করোনাভাইরাস অনেক কিছু কেড়ে নিচ্ছে কিন্তু অনেক শিক্ষাও দিয়ে যাচ্ছে।

একটা অদ্ভুত, চরম কষ্টদায়ক সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। এমন বেঁচে থাকা যেনো মানুষের ভাগ্যে দ্বিতীয়বার না আসে। মানুষ অনেক কিছু করতে পারলেও এখন মনে হচ্ছে আমরা কিছুই পারি না। Lockdown (জরুরি অবস্থায় নেওয়া  সুরক্ষা, নির্দিষ্ট এলাকায় ঢুকতে না দেয়া), Quarantine (পৃথকীকরণ, সঙ্গরোধ) Isolation (সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ, আলাদা করা) – যা আগে কখনো শুনিনি। এখন এগুলোই বাঁচার পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাইরাস যে মানুষকে এভাবে আক্রমণ করতে পারে তা ভাবাই যায় না। বাইরে বের হবেন, কেউ হাঁচি দিলে মনে হয় করোনা ভাইরাস এসে ঢুকে না যায়। গাড়ি, বাসের হাতল, বসার সিট, বাজারের ব্যাগ – সবকিছুতেই এক অজানা আতঙ্ক কাজ করছে। করোনাভাইরাস লেগে নেই তো।

আমরা এখন সবাই ঘরে মধ্যে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ তো ঘরবদ্ধ জীব নয়। কিন্তু এখন ঘরের মধ্যে থাকা ছাড়া উপায় নেই। এক মাসের উপর হয়ে গেলো। আরো থাকতে হবে। স্বাভাবিক জীবন অর্থাৎ যেভাবে আমরা চলতে অভ্যস্ত সেটা হচ্ছে না। এমন করে আটকে থাকা বাচাদের জন্য যে কি কষ্টকর তা কিভাবে বোঝাবো। আমরা শুধু বহুতল ভবন বানিয়ে যাচ্ছি, যার শেষ নেই।টাকা জমাচ্ছি। গাছপালা কেটে, মাঠ ঘাট ভরাট করে, পুকুর, নদী খাল, বিল ধংস করে, পশু পাখিদের কথা না ভেবে নিজেদেরকে নরকে আবদ্ধ করছি।কখনো ভাবিনা জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। দামি বাড়ি, গাড়ি মানুষকে বাঁচাতে পারে না।

করোনাভাইরাসকে গুরুত্ব না দেয়া

করোনাভাইরাসকে প্রথমে অন্য ভাইরাসের মতো ভাবা হয়েছিল। কি আর হবে। উন্নত দেশগুলোও প্রথমে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পরে যখন প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মাসের পর মাস ঘরবন্দী হয়ে থাকা লাগছে তখন দেখা গেলো স্বাস্থ্যসমস্যার পাশাপাশি হাজারো মানসিক জটিলতাকেও বাড়াচ্ছে। জীবনের, রাষ্ট্রের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে কারণে আঘাত হানেনি। শারীরিক ও মানসিক কষ্ট, অভাব অভাব আর অভাব, চুরি-ডাকাতি ও নৈরাজ্য, অন্যায়ও আইন অবমাননাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। তারা এখনো স্বাস্থ্যবিধি, সরকারি বিধিনিষেধ মানছে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি করছে, রাস্তায় থুতু-কফ ফেলছে। বাজার করছে এমনভাবে যেন একাই বেঁচে থাকবে, ভালো থাকবে। ত্রাণ নিয়ে যা হচ্ছে, নিজেরটা গোছাই অন্যের যা হবে হোক। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন মানুষ মানছে না। ডাক্তারদের, স্বাস্থ্যকর্মীদের যদি পর্যাপ্ত পিপি সরবরাহ করা না হয় বা সরবরাহকৃত মাস্ক নকল হয়।যদি ত্রাণের চাল চুরি করে চেয়ারম্যান, মেম্বাররা। যদি রোগী ডাক্তারের কাছে তথ্য গোপন করে, সরকার যদি স্বচ্ছতার নীতি শিকেয় তোলে, তাহলে হাত ধুয়ে কী লাভ?

প্রকৃতির নীরব প্রতিবাদ

মানুষ যেভাবে মরছে তাতে কোনো হিসাব আর মিলছে না। মানুষ তুমি নিজে সর্বদিক দিয়ে উন্নত হও। নিজেকে অনেক উপরে নিয়ে যাও। কিন্তু প্রকৃতি ও প্রাণীকে ধংস করে নয়। পৃথিবীকে নিপীড়ন আর কত করবা। মানুষে মানুষে একতার বন্ধন না বাড়িয়ে, ভালোবাসার চালান না বাড়িয়ে দিন দিন অস্ত্রের চালান বাড়িয়েছে এই মানুষ। সভ্যতার আড়ালে গড়েছে মানুষ মারার অত্যাধুনিক অস্ত্র,  সভ্যতার ভিতে গড়েছে অসভ্যতার দেয়াল। এই করোনাকাল যেন মনুষ্যজাতির ওপর অন্যান্য সৃষ্টিজগতের সম্মিলিত ক্ষোভ আর অভিশাপ। এতো অত্যাচার পরিবেশ ও প্রাণীর উপর। তাই প্রকৃতি মানুষকে আরো সহনশীল, আরো ভালোবাসা শেখাচ্ছে। শুধু লাশ আর লাশ যা দেখে প্রকৃতি হয়তো মুচকি হাঁসি হাঁসছে। এতো বড়াই। এতো ক্ষমতা তোদের। ক্ষমতা, অহংকার, অর্থসম্পদ সবই এখন মূল্যহীন।ক্ষমতার দম্ভ, বিত্তের দম্ভ এক মিনিটে শেষ হয়ে যেতে পারে। খালি চোখে দেখতে না পাওয়া ভাইরাস পুরো পৃথিবীটাকে অচল করে দিতে পারে।

মানুষকে এক হওয়ার শিক্ষা

সমস্ত পৃথিবীটাকে, সমস্ত জাতির মানুষকে এক করে দিলো এই করোনাভাইরাস। যে মানুষকে একটা দিন ঘরে বন্দি করে রাখা যাই না, এখন নিজের স্বার্থে, জগতের কল্যাণের স্বার্থে মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকছে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের জন্য আমাদের সকলের মনটা খারাপ। আমরা চেষ্টা করছি। সরকার চেষ্টা করছে তাদের খাবারের চাহিদা মেটানোর। করোনা প্রকারান্তরে বলে যাই – সকলে একত্র হও, একে অপরকে সাহায্য করো, ভালোবাসো। যাকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলে দেখতে পাওয়া যাই সেই অদৃশ্য, ক্ষুদ্র ভাইরাস সর্বশ্রেষ্ট ও বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষকে যেভাবে নাচাচ্ছে তাতে পুরো মানবজাতি এক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয়ে কি লাভ?

অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই মহামারীর সময়ে অসহায়, দরিদ্রদের সাহায্য করছেন।বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ ও সম্পদ দিয়ে অসহায়দের সাহায্য করছেন। বিশ্বও আজ এক মানবিক বিশ্বকে দেখছে।

বৈশ্বিক পরিবেশের উন্নতির শিক্ষা

মানুষ এখন মূলতঃ ঘরবন্দী। মানুষ ঘরে থাকায়, সকল প্রকারের পরিবহন, কলকারখানা এখন বন্ধ। কমেছে নাগরিক কোলাহল ও পরিবেশ দূষণ। সবকিছু বন্ধ থাকায় কার্বন মোনোঅক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণ খুবই কমে গেছে, কলকারখানার কেমিক্যাল বর্জ্য নদীর পানিতে পড়ছে না।বাতাসে ধুলিকনাও কমে গেছে। দারুণ উন্নতি হয়েছে সারা বিশ্বের সবুজ প্রকৃতির। গাছপালা নিবিড় ও সবুজ হয়ে উঠছে। গাছে গাছে নতুন ফুল, ফল ও পাতা এসেছে। গাছের পাতায় ধুলোর আস্তরণ খুবই কম। দূষণে শীর্ষ শহরগুলোর দূষণের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। যেন চারদিকে সবুজের প্রতিধ্বনি, সজীবতার প্রতিশ্রুতি। অক্সিজেন উৎপাদনের কারিগর, অক্সিজেনের কারখানা সবুজ বৃক্ষরাজি অক্সিজেন দিয়ে চলেছে যেন বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহের অক্লান্ত কর্মী। প্রাণীরা আপন মনে সমুদ্রতটে, উদ্যানে, পার্কে, রাস্তাঘাটে খেলছে। করোনা ভয়ে মানুষ শামুকের মতো চুপসে গেছে।বন্যপ্রাণী পাচার ও খাওয়া যে কত খারাপ কাজ তা করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে।এখন মনে হচ্ছে, প্রকৃতি তার ওপর আমাদের অন্যায় ও জুলুমের প্রতিশোধ নিচ্ছে। মানুষকে ঘরে পাঠিয়ে প্রকৃতি যেন তার আগের অবস্থা ফিরে পাচ্ছে, নিজের শুশ্রূষা নিজে করে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। মানুষের মধ্যে যেমন স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে এটা ধরে রাখতে হবে। পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে, বাসযোগ্য রাখতে হবে।

সার্বজনীনতার শিক্ষা

পৃথিবীতে অনেক রকমের ভাইরাস রয়েছে। এই সব ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আমরা এক এক রকমের রোগ যন্ত্রনা ভোগ করি। মৃত্যুবরণ করি। সার্চ, মার্স, ইবোলা, নিপাহ কোনটা রেখে কোনটা বলি। করোনা ভাইরাস এতো মারাত্মক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শ্বাসযন্ত্রে আক্রমণ করে আমাদের নিশ্বাস বন্ধ করে দেয়। সহজে মৃত্যু, চিকিৎসা জটিল ও ব্যয়বহুল। করোনার দেওয়া শিক্ষা হলো-শুধু আমি সুস্থ থাকলে হবে না, আমার আশেপাশের সকলকে সুস্থ্য থাকতে হবে। না হলে অন্যের ভাইরাস দশ-পনেরো জন ঘুরে আমার ভিতরেও কোনো না কোনোভাবে প্রবেশ করবে। তাই একটা অংশ যদি নিয়ম না মানে, তাহলে সকলের সকল চেষ্টা বৃথা যেতে পারে। দেশের ভেতরেও এটা যেমন সত্য, দেশের বাইরের বেলাতেও। যদি দুনিয়ার সব দেশ এই ভাইরাসকে পরাস্ত করতে না পারে, কোনো কোনো দেশ পারে, তাহলেও সফল দেশগুলো নিরাপদ হবে না। ব্যর্থ দেশগুলো থেকে ভাইরাস আবার সেসব দেশে যেতে পারে। তাই করোনা স্বকীয়তা বা আত্নকেন্দ্রিকতার শিক্ষা নয়, সার্বজনীনতার শিক্ষা দেয়। বিশ্ববাসী আমরা সবাই মিলে ভালো থাকবো। আমি এক ভালো থাকলে হবে না। একার উন্নতি নয়, সকলের উন্নতি। এর থেকে বড় শিক্ষা আর কি হতে পারে।

অন্যের ভালো চাইলাম না। অন্যকে পায়ের তলায় রাখার যে দৃষ্টিভঙ্গি এটা নিয়ে সামনে এগোলে পৃথিবীর ভালো হবে না। করোনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা আবার বুঝিয়ে দিয়ে গেলো। কোভিড–উত্তর পৃথিবী ভিন্ন এক নতুন পৃথিবী হবে। ধনী-গরীব সবাই আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছি। আপনি যত বড় খ্যাতিমান বা ক্ষমতাবান হন না কেন, সংকটে পড়ে যেতে পারেন। তাই সবার মঙ্গলের জন্য আমরা একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো।তাহলে আঁধারের পর আলো অবশ্যই আসবে।

মানসিক ও পারিবারিক দৃঢ়তার শিক্ষা

পারিবারিক সহিংসতা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় এই করোনাকালে বেড়ে যাওয়ায় এই দুটি বিষয় সবাইকে ভাবাচ্ছে। ঘরে থেকেও কিভাবে মানসিকভাবে ভালো থাকা যাই সেটা ব্যায়াম করে, গান গেয়ে বা বই পড়ে যেভাবেই হোক তা বের করে নিয়েছে। নৈরাজ্যিক জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীনতা, এবং বেঁচে থাকাকে অর্থহীন ও অগুরুত্বপূর্ণ ভাবার মতো অনুভূতিবোধ কিছু আত্নহনন ঘটালেও মানুষ সহজেই এই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছে। স্বামী-স্ত্রী বা পরিবারের সবাই দীর্ঘক্ষণ একত্রে থাকলে যে ঝগড়া হবে, ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তা নয়। করোনা শিক্ষা দেয় একে অপরকে সাহায্য করতে, রাগ নয় শুনতে হবে। অপরের আবেগকে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলে ঝগড়া, ছাড়াছাড়ি হবে না।

এতো মন খারাপের মধ্যেও চেষ্টা করি বাড়ির বিড়াল ও কুকুরগুলোকে নিজের খাবারের কিছুটা শেয়ার করতে। খাবার না খেয়ে ওরা একখানে বসে ঝিমাতে থাকে। খুব মায়া লাগে ওদের জন্য। আগেও হতো তবে করোনাভাইরাস বাড়িয়ে দিয়েছে। যত বড় বিপদ আসুক না কেনো মানুষের অগ্রযাত্রাকে কেউ থামাতে পারেনি। বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে মানুষ বর্তমানে এতো সুন্দর একটি অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছে। এই মানুষেরই রয়েছে অসীম মায়া, মমতা, ভালোবাসা, মেধা-এর জোরেই করোনাভাইরাস কেন যেকোনো কঠিন বিপদকে কাটিয়ে আমরা পৃথিবীকে মুক্ত করবো। যেখানে থাকবে না কোনো মহামারী, মৃত্যুভয়। আমাদের সন্তানেরা নিশ্চ্য় করোনামুক্ত নতুন সকালে নতুন আলোয় খেলবে, বুক ভরে নিশ্বাস নেবে।

লেখকঃ সিদ্ধার্থ শংকর পাল।

অ্যাডভোকেট, জজেস কোর্ট, খুলনা।