ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ কেন হয়?
ডায়াবেটিস কী?
যখন আমাদের রক্তের গ্লুকোজ অর্থাৎ রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় তখন সেটাকে আমরা ডায়াবেটিস বলে থাকি। রক্তের গ্লুকোজ আমাদের শরীরের শক্তির প্রধান উৎস। আমরা যেসব খাবার খাই সেসব খাবার থেকেই এই গ্লুকোজ পেয়ে থাকি।
ইনসুলিন একটি হরমোন যেটা অগ্ন্যাশয় (pancreas) থেকে উৎপন্ন হয়। এই ইনসুলিন খাবার থেকে প্রাপ্ত গ্লুকোজকে ভেঙে শক্তি উৎপন্ন করে যা, আমাদের শরীরের কোষ দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
কখনও কখনও আমাদের শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। গ্লুকোজ তখন আমাদের রক্তে থাকে এবং আমাদের কোষেও পৌঁছায় না। রক্তে খুব বেশি গ্লুকোজ থাকা স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ
আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যদিও ডায়াবেটিসের কোনও নিরাময় নেই, আমরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং সুস্থ্য থাকার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারি।
বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ডায়াবেটিস এর মাত্রা:
মানুষের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ সাধারণত
অভুক্ত অবস্থায় | খাবার পর |
---|---|
৩.৩ থেকে ৬.৯ মিলি.মোল/লি | <৭.৮ মিলি.মোল/লি |
ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
অভুক্ত অবস্থায় | খাবার পর |
---|---|
৭ মিলি.মোল/লি | >১১ মিলি.মোল/লি |
অর্থাৎ মানুষের রক্তে যদি গ্লুকোজের পরিমাণ অভুক্ত অবস্থায় ৭ মিলি.মোল/লি আর খাবার পর >১১ মিলি.মোল/লি পাওয়া যায়, তবে তার ডায়াবেটিস আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস বললে সাধারাণতঃ ডায়াবেটিস মেলিটাস বোঝায়।
বাংলাদেশে ও ভারতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা:
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭ মিলিয়ন বলে বলছে ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশন। ভারতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭৩ মিলিয়ন। কিন্তু যারা আক্রান্ত তাদের ৫৭ শতাংশই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগের প্রকারভেদ:
ডায়াবেটিস তিন ধরনের:
- টাইপ-1 ডায়াবেটিস
- টাইপ-2 ডায়াবেটিস
- এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।
টাইপ-1 ডায়াবেটিস
টাইপ-1 ডায়াবেটিস হলে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তাই টাইপ-1 ডায়াবেটিস রোগীদের দেহে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় খুবই কম। এ জন্য রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। টাইপ-1 ডায়াবেটিস মূলত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। এর জন্য দায়ী হল HLADR 3 এবং HLADR 4 নামক দুটি জিন।
টাইপ-2 ডায়াবেটিস
টাইপ-2 বহুমূত্র রোগের পেছনে থাকে মূলত ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’। টাইপ-2 রোগীর শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়, তাকে ব্যবহার করতে পারে না। ব্যায়াম ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ঔষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন। ৪০ বছর বা তারপরে এ ধরনের বহুমূত্র রোগ দেখা দেয়।
মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পানীয় টাইপ-2 এর ঝুঁকি বাড়ায়। খাবারে চর্বির ধরণও গুরুত্বপূর্ণ স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স-ফ্যাটি এসিড ঝুঁকি বৃদ্ধি করে পক্ষান্তরে পলি-আনস্যাচুরেটেড ও মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ঝুঁকি কমায়। অত্যধিক পরিমাণ সাদা ভাত খাওয়াও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-2 ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। বিশ্বজুড়ে ২৪৬ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি হল টাইপ-2 ডায়াবেটিস।
গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস
কিছু মহিলারা গর্ভবতী হলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের বিকাশ ঘটে। বেশিরভাগ সময় এই ধরণের ডায়াবেটিস শিশু জন্মের পরে চলে যায়। তবে, যদি আপনার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয় তবে পরবর্তী জীবনে আপনার টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কখনও কখনও গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নির্ণয় করা হয় আসলে টাইপ-2 ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো
ডায়াবেটিস রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখলে সহজেই চিহ্নিত করা যায় ডায়াবেটিস। আর যত আগে ডায়াবেটিস চিহ্নিত করা যাবে, তখনই নিতে হবে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ। ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলো হলো:
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- তেষ্টা পাওয়া
- নিয়মিত খাওয়ার পরও ঘন ঘন খিদে
- প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত অনুভব করা
- চোখে ঝাপসা দেখা
- শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটাছেঁড়া সহজে সারে না
- খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া
- হাতে-পায়ে ব্যথা বা মাঝে মাঝে অবশ হয়ে যাওয়া
টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কার বেশি?
আপনার বয়স ৪০ বা তার বেশি, ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে বা ওজন বেশি হলে আপনার টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি আপনার টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও প্রভাবিত করে।
আপনার যদি গর্ভবতী হওয়ার আগে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকে তবে আপনার টাইপ-2 ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। টাইপ-2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলি সম্পর্কে আরও জানুন।
ডায়াবেটিসে স্বাস্থ্য সমস্যা
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর নিম্নলিখিত স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে:
- হৃদরোগ
- কিডনীর রোগ
- চোখের সমস্যা
- দাঁতের রোগ
- নার্ভ ক্ষতি
- পায়ের সমস্যা