চিরতা ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে ও অ্যালার্জি কমাতে সহায়তা করে।
চিরতা ঔষুধের মতো কাজ করে। “চিরতা” হলো Gentianaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এই গাছটি শুকিয়ে যাওয়ার পরে এর পাতা, কান্ড ও শিকড় আমরা পানিতে ভিজিয়ে খেয়ে থাকি।
এটি পাইলস, চর্মরোগ, জ্বর, কোষ্টকাঠিন্য, ক্যান্সার এবং ডায়াবেটিস নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
চিরতার ইংরেজি নাম Swertia chirata. চিরতা হলো এর ইউনানী নাম। “চিরতার” আয়ুর্বেদিক নাম হলো Kirata tikta. হিন্দিতে Chirayata বলে ডাকা হয়। এর কান্ড, পাতা, ফুল, ফল, শেকড় সবই কাজে লাগে।
সুপ্রাচীনকাল থেকে চিরতা ভারতবর্ষে যত্নসহকারে বিভিন্ন রোগ উপশমে ব্যবহার হয়ে আসছে।
ভারতবর্ষ হলো চিরতার আদিনিবাস। এর জন্মস্থান হলো হিমালয়ের পাদভূমি। ভারত থেকে এর আশপাশের এলাকা যেমনঃ নেপাল ও ভুটানে তা ছড়িয়ে পড়ে।
ভারতবর্ষ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এটি ইউরোপ প্রবেশ করে। প্রাচীন আয়ুর্বেদ ও চরক সংহিতায় এর উল্লেখ আছে। তিতা তো তিতা, সেইরকমের তিতা। তবে চিরতা তিতা হলেও খুবই উপকারী।
প্রসঙ্গতঃ উল্রেখ্য চিরতা ও কালমেঘ এই দুটো গুলিয়ে ফেলবেন না। চিরতা ও কালমেঘ আলাদা দুটি গাছ।
চিরতা কি লিভারের জন্য ভালো?
হ্যাঁ, চিরতা লিভারের জন্য ভালো। চিরতা-এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং লিভার-রক্ষামূলক ক্রিয়াকলাপগুলির কারণে যকৃতের পক্ষে ভাল।
অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টগুলি ফ্রি র্যাডিকালগুলির কারণে লিভারের কোষগুলিতে ক্ষয়ক্ষতি রোধ করতে এবং দেহ থেকে তাদের নির্মূল করতে সহায়তা করে।
চিরতার এন্টি-ইনফ্ল্যামেটরি বৈশিস্ট্য থাকার কারণে লিভারের প্রদাহও হ্রাস করে।
চিরতা কি ওজন কমাতে সহায়তা করে?
হ্যাঁ, চিরতা ওজন কমাতে সহায়তা করে। চিরতা ওজন হ্রাসে সহায়তা করে কারণ এটি বিপাক বৃদ্ধি করে এবং ক্যালোরি বার্ন করতে সহায়তা করে।
চিরতার স্বাস্থ্য উপকারিতা
গবেষণা করে দেখা গেছে, যারা নিয়মিত তিতা খাবার খান, তাদের অসুখ-বিসুখ হওয়ার প্রবণতা কম থাকে।
যে কোনো কাটা, ছেঁড়া, ক্ষতস্থান দ্রুত শুকায়। নিচে চিরতার স্বাস্থ্য উপকারিতা আলোচনা করা হল:
অ্যালার্জি নিরাময়ে:
অ্যালার্জির কারণে শরীর চুলকায়, ফুলে লাল হয়ে যায়, ত্বক থাকা থাকা হয়ে ওঠে। তাদের জন্য চিরতার রস দারুণ কার্যকরী।
শুকনো চিরতা ৪-৫ গ্রাম পরিমাণ এক গ্লাস গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরদিন ওটা ছেঁকে দিনের মধ্যে ২-৩ বারে খেতে হবে।
অনেকেরই মারাত্মক অ্যালার্জির সমস্যা থাকে। এছাড়াও ত্বকের অন্যান্য সমস্যাও নিয়ন্ত্রণ করে চিরতার পানি।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে:
চিরতা ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়িয়ে ডায়াবেটিস রোগীদের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে।
এক্ষেত্রে আগের দিন রাতে শুকনো চিরতা ৪-৫ গ্রাম পরিমাণ এক গ্লাস গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরদিন ওটা ছেঁকে সকালে খালি পেটে খেতে হবে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস বা টাইপ-২ ডায়াবেটিস যে কোন ধরণের ডায়াবেটিস রোগে চিরতা ভেজানো পানি খেলে উপকার পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিস রোগীদের সাথে তিতা খাবারের একটা বন্ধুত্ব এমনিতেই হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে চিরতার সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের বন্ধুত্ব অনেক দিনের।
কৃমি দূর করতে:
চিরতা শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলি মুক্ত করে লিভারের সুরক্ষা সরবরাহ করতে পারে। চিরতাকে পরজীবী বিরোধী হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
এটি দেহ থেকে roundwarm বা কেঁচোকৃমি এবং tapeworms বা ফিতাকৃমি দূর করতে পারে।
জ্বর সারাতে:
আমাদের অনেকের জ্বর হয় ঋতু পরিবর্তনে ফলে ঠান্ডা-গরম লেগে। এ অবস্থায় হাত-পা চিবোয় বা কামড়ায়। জ্বর সারাতে চিরতা দারুন কার্যকর।
চিরতাতে এমন একটি রাসায়নিক রয়েছে যা ম্যালেরিয়াসহ যেকোনো জ্বরের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে পারে।
চুলকানি সারাতে:
গায়ে চুলকানি হলে চিরতাতে অল্প পানি ছিটিয়ে বেঁটে নিতে হবে। তারপর তা লোহার কড়াই বা তাওয়াতে পরিমাণ মতো সরষের তেল দিয়ে জ্বাল দিতে হবে।
সরষের তেল গরম হয়ে ফেনামুক্ত হলে তাতে চিরতা ছাড়তে হবে। ভালো করে ভাজা হলে নামিয়ে ছাঁকতে হবে।
খেয়াল রাখতে হবে চিরতা যেন পুড়ে না যায়। এই তেল চুলকানোর জায়গায় ঘষে অল্প অল্প করে মালিশ করলে দ্রুত চুলকানি সেরে যাবে।
বমি কমাতে:
বমি হলে পেটে কিছু থাকে না। সেই সাথে শরীরে দাহ সৃষ্টি হয়। অখাদ্য খেলে এরূপ হয়।
এক্ষেত্রে ২ কাপ গরম পানিতে ৫ গ্রাম চিরতা একটু থেঁতো করে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
ভিজানোর ২-৩ ঘন্টা পর ছেঁকে পানিটা অল্প অল্প করে খেতে হবে। এতে বমি থেমে যাবে।
সংক্রামক অসুখ-বিসুখে:
চিরতা নানা রকম সংক্রামক অসুখ-বিসুখের হাত থেকে আপনাকে রক্ষা করবে। কারণ চিরতায় রয়েছে এমন কিছু উপাদান, যা সাধারণ সর্দি-কাশি প্রতিরোধ করে।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এটি। সেই সাথে কাটা-ছেঁড়া ও ক্ষতস্থান দ্রুত সারাতে সাহায্য করে এই উপাদান।
ঘাঁ সারাতে:
ঘাঁ হয়েছে অথচ কিছুতেই সারছে না। এক্ষেত্রে আগের দিন রাতে এক কাপ গরম পানিতে ৫ গ্রাম চিরতা ভিজিয়ে রেখে পরদিন সেই জল ছেঁকে পচা ঘাঁ ধুয়ে দিলে ২-৪ দিনের মধ্যে ঘাঁয়ের পচানি চলে যাবে ও দ্রুত শুকাবে।
চুল পড়া বন্ধ করতে:
কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না, অথচ রোজ মাথা থেকে প্রচুর চুল উঠছে। চুল উঠতে উঠতে ঘন কেশ পাতলা হয়ে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে আগের দিন রাতে এক কাপ গরম পানিতে ৫ গ্রাম চিরতা ভিজিয়ে রেখে পরদিন সেই পানি ছেঁকে তা দিয়ে মাথা ধুয়ে ফেললে চুল ওঠা কমবে।
একদিন পর পর একদিন এভাবে চিরতার পানি দিয়ে মাথা ধুতে হবে। ৩-৪ বার এভাবে ধুতে পারলে চুল ওঠা অনেক কমে যাবে।
তারুণ্য ধরে রাখতে:
তারুণ্য ধরে রাখতেও চিরতার গুরুত্ব অপরিসীম। নিজের তারুণ্য ধরে রাখার জন্য রোজ চিরতার জল খেতে পারেন।
কারণ চিরতা রক্তকে পরিষ্কার করে। রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। যেটি তারুণ্য ধরে রাখার একটি শর্ত।
রক্তশূণ্যতা দূর করতে:
চিরতা সেবনে রক্তশূন্যতা কমে যায়। এমনকি ঋতুস্রাব বা মাসিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে তাও কমাতে পারে।
কোথাও কেটে গেলে সে কাটা স্থানে চিরতার রস লাগিয়ে দিলে দ্রুত রক্ত পড়া বন্ধ হয়। অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ, নাক দিয়ে রক্তপড়া এসবও চিরতা বন্ধ করতে পারে।
সতর্কতা
গর্ভাবস্থা এবং বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের:
আপনি যদি গর্ভবতী হন বা বুকের দুধ খাওয়ান তবে চিরতা গ্রহণের সুরক্ষা সম্পর্কে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।
ডায়াবেটিস:
চিরতা কিছু লোকের রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। যদি আপনার ডায়াবেটিস থাকে এবং চিরতাকে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করেন তবে আপনার রক্তে চিনির মাত্রা যত্ন সহকারে নিরীক্ষণ করুন।