ে তুলেছে। আর চিন্তা করবেন না।
খেজুরের রসে জলীয় অংশ এতো বেশি যে, এই শীতে আপনাকে হাইড্রেট রাখতে খেজুরের রস একাই একশো।
মন মেজাজ ভালো রাখে:
খেজুরের রস খুবই লোভনীয়। এই রসে পিঠা ডুব সাঁতার দিক বা রস দিয়ে তৈরি অন্য কোনো খাবার (নলেন গুড়ের রসগোল্লা, নলেন গুড়ের সন্দেশ, মুড়ির মোয়া) রসের গন্ধে খাবারের লোভ বেড়ে যাই আরো কয়েকগুন।
খেজুর গাছের বুক চিরে বেরিয়ে আসা এই অমৃত রস শর্করা, প্রোটিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ। শীতের এই সময়ে আপনার মন ভালো করে দিবে খেজুরের রস।
হিমোগ্লোবিন বাড়ায়:
শরীরে আইরনের অভাব ঘটলে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হয় ফলে নানারকম শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
খেজুরের রস বা গুড়ে প্রচুর পরিমানে আইরন থাকে। এটি হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে।
রক্তচাপ কমায়:
খেজুরের রসে রয়েছে সোডিয়াম, পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম যেটি আমাদের রক্তচাপ কমায় ও হাড় শক্ত করে।
শীত এলেই মনে হয় খেজুরের রস খাওয়ার কথা। শহরের দিকে এ রস পাওয়া সত্যি বিরল। গ্রামাঞ্চলেও আজকাল সহজে দেখা মেলে না এ রসের।
মিলবে কিভাবে, দিন দিন খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে। খেজুর গাছ কেটে ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে দেদারছে। আসুন আমরা খেজুর গাছ ধংস করা বন্ধ করি।
নতুন করে বেশি বেশি গাছ লাগাই। তাহলে সমৃদ্ধ হবে আমাদের পরিবেশ। সমৃদ্ধ হবে আমাদের অর্থনীতি।
সতর্কতাঃ
বাদুড় থেকে সুরক্ষা:
যেহেতু এই অমৃত সরবত খুব মিষ্টি, নিপা ভাইরাস বাহক বাদুড়গুলি খেজুরের রস পান করতে পছন্দ করে। সুতরাং নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে যেতে পারে এই কাঁচা রসের মাধ্যমে।
বাদুড়কে রস দূষিত করতে বাধা দিতে মাটির পাত্রে এবং গাছের নরম ট্রাঙ্কের অংশে একটি জাল ব্যবহার করুন যাতে বাদুড় রসে মুখ দিতে না পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের খেজুরের রস এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো করবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে করবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।
আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করলে বা বিভিন্ন ওষুধ গ্রহণ করলে অবশ্যাই আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।
সূত্রঃ
wiki, The daily star