ডায়াবেটিস কি? কেন হয়? হলে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন বা কোন নিয়মগুলো মেনে চলবেন?

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ কোটি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।  World Health Organization – Diabetes Country  Profile, ২০১৬ – এর মতে বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে প্রতি বছর মারা যায় ৬০৬০ পুরুষ এবং ৪৭৬০ মহিলা যাদের বয়স ৩০-৬৯ বছরের মধ্যে।

সুজলা সুফলা, শস্য শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ মূলতঃ কৃষিনির্ভর। বর্তমানে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কল্যানে বাকি অল্প খাবারের ঘাটতি আমরা খাদ্য আমদানি করে পূরণ করে থাকি। কিন্তু পারিবারিক পর্যায়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ এখনো একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে দুই ধরনের অপুষ্টির শিকার। যেমন- খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা যেটা আগের থেকে অনেক কমেছে এবং জ্ঞানের অভাবে খাদ্যসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগসমূহ, যেমন- ডায়াবেটিস, স্থূলতা, স্ট্রোক, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি। জেনে রাখা জরুরি যে, খাদ্যসংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগে মৃত্যুর হার অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

খাদ্য তালিকায় শাকসবজি ও ফলমূল যোগ করে, খাবারে বৈচিত্র্যতা এনে, প্রচুর শারীরিক কসরত বা ব্যায়াম করে, অধিক নয় পরিমিত পরিমানে খেয়ে  এই অসংক্রামক রোগসমূহকে প্রতিরোধ করা যায়।

ডায়াবেটিস কি বা ডায়াবেটিস রোগটি কাকে বলে?

ডায়াবেটিস একটি দূরারোগ্য (দীর্ঘকাল স্থায়ী) স্বাস্থ্যের অবস্থা যা প্রভাবিত করে কীভাবে আপনার শরীর খাবারকে শক্তিতে পরিণত করবে। আপনার খাওয়া বেশিরভাগ খাবার চিনিতে বিভক্ত হয়ে যায়। একে গ্লুকোজও বলা হয় এবং আপনার রক্ত প্রবাহে ছেড়ে দেওয়া হয়।

যখন আপনার রক্তে সুগার জমতে থাকে তখন এটি আপনার অগ্ন্যাশয়কে ইনসুলিন নিঃসরণে সংকেত দেয়। ওহে ইনসুলিন তুমি আসো এবং তুমি তোমার কাজ শুরু করো। অগ্ন্যাশয়, একটি অঙ্গ যা পাকস্থলী বা পেটের কাছে থাকে, আমাদের দেহের কোষে গ্লুকোজ প্রবেশ করতে সহায়তা করার জন্য ইনসুলিন নামক হরমোন তৈরি করে।

ডায়াবেটিস হলে অগ্ন্যাশয় থেকে এই ইনসুলিন নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটে বা কম নিঃসৃত হয় অথবা অকার্যকর হওয়ায় কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি ঘটে এবং রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। এই অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলে।

diabeteschart

ডায়াবেটিস কেন হয়?

প্রাক ডায়াবেটিস এবং টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকির কারণগুলি:

ওজন:

আপনার যত বেশি ফ্যাটি টিস্যু রয়েছে, আপনার কোষগুলি ইনসুলিনের প্রতিরোধক হয়ে উঠবে। ইনসুলিন কোষে পৌঁছাতে পারে না। ইনসুলিন কম-বেশি যাই হোক উৎপন্ন হচ্ছে কিন্তু আপনি এতো মোটা বা ওজন এতো বেশি যে, কাজ করতে পারছে না।

নিষ্ক্রিয়তা:

আপনি যত কম সক্রিয়, আপনার ঝুঁকি তত বেশি। এতদিন ব্যায়াম করেননি ঠিক আছে। এখন ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে বা রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেছে এখন না হয় একটু ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করুন। হাটাহাটি তো করছি। ঐ একটু হাঁটলেন তাতে কি হবে?

পারিবারিক ইতিহাস:

ঠাকুরদাদার ছিল। বাবাও ডায়াবেটিসের রোগী। সন্তান হিসাবে আপনি এখনই সচেতন হন। তা না হলে আপনাকেও হয়তো এই রোগের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে হবে।

Race বা ethnicity বা জাতি।

বয়স:

বয়স যত বাড়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ততো বাড়ে। বয়স বাড়লেও ওজন বাড়তে দেবেন না। টক জাতীয় ফলমূল, শাকসবজি, চর্বিহীন মাংস বা সাদা মাংস, ছোট মাছ খাদ্য তালিকায় রাখুন।

গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস।

পলিসিস্টিক ডিম্বাশয় সিন্ড্রোম।

উচ্চ্ রক্তচাপ।

এজন্য বলা হয় ডায়াবেটিস আজীবনের একটি অসংক্রামক রোগ। বংশগত, পরিবেশগত, অলস জীবন যাপন, অসম খাদ্যাভ্যাসের কারণে এ রোগ হতে পারে। এর চিকিৎসার মূল উপাদান হচ্ছে শিক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ওষুধ। এগুলোর সমন্বয়ে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করতে হবে, পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

রক্তের গ্লুকোজের প্রধান উৎস হলো খাবার দাবার। এজন্যই ডায়াবেটিস হলে খাদ্য সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হতে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডায়াবেটিস হলে মানুষ খুব চিন্তায় পড়ে যায়, এই বুঝি ভালো ভালো খাবার আর খেতে পারবো না।  আসলে কি তাই? আসল কথা হলো খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগেও যেমন থাকে, ডায়াবেটিস হওয়ার পরেও ঠিক একই রকম থাকে। পুষ্টির কোনো তারতম্য হয় না।

পার্থক্য হলো  ডায়াবেটিস হলে খাবারের একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হয় এবং প্রতি দিনই কোনো না কোনো ব্যায়াম করতে হয়, যার উদ্দেশ্য হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাস্থ্যকে ভালো রাখা।

ডায়াবেটিস কি নিরাময় করা যায়?

যদিও ডায়াবেটিসের কোনও নিরাময় নেই,ডায়াবেটিস চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ব্যায়াম করে, ওজন কমিয়ে, পরিমিত ও সময়মতো খাবার খেয়ে অনেকেই এটিকে নিয়ন্ত্রণে বা ডায়াবেটিসের গতিকে একেবারে থামিয়ে দিয়েছে।

আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করুন। প্রতিদিন যতটা সম্ভব কী করতে হবে তা জানুন। ঘন ঘন আপনার গ্লুকোজের স্তর পরীক্ষা করুন। আপনার ডায়াবেটিসের ওষুধ নিয়মিত নিন এবং ওষুধ, ব্যায়াম, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং ঘুমের ভাল অভ্যাসের সাথে আপনার খাবারের ভারসাম্য বজায় রাখুন।

ব্যায়াম নিয়মিত. অনুশীলন আপনাকে ফিট রাখতে, ক্যালোরি পোড়াতে এবং রক্তে গ্লুকোজ স্তরকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। আপনার চিকিৎসা  সংক্রান্ত অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলি আপনার ডাক্তারের সাথে চালিয়ে যান।

কি খাবেন বা কোন নিয়মগুলো মেনে চলবেন?

যেসব শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট খাবার খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বেড়ে যায় সেসব খাবার যেমন- মিষ্টি জাতীয় খাবার, সাদা ভাত, সাদা রুটি, আলু অল্প বা পরিমিত পরিমানে খেতে হবে।

যেসব খাবার খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেরিতে এবং ধীরে ধীরে বাড়ে যেমন আঁশজাতীয়  শাকসবজি, ফল, মাছ/মাংস, ডিম, দুধজাতীয় খাবার ইত্যাদি খাবারের তালিকায় যাতে থাকে সে দিকটা খেয়াল রাখতে হয়।

ডায়াবেটিস রোগীর খাবারে শাকসবজির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। সারা বছরই এ দেশে নানা ধরনের শাকসবজি উৎপাদন হয়।  ডায়াবেটিস রোগীর সুবিধার জন্য শাকসবজিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

শর্করা সম্বলিত সবজি:

ওটস: ওটস গ্রহের স্বাস্থ্যকর পুরো শস্য খাদ্য হতে পারে।
বাল্কহুইট, কলা, মিষ্টি আলু, বিটরুটস, কমলা, ব্লুবেরি, আলু, মটরসুটি, ভুট্টা এবং স্কোয়াশ, মিষ্টি কুমড়া, থোড়, মোচা, বিট, শিম, মাটির নীচের কচু,  শিমের বিচি, কাঁঠালের বিচি, শালগম, ইঁচড়, ঢেঁড়স, বেগুন, মটর শুঁটি, কচুরমুখী, পাকা টমেটো।

কুইনোয়া: কুইনো একটি পুষ্টিকর বীজ যা প্রাকৃতিক স্বাস্থ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস্যভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

শর্করাবিহীন শাকসবজি:

শসা: শসা যে কোনও সালাদে একটি সতেজ এবং পুষ্টিকর সংযোজন।

লেটুস পাতা, ধনেপাতা, সাদা মাশরুম, পালং শাক, সুইস চার্ড, ব্রোকলি, ফুলকপি, পাতাকপি, বেল পেপার, মুলা, ওলকপি, কাঁচা টমেটো, কাঁচা পেপে, উচ্ছে, করলা, ঝিঙা, চিচিঙা, পটোল, লাউ, চালকুমড়া, ডাঁটা, সজনা, ধন্দুল, ক্যাপসিকাম, কাঁচামরিচ ইত্যাদ।

সব ধরনের শাক, যেমন: লালশাক, পুঁইশাক, পালংশাক, কলমিশাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক ইত্যাদি

ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশে সারাবছরই বিভিন্ন রকমের শাকসবজি পাওয়া যায়।  ডায়াবেটিস রোগীর উচিত প্রতি দিন একই ধরনের শাকসবজি না অনেক রকমের সবজি দিয়ে ঘ্যাট রান্না করে খাওয়া। এতে খাবারে বৈচিত্র্য আসবে, পেট ভরবে, মনে পরিতৃপ্তি আসবে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব জরুরি।  অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস নানা ধরনের রোগ হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে হার্ট, কিডনি, লিভার, চোখ নষ্ট হয়ে যায়, নানা রকম ক্যান্সার হতে পারে, এমনকি শরীরের মাংসেও পচন ধরতে পারে।

নিয়মিত আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করুন। আপনার ওষুধের সাথে নিয়মিত থাকুন। আপনার কিডনি যত্ন নিন। আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন। সঠিক খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করুন। অতিরিক্ত ওজন কমান।

আপনার ডায়েট থেকে চিনি এবং পরিশোধিত কার্বস বাদ দিন। নিয়মিত হাঁটুন। আপনার প্রাথমিক পানীয় হিসাবে জল পান করুন। ধুমপান ত্যাগ করুন।
খুব কম-কার্ব ডায়েট অনুসরণ করুন। রাত জাগা সহ অন্যান্য বাজে অভ্যাস ত্যাগ করুন।

গর্ভকালীন সময়েও নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, গর্ভস্থ শিশু মৃত এবং প্রতিবন্ধী হতে পারে, অর্থাৎ ডায়াবেটিস, এহেনও কোনো রোগ বা জটিলতা নেই যেটা জন্মাতে সাহায্য করে না।

প্রতি দিনের খাবারে আঁশযুক্ত শাকসবজি থাকতে হবে। বিভিন্ন প্রকার শাক, তরি-তরকারি যেমন শিম, বরবটি, মাশরুম, লাউ, কুমড়া, গাজর, কাঁচা কলা, ডাঁটা এগুলো হজম হয় না, রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়তে দেয় না, ওজনও বাড়ায় না।

শাকসবজি যেগুলো কাঁচা ও টাটকা খাওয়া যায় সেগুলো কাঁচা অবস্থায় খেলেই উপকার বেশি পাওয়া যায়। যেগুলো খোসাসহ রান্না করা যায় সেগুলো খোসাসহ রান্নাই ভালো। তবে সবজি বেশি সিদ্ধ না করে একটু কাঁচা কাঁচা করে রান্না করা উচিত। এতে স্বাদ, গন্ধ, রঙ এবং ভিটামিন অটুট থাকে।

আপনি হয়তো মনে করছেন, আলু খাবোনা, মিষ্টি খাবো না, মাটির তলার জিনিস খাবো না, ভাতের বদলে রুটি খাবো, চিনি বা গুড়ের তৈরি কিছু খাবো না, সকাল বেলা তেতো খাবো, তাহলে ডাইবেটিস হবে না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল একটি ধারণা।

সূত্র:

https://www.webmd.com/diabetes/guide/is-there-a-diabetes-cure