গর্ভাবস্থায় ঘুম। গর্ভবতী মায়েদের ঘুমের কেনো সমস্যা হয়। পরিত্রাণের উপায়।

দিনে ঘুমানোর কারণে হয়তো রাতে ঘুম হচ্ছে না। এই কারণে অনেক গর্ভবতী মা দিনে বিশ্রামে থাকেন কিন্তু ঘুমান না। তারপরও দেখা যাই, রাত ১টা, ২টো, ৩টে- ঘড়ির কাঁটা এগিয়েই চলেছে, এদিকে ঘুমের কোনো দেখা নেই।

গর্ভকালে অনিদ্রা আর কয়েকটা সমস্যার বা উপসর্গের মধ্যে একটি। এতে ভয়ের কিছু নেই। হরমোনের নাটকীয়তা আর শারীরিক নানা সমস্যার জন্য গর্ভাবস্থায় ঘুমের এই সমস্যা হবেই।

আর এসবের সাথেই উড়ে এসে জুড়ে বসবে হবু মায়ের মানসিক দুশ্চিন্তা, সন্তানকে নিয়ে উত্তেজিত থাকা, ক্রমাগত বাথরুমে যাওয়া আসা-এবং আরও নানা সব সমস্যা। আর এসবের জেরেই রাতের পর রাত ঘুমহীন বা সামান্য একটু ঘুম নিয়ে কাটে গর্ভবতী মায়েদের।

ঘুম ছোটার কারণ যা-ই হোক, এটা মাথায় রাখবেন অনিদ্রা বা insomnia আপনার গর্ভস্থ শিশুর জন্য ক্ষতিকর নয়। গর্ভকালে অনিদ্রা আর পাঁচটা উপসর্গের মতোই স্বাভাবিক। ১০০ জনের ভিতর ৭৮জন হবু মায়েরই এমন সমস্যা হয়।

প্রত্যাশিত পিতা-মাতারা জানেন যে, তাদের ছোট্টটি গর্ভে যত বড় হতে থাকবে তত রাতে ভাল ঘুমানো আরও কঠিন হবে। আসলে, আপনি আপনার গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিকের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ঘুমাতে পারেন।

আপনার দেহ বিকাশমান শিশুকে সুরক্ষা এবং লালনপালন করতে কাজ করায় ক্লান্তি বোধ করা স্বাভাবিক। প্ল্যাসেন্টা (জন্মের আগে পর্যন্ত ভ্রূণের পুষ্টি জাগানো অঙ্গ) সবেমাত্র তৈরি হচ্ছে, আপনার শরীর আরও রক্ত তৈরি করছে এবং আপনার হৃদয় দ্রুত পাম্প করছে।

গর্ভবতী মহিলার কত ঘন্টা ঘুমানো উচিত?

ঘুম একটি প্রয়োজনীয়তা – বিশেষত আপনি যখন গর্ভবতী হন।  “গর্ভবতী মহিলার কত ঘন্টা ঘুমানো উচিত?” এই প্রশ্নের উত্তরে, বেশিরভাগ চিকিৎসকেরা প্রতি রাতে আট(৮) থেকে দশ(১০) ঘন্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেন।

ঘুম কেনো কমে যায় বা কঠিন হয়ে যায়:

গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যার পিছনে প্রথম এবং সবচেয়ে চাপের কারণটি হল ভ্রূণের ক্রমবর্ধমান আকার, যা একটি আরামদায়ক ঘুমের অবস্থান খুঁজে পাওয়া শক্ত করে তোলে।

এছাড়াও, গর্ভাবস্থার অগ্রগতির সাথে সাথে অর্থাৎ বাচ্চার ওজন বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিছানায় ঘোরাফেরা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।

অন্যান্য সাধারণ শারীরিক লক্ষণগুলি ঘুমের মধ্যেও হস্তক্ষেপ করতে পারে:

ঘন ঘন প্রস্রাব করার তাগিদ:

আপনার কিডনি আপনার শরীরের মধ্য দিয়ে রক্তের ক্রমবর্ধমান পরিমাণকে ফিল্টার করার জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করছে এবং এই ফিল্টারিং প্রক্রিয়াটি আরও প্রস্রাব তৈরি করে।  আপনার বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে জরায়ু বড় হয়ে ওঠে এবং আপনার মূত্রাশয়ের উপর চাপ বাড়তে থাকে। এর অর্থ বাথরুমে দিনরাত আরও বেশি ভ্রমণ। বাচ্চা যদি রাতে বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে তবে রাত্রে ভ্রমণের সংখ্যা বেশি হতে পারে।

বর্ধিত হৃদস্পন্দন:

আপনার হার্টের হার আরও রক্ত ​​পাম্প করার জন্য বৃদ্ধি পায় এবং আপনার রক্ত ​​সরবরাহের বেশিরভাগ জরায়ুতে যাওয়ার সাথে সাথে আপনার হৃদয় আপনার শরীরের বাকি অংশে পর্যাপ্ত রক্ত ​​প্রেরণে আরও কঠোর পরিশ্রম করে।

নিঃশ্বাসের দুর্বলতা:

গর্ভাবস্থার হরমোনের বৃদ্ধি আপনাকে আরও গভীরভাবে শ্বাস নিতে বাধ্য করবে। আপনার মনে হতে পারে আপনি বাতাস পেতে আরও পরিশ্রম করছেন। পরবর্তীতে, আপনার বিস্তৃত জরায়ু আরও স্থান গ্রহণ করার কারণে শ্বাস প্রশ্বাস আরও কঠিন অনুভূত হতে পারে যার ফলে আপনার ডায়াফ্রামের উপর চাপ পড়ে (আপনার ফুসফুসের ঠিক নীচের পেশী)।

লেগ ক্র্যাম্প এবং পিছনে ব্যথা:

আপনি যে অতিরিক্ত ওজন বহন করছেন তার জন্য আপনার পা বা পিছনে ব্যথা হতে পারে। গর্ভাবস্থায়, শরীর রিলকসিন নামে একটি হরমোনও তৈরি করে, যা এটি প্রসবের জন্য প্রস্তুত করতে সহায়তা করে। রিলজিনের অন্যতম প্রভাব হল পুরো শরীর জুড়ে লিগামেন্টের শিথিলতা, গর্ভবতী মহিলাদেরকে কম স্থিতিশীল করে তোলে এবং বিশেষত তাদের পিঠে ব্যথা হয়।

গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস (১-১২ সপ্তাহ)- গর্ভবতী মহিলাদের ঘুম কম হয় বিশেষ করে দিনের বেলায় প্রায়ই চোখে ঘুম ঘুম ভাব থাকে। শরীর ক্লান্ত থাকে এবং ঘুমের পরিমাণও বাড়তে থাকে। বারবার বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, যার ফলে একটানা ঘুম ব্যাহত হয়। নানাপ্রকার শারীরিক ও মানসিক চাপের ফলে মনের ভিতরে অজানা আশঙ্কা, ভয়, উত্তেজনা তৈরি হয়। এর ফলেও ঘুমের মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

গর্ভকালীন দ্বিতীয় তিন মাস (১৩-২৭ সপ্তাহ)- এসময় গর্ভবতী মহিলারা প্রথম তিন মাসের তুলনায় কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেন। রাতের বেলায় বাথরুমে কম যেতে হয় বলে এসময় ঘুমের অনেকটাই উন্নতি ঘটে। তবে এতটাও আনন্দের কিছু নেই। গর্ভে বাড়ন্ত ভ্রূণের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ও মানসিক অবসাদ ঘুমের পরিমাণকে কমিয়ে দিতে পারে।

গর্ভকালীন তৃতীয় তিন মাস (২৮-৪০ সপ্তাহ)- তৃতীয় তিন মাসে অর্থাৎ গর্ভের ৭-৯ মাসে গর্ভবতী মায়েদের রাতে হাঁটার ও অনিদ্রার পরিমাণ অনেক গুণে বেড়ে যায়। বেশিরভাগ মহিলাদের এসময় রাতের বেলায় কমপক্ষে ৩-৫ বার ঘুম ভেঙে যায়, যার কারণ বারবার বাথরুমে যাওয়া ও পিঠ ব্যথা। এছাড়াও গর্ভস্থ বাচ্চার ক্রমাগত নড়াচড়া মূত্রস্থলীতে চাপ দেয় ফলে ঘনঘন প্রস্রাবের চাপ পড়ে। গর্ভকালীন শেষের কয়েক সপ্তাহে ঘুমের মধ্যে নানা দুঃস্বপ্নও এর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

কীভাবে ঘুম আনবেন চোখে (How To Deal With Insomnia During Pregnancy):

ঘুমের রুটিন তৈরি করুন (Have a routine for sleep):

গর্ভাবস্থায় ঘুমের একটা রুটিন মানে সর্বদা নির্দিষ্টি সময়ে ঘুমাবেন। দুপুরে একটু বিশ্রাম নিন। এরপর একটু হাঁটাহাঁটি করলেন। আবার বিকালে বা সন্ধ্যার পরে আবার একটু বিশ্রাম নিন।  দিনে  ঘুমানোই ভালো তাহলে রাতে ভালো ঘুম হবে।

সন্ধ্যার পর জল কম খান (Drink less water after evening):

দিনভর যতখুশি জল খান। সন্ধে হতেই কমিয়ে আনুন পরিমাণ। জল কম খেলে প্রস্রাব কম হবে, গর্ভবতী মা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমাতেও পারবেন। ক্যাফেইন অর্থাৎ চা-কফি খাওয়া কমিয়ে দিন।

হাতের কাছে কিছু খাবার রাখুন (Always keep some food near you):

সারাদিন যাই খান না কেন রাতে অবশ্যই আপনার কাছে হালকা, কিন্তু স্বাস্থ্যকর এমন কিছু খাবার মজুদ রাখুন। যেমন তাজা ফলমূল, চিজ, সিদ্ধ ডিম, হেলদি স্ন্যাকস ইত্যাদি। খিদে পেলে এগুলো কিছুটা খেয়ে শুয়ে পরুন, দেখবেন চট করে ঘুম চলে আসছে।

 বাঁ দিক ফিরে শোয়া (Turn to your left while sleeping):

কিছু চিকিৎসক বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের বাম দিকে ঘুমানোর পরামর্শ দেয়।  কারণ আপনার লিভারটি আপনার পেটের ডানদিকে রয়েছে, আপনার বাম পাশে শুয়ে থাকা জরায়ুটিকে অর্থাৎ সেই বৃহত অঙ্গটি দূরে রাখতে সহায়তা করে। বাম দিকে ঘুমানো হৃদযন্ত্রের সঞ্চালনও উন্নত করে এবং ভ্রূণ, জরায়ু এবং কিডনিতে সেরা রক্ত ​​প্রবাহের অনুমতি দেয়। আপনার ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞাসা করুন তিনি কী পরামর্শ দেন।

ব্যায়াম করুন প্রতিদিন (Exercise regularly):

নিয়মিত ব্যায়াম করুন। এতে শরীর-মন দুটোই ভালো থাকবে। নিয়মিত ব্যায়াম করলে তা গভীর ঘুমের জন্য খুবই সহায়ক। তবে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ব্যায়াম না করাই ভালো। সেই সঙ্গে গর্ভবতী মায়েরা কোনও ভারী ব্যায়াম করবেন না।  যোগ ব্যায়াম করতে পারেন, এতে অন্য উপকারের পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা মোকাবিলায় উপকার পাবেন।

খাওয়ার পরপরই না শোয়া (Gap between dinner and bedtime):

গর্ভাবস্থায় আপনি যা-ই খান না কেন, তা হজম হতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই এ সময় খাওয়ার পর অন্তত চার ঘণ্টা না শোওয়াই ভালো। অ্যাসিডিটির ধাত থাকলে সকালে বেশি খেয়ে রাতে কম খেলে এই অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

ভাজা-পোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন (Avoid fried and tandoori food items):

হয়তো চানাচুর আপনার খুব পছন্দের। প্রায়ই খেয়ে থাকেন। বিকালে একটু তেলে ভাঁজা পেঁয়াজু, বেগুনি বা মসলাদার অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বন্ধু, মা হতে গেলে এইটুকু আত্মত্যাগ তো করতেই হবে আপনায়। নিজের শরীর, নিজের ঘুম, সর্বোপরি পুঁচকেটার খাতিরে ভাজা পোড়া খাবার পরিহার করুন এবং বেশি মশলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।

কফি-চকলেট বর্জন করুন (Avoid caffeine and chocolate):

চোখে ঘুম চাইলে চকলেট-কফির প্রতি ভালোবাসা আপনাকে বর্জন করতেই হবে। এগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। ফলে ভালো ঘুম হয় না। চা-টা খেলেও খেতে পারেন, তাও সকালের দিকে খাওয়াই ভালো। সন্ধের পর চায়ের কাপে চুমুক অনিদ্রার কারণ হতে পারে।

শোওয়ার ভঙ্গি বদলে ফেলুন (Change your sleeping position):

আরামদায়ক ঘুমের অবস্থানটি আবিষ্কার করতে বালিশ দিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করুন। কিছু মহিলা পেটের নীচে বা পায়ে একটি বালিশ স্থাপন করে আরাম পেয়ে থাকেন। এছাড়াও, আপনার পিছনের অংশে একটি কুঁচকানো বালিশ বা রোলড আপ কম্বল ব্যবহার করা কিছু চাপ থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করতে পারে।

আসলে, আপনি বাজারে অনেকগুলি “গর্ভাবস্থার বালিশ” দেখতে পাবেন। যদি আপনি একটি কেনার কথা ভাবছেন তবে প্রথমে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন যা আপনার পক্ষে কার্যকর। দুই হাঁটুর মাঝে বালিশ থাকলে আপনার হিপ ও পেলভিস-এর পেশীর ওপর চাপ কম পড়বে।

হাঁসি-খুশি থাকুন সর্বক্ষণ (Always be happy):

দেখুন, গর্ভকালে হরমোনের নাচানাচিতে মন-মেজাজ বিগড়ে যেতে বাধ্য। তা-ও বলব যতটা পারেন, মন ফুরফুরে রাখার চেষ্টা করুন। শোওয়ার আগে আরাম পেতে হালকা গরম জলে গা ধুয়ে নিতে পারেন অথবা ক্যাফাইন ছাড়া পানীয় যেমন হালকা গরম দুধ খেতে পারেন।

এরপরেও কাজ না হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। গর্ভাবস্থায় ঘুমের সমস্যা অন্যতম বড় আর জটিল সমস্যা। তাই মাকে নিজে এবং কাছের সব মানুষদের তাঁর ঘুমের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় একজন মায়ের ও শিশুর শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। গর্ভবতী মা যদি ভালোভাবে ঘুমাতে না পারেন তবে এই সমস্যাই মাতৃত্বের জন্য নিজেকে তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুস্থ মা-ই সুস্থ শিশুর জন্ম দেন। সুতরাং এ বিষয়ে সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।

যখন আপনি ঘুমাতে পারবেন না

অবশ্যই, এমন সময় থাকতে পারে যখন আপনি কেবল ঘুমাতে পারবেন না। টসিং এবং টার্নিংয়ের পরিবর্তে, আপনি ঘুমাচ্ছেন না এমন চিন্তা করে এবং আপনার অ্যালার্ম ক্লকটি বন্ধ না হওয়া অবধি কয়েক ঘন্টা গণনা করুন, উঠে পড়ুন এবং কিছু করুন: একটি বই পড়ুন, গান শুনুন, টিভি দেখুন, চিঠিগুলি বা ইমেলটি ধরুন, বা আপনি উপভোগ করেন এমন কিছু অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ অনুসরণ করুন। অবশেষে, আপনি সম্ভবত ঘুম ফিরে পেতে যথেষ্ট ক্লান্ত বোধ করবেন।

সূত্রঃ

https://kidshealth.org/en/parents/sleep-during-pregnancy.html