খেঁজুর শক্তির ভালো উৎস, কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

সকলের খুব পছন্দের অতি মিষ্ট শুষ্ক একটি ফল হলো খেজুর। সারাবছর কম বেশী খাওয়া হলেও রোজার সময় এটির চাহিদা আকাশচুম্বী।

হিন্দিতে খাজুর, আরবীতে-তাওয়ারিখ, ফ্রেঞ্চ-palmier এবং বাংলায় খেজুর নামে পরিচিত অতি সুস্বাদু, পুষ্টিকর ও মিষ্টি এই ফলটি।

বিভিন্ন পুষ্টি, ফাইবার এবং এন্টিঅক্সিডেন্টে পূর্ণ সারা বিশ্বের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ও শুকনো ফল হিসাবে পরিচিত প্রদাহবিরোধী বা ব্যাথা ও ফোলা নাশক, এন্টিঅক্সিডেন্ট, এন্টিটিউমার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। খেজুর ভিটামিন B1, B2, B3 এবং B5, পাশাপাশি A1 এবং C-তে ভরপুর। তাই এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

যদি আপনি প্রতিদিন কয়েকটি খেজুর খান তাহলে আপনাকে ভিটামিন গ্রহণ করতে হবে না। এটি শুধু আপনাকে সুস্থ্যই রাখবে না আপনার শক্তির মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে কারণ খেজুরে প্রাকৃতিক শর্করা যেমনঃ গ্লুকোজ, সুক্রোজ ও ফ্রুক্টোজ থাকে।

Quick Snack হিসাবে খেজুরের জুড়ি মেলা ভার অর্থাৎ দ্রুত জল-খাবার হিসাবে খেজুর সত্যি ভালো কাজ করে।

হাজার হাজার বছর ধরে, মধ্যপ্রাচ্য এবং সিন্ধু উপত্যকার দেশগুলির প্রধান খাদ্য হিসাবে খেজুর ব্যবহার হয়ে আসছে। রেকর্ড অনুযায়ী, প্রাচীন মিসরীয়গণ এই খেজুর ফল দিয়ে মদ তৈরী করতো।

জীবাশ্ম রেকর্ড অনুযায়ী, পাঁচ হাজার বছর ধরে এটি পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এটি আস্তে আস্তে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে ছড়িয়ে পড়ে।

অসাধারণ, বিরল, ব্যাতিক্রমী লাল ও সর্বোচ্ছ মিষ্টি খেজুর পাওয়া গিয়েছে The Gaza Strip-এ। খুবই জনপ্রিয় প্রজাতি “Zaghloul” যেটা মিসরে পাওয়া যায় – গাঢ় লাল, নরম ও মিষ্টত্ব স্কেল-এ এটিও সবার উপরে। “Sukkary”– খুব মিষ্টি, গাঢ় বাদামি রঙের ও চমৎকার স্বাদযুক্ত।

ডায়াবেটিস রোগীরা কি খেঁজুর খেতে পারবেন?

হ্যাঁ, ডায়াবেটিস রোগীরা খেঁজুর খেতে পারবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখলে খেজুর সেবন করতে পারেন।

যে সমস্ত ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখেন, নিয়মিত ব্যায়াম করেন, এবং স্বাস্থ্যকর খাওয়ার অভ্যাস বজায় রাখেন তারা ২-১টা খেজুর খেতেই পারেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু খেজুরে উচ্চপরিমানে ফাইবার রয়েছে সেহেতু ডায়াবেটিস রোগীরা খেজুরের উচ্চ ফাইবারের উপাদান থেকে উপকৃত হতে পারে।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য দিনে ২-৩টি খেজুর খাওয়া কোনো ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু পরিমানে বেশি খেলে বা যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন না তাদের বিষয়টি আলাদা।

খেজুর কি আপনার রক্তে শর্করাকে বাড়ায়?

ডায়াবেটিস থাকলেও পরিমিত পরিমানে খেজুর খাওয়ার ফলে কোনও ব্যক্তির রক্তে শর্করার মাত্রাতিরিক্ত বাড়ার সম্ভাবনা নেই। একটি সমীক্ষা অনুসারে, খেজুর হল নিম্ন গ্লাইসেমিক সূচক খাদ্য। যা ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে চিনির পরিমান বৃদ্ধি করে না।

খেজুরের পুষ্টি উপাদান

খেজুরে বেশ কয়েকটি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। নিচে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানগুলো দেওয়া হলো –

  • ক্যালোরি: ২৭৭
  • কার্বহাইড্রেট: ৭৫ গ্রাম
  • ফাইবার: ৭ গ্রাম
  • পটাসিয়াম: ২০% (RDI)
  • ম্যাগনেসিয়াম: ১৪% (RDI)
  • কপার: ১৮% (RDI)
  • ম্যাঙ্গানিজ: ১৫% (RDI)
  • আয়রন: ৫% (RDI)
  • ভিটামিন বি-6: ১২% (RDI)

খেজুরের স্বাস্থ্য উপকারিতা

খেঁজুর অতি মিষ্টি একটি ফল। পাম পরিবারের ফ্লাওয়ারিং উদ্ভিদ প্রজাতি যেটা date বা date palm হিসাবে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix dactylifera। নিচে খেজুরের উপকারিতা দেওয়া হলো –

কোলেস্টেরোল কমায়:

খেজুর কোলেস্টেরোল থেকে মুক্ত। খেজুরে খুব সামান্য পরিমানে চর্বি পাওয়া যায়। প্রতিদিনের ডায়েট-এ অল্প পরিমানে খেজুর রাখুন।

এটি কলেস্টেরল লেভেল ঠিক রাখে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ:

খেজুরে বেশ কয়েক ধরণের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা হৃদরোগ, ক্যান্সার, আলঝাইমার এবং ডায়াবেটিসের মতো নির্দিষ্ট দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার বিকাশ রোধ করতে পারে।

ফ্ল্যাভোনয়েডস: ফ্ল্যাভোনয়েডগুলি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যা প্রদাহ হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে ও অ্যালঝাইমার সারাতে কার্যকরী।

ক্যারোটিনয়েডস: ক্যারোটিনয়েডগুলি হৃদ্‌রোগের উন্নতি করতে প্রমাণিত এবং ম্যাকুলার অবক্ষয়জনিত এর মতো চক্ষু সংক্রান্ত ব্যাধিগুলির ঝুঁকিও হ্রাস করতে পারে।

ফেনলিক অ্যাসিড: অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণাগুলির জন্য পরিচিত, ফেনলিক অ্যাসিড ক্যান্সার এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে।

শক্তির ভালো উৎস:

খেঁজুরে প্রাকৃতিক শর্করা গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং সুক্রোজ খুব বেশি পরিমানে থাকে। খেজুরে উপস্থিত এই উচ্চ পরিমানে চিনি আমাদের শরীরে উচ্চ পরিমানে শক্তি সরবরাহ করে থাকে।

সমগ্র বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ দ্রুত বিকালের হালকা খাবারের জন্য খেজুর পছন্দ করেন। কারণ খেজুর অলসবোধ দূর করে অর্থাৎ অবসন্ন ও জড়তাগ্রস্ত কাটিয়ে দ্রুত শক্তির মাত্রা বৃদ্ধি করে।

অনেকেই আপনারা ব্যায়াম করতে প্রতিদিন জিমে যান। কেউবা ব্যায়ামের সরঞ্জাময়াদী কিনে ব্যায়াম করেন। খালি হাতে বা ভারী যন্ত্রপাতি যেভাবেই ব্যায়াম করি না কেন কিছুক্ষণ ব্যায়াম করার পরে আমরা ক্লান্ত বোধ করি।

প্রয়োজনীয় পুষ্টি সমৃদ্ধ খেজুর আপনার হারানো শক্তি অনতিবিলম্বে পুনরুদ্ধার করতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে।

প্রচুর আঁশ থাকায় কোষ্টকাঠিন্য দূর করে:

কোষ্ঠকাঠিন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার সেরা উপায় হলো খাদ্য তালিকা পরিবর্তন করা। ফাইবার ধারণকারী খাবার খেলে মল শক্ত হয়ে আটকে থাকে না। ফাইবার ধারণকারী খাবার মলকে স্বাভাবিক নরম করে।

খেজুরে প্রচুর পরিমানে আঁশ থাকে ফলে পায়খানা স্বাভাবিক ও আরামদায়ক হয়। নিয়মিত খেজুর খাওয়ার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি পান করলে পায়খানা স্বাভাবিক ও নিয়মিত শান্তিতে সম্পন্ন হয়।

হৃদপিন্ড ভালো রাখে:

বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগ মৃত্যুর অন্যতম প্রধান একটি কারণ। ব্যায়াম অর্থাৎ পরিশ্রম না করা এবং দূর্বল খাদ্যাভাস হৃদরোগের প্রধান কারণ।

যে খাবারগুলির GI (গ্লাইসেমিক ইনডেক্স) কম সেই খাবারগুলি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।

প্রাকৃতিক শর্করা, ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ খেজুরের অবস্থান গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের নীচের দিকে এবং এটি হৃদপিন্ড ভালো রাখে।

বন্ধ্যাত্ব দূর করে:

বন্ধ্যাত্ব সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা প্রায়শ হতাশাজনক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে থাকি। এই সমস্যার সাথে লড়াই করতে করতে আমরা অনেকেই ঔষধ এবং পদ্ধতির উপর অগণিত টাকা ব্যায় করে হাল ছেড়ে বসে থাকি।

খেজুর সেক্ষেত্রে আপনাকে হতাশা থেকে মুক্তি দিতে পারে। খেজুরে এস্ট্রোন, স্টেরোল এবং ক্যারোটিনয়েডের মতো ক্ষুদ্র উপাদান রয়েছে যা পুরুষ প্রজননকে প্রভাবিত করে থাকে।

ব্রেইন ফাংশন ভালো করে:

কিছু কিছু খাবার আসলে বয়সের সাথে সাথে ঘটে যাওয়া মস্তৃষ্কের কার্যকারিতার প্রাকৃতিক ক্ষতিকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।

যেসব খাবার ওমেগা-৩, ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম ও আইরন সমৃদ্ধ তা মস্তৃষ্কের ক্ষমতা সংরক্ষণের জন্য বিস্ময়কর কাজ করে।

খেজুরে এই সকল ভিটামিন ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান। খেজুর খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা মস্তৃষ্কের ক্ষমতা ধরে রাখার একটি দুর্দান্ত উপায়।

চোঁখের জন্য ভালো:

ভিটামিন এ থাকায় চোখের জন্য ভালো এবং রাতকানা রোগ প্রতিহত করে।

সতর্কতাঃ

অতিরিক্ত পরিমানে খেলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে। বেশি পরিমানে খেলে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন। অতিরিক্ত খেলে ——

  • ওজন বেড়ে যেতে পারে।
  • রক্তে সুগারের পরিমান বেড়ে যেতে পারে।
  • ত্বকে rash দেখা দিতে পারে অর্থাৎ allergic প্রব্লেম।
  • Hyperkalemia সমস্যা অর্থাৎ রক্তে পটাসিয়ামের পরিমান অতিরিক্ত হয়ে গেলে বিপদজনক অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
  • অন্যান্য ফলের মতো খেজুরের চেহারা উন্নত করতে এবং চকচকে ভাব আনতে পেট্রোলিয়াম মোম বা রাসায়নিক স্প্রে করা হয়। এই মোম বা স্প্রে করলে খেজুর দীর্ঘ সময় ধরে তাজা দেখায়। এই খেজুর দীর্ঘদিন ধরে খেলে গুরুতর পাচনতন্ত্রের সমস্যা হতে পারে।
  • বাচ্চারা সম্পূর্ণ চিবায় না সেক্ষেত্রে এটি সহজে হজম হয় না। এছাড়া এটি শিশুদের শ্বাসনালী ব্লক করে শ্বাসরোধের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে সাবধান।
রেফারেন্স: