কথায় আছে পেট ঠিক তো জগত ঠিক। তাই পেট ঠিক রাখতে গেলে হজম শক্তি ঠিক থাকতে হবে। নিয়মিত খাদ্যগ্রহণ যেমন জরুরি, তেমনি সেই খাবার হজম হওয়াটাও জরুরি। হজমশক্তি কমে গেলে দেখা দেয় দেহে পুষ্টির অভাব। আর পুষ্টির অভাব দেখা দিলে আমাদের শরীরে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের রোগ।
আমরা প্রত্যেকেই মাঝেমধ্যে হজমের গরমিল অনুভব করি। যেমন গ্যাস, ক্ষুধা কমে যাওয়া, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া। তবে যখন এই লক্ষণগুলি ঘন ঘন দেখা দেয় তখন এগুলি আমাদের জীবনে বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
হজম শক্তি উন্নত করার কয়েকটি স্বাস্থ্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আমাদের পরিপাকতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারি। এই পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে ব্যায়াম করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, বিভিন্ন ধরনের খাবার গ্রহণ যেমনঃ বীট, বাঁধাকপি, গাঢ় সবুজ শাকসবজি, আস্ত শস্যদানা ইত্যাদি। এগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো –
পর্যাপ্ত পানি:
হজমের ক্ষেত্রে পানির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। হজমশক্তি ঠিক রাখতে অনেক বেশি পানি পান করুন। কম পানি পান করা কোষ্ঠকাঠিন্যের একটি সাধারণ কারণ। পানি আমাদের হজম স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। তাই বিশেষজ্ঞরা কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে প্রতিদিন ১.৫-২ লিটার পানি পান করার পরামর্শ দেন।
সবুজ শাকসবজি:
গাঢ় সবুজ শাকসবজি ফাইবারের একটি দুর্দান্ত উৎস। ফাইবার আমাদের মলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া সবুজ শাকসবজি ম্যাগনেসিয়ামের একটি ভাল উৎস, যা আমাদের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টে পেশী সংকোচনের উন্নতি করে
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে পারে। ২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ শাকসবজি থেকে একটি উপকারী চিনি পাওয়া যায়, যা আমাদের অন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে। এই চিনি হজমে সহায়তা করার পাশাপাশি কিছু খারাপ ব্যাকটিরিয়াকেও দুর্বল করে তোলে। গাঢ় সবুজ শাকসবজি যেমন –
ব্রকলি,
পালংশাক ইত্যাদি।
মরিচ:
শুনলে একটু অবাক লাগে
মরিচ আমাদের হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। মরিচে থাকা ডায়াটরি ফাইবার হজমশক্তি উন্নত করতে অনেক বেশি কার্যকর। খাবারে পরিমিত পরিমাণে ঝাল দিয়ে খেতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই হজমের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া প্রতিবেলা খাওয়া শেষে সামান্য একটু টক জাতীয় কিছু খেতে পারলে হজমে দারুন উপকার পাওয়া সম্ভব।
আস্ত শস্যদানা:
আস্ত শস্যদানা থেকে প্রাপ্ত ফাইবার দুটি উপায়ে হজম উন্নতি করতে সহায়তা করে। প্রথমত, ফাইবার আপনার মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হ্রাস করতে পারে। দ্বিতীয়ত, কিছু শস্যের তন্তু প্রাকবায়োটিক গুলির মতো কাজ করে এবং আমাদের অন্ত্রে স্বাস্থ্যকর ব্যাকটিরিয়াকে প্রভাবিত করে।
বাঁধাকপি:
শীতকালীন এই সবজিটি হজমের উন্নতি করতে সহায়তা করে। আমরা যদি আমাদের হজম স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে চাই, তাহলে আমরা ফাইবার সমৃদ্ধ
বাঁধাকপি খেতে পারি। এই কুঁচকানো সবজি অদ্রবণীয় ফাইবারে পূর্ণ, যা আমাদের অন্ত্র পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পারে না। এই অদ্রবণীয় ফাইবার মলের সাথে যুক্ত হয়ে আমাদের অন্ত্রের অবস্থা স্বাভাবিক রাখে এবং পাচনতন্ত্রকে সুস্থ্য রাখতে সহায়তা করে।
বীট:
বীট একটি শীতকালীন সবজি। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি উপকারী। এই সবজিতে রয়েছে বিটাসায়নিন, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম। এছাড়া এতে আরও রয়েছে ভিটামিন বি৩, বি৬ এবং ভিটামিন সি, বিটা-ক্যারোটিন। বীট ফাইবারের একটি ভাল উৎস। এক কাপ বীটে ৩.৪ গ্রাম ফাইবার থাকে। ফাইবার হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং পাচনতন্ত্রকে সুস্থ্য রাখতে সহায়তা করে।
আদা:
আদা হজমের শক্তি বৃদ্ধি করতে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। আদা দেহের টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে। হজমের দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি গ্যাস্ট্রিক দূর করে। আদা আমাদের পেট থেকে খাদ্য ক্ষুদ্রান্ত্রের দিকে দ্রুত সরিয়ে দিয়ে গ্যাস, বমি বমি ভাব এবং পেটের অস্বস্তিরতা ইত্যাদির ঝুঁকি কমায়। আদায় রয়েছে ‘জিনজারোলস’ যা হজমশক্তি বৃদ্ধি করে এবং পরিপাকক্রিয়া দ্রুত করে। সকালে এক কাপ আদা চা এবং রান্নায় আদার ব্যবহার কিংবা কাঁচা আদা খাওয়ার অভ্যাস পরিপাকযন্ত্র সুস্থ্য রাখে।
মৌরি:
মৌরি সাধারণত মুখ শুদ্ধি হিসেবে কাজ করে। এটি মুখের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করে। মৌরিতে একটি অ্যান্টিস্পাসোমডিক এজেন্ট থাকে যা আমাদের পাচনতন্ত্রের মসৃণ পেশীগুলি শিথিল করে। খালি পেটে মৌরি খেলে গ্যাসট্রিকের সমস্যা দূর করা যায়। মৌরিতে থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করতে সহায়তা করে এবং আমাদের হজম শক্তি উন্নত করে। এক গ্লাস পানিতে সারা রাত মৌরি ভিজিয়ে রেখে সেই পানি খেলে পেট ফাঁপা ও গ্যাসের কারণে হওয়া পেট ব্যাথা কমে যায়। এছাড়াও অন্যান্য পেটের সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করে মৌরি।
দই:
অনেকেই আমরা জানি দই হজমের সমস্যা দূর করে। আমাদের মধ্যে অনেকেই হজমের সমস্যার কারণে দুধ খেতে পারেন না কিন্তু দুধ থেকে তৈরি দই (সাধারণত ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়া দ্বারা) খেলে সমস্যা হয় না। খাবার সহজে হজম করতে সহায়তা করে দই। এতে প্রোবায়োটিক(ভালো ব্যাক্টেরিয়া যুক্ত খাবার) হিসাবে পরিচিত ব্যাকটিরিয়া রয়েছে যা আমাদের পাচনতন্ত্রে থাকে। এই ভাল ব্যাকটিরিয়া আমাদের পাকস্থলীকে স্বাস্থ্যকর রেখে হজম উন্নতিতে সহায়তা করতে পারে। তবে সব দইতে প্রোবায়োটিক থাকে না।
আপেল:
আপেল খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর একটি ফল।
আপেল পেকটিনের উৎস, এই পেকটিন একটি দ্রবণীয় ফাইবার। এটি মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়রিয়ার কমাতে সাহায্য করে।
পেঁপে:
সুস্বাদু গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল
পেঁপেতে পেপেইন নামক একটি হজম এনজাইম রয়েছে। এনজাইম প্রোটিন ফাইবার ভেঙে ফেলে হজম প্রক্রিয়া চলাতে সহায়তা করে। পেপেইন পেটের বিরক্তিকর সমস্যা যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য এবং গ্যাস গ্যাস ভাব দূর করতে পারে। গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্ষমতার কারণে এটি হজমে প্রধান এনজাইম হিসাবে সাধারণত ব্যবহৃত হয়।
ব্যায়াম ও হাঁটা:
নিয়মিত ব্যায়াম হজম উন্নয়নের অন্যতম সেরা উপায়। ব্যায়াম আমাদের হজম সিস্টেমের মাধ্যমে খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে। স্বাস্থ্যকর ব্যক্তিদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সাইকেল চালানো এবং জগিংয়ের মতো পরিমিত ব্যায়াম অন্ত্রের ট্রানজিটের সময় প্রায় ৩০% বৃদ্ধি করেছে। দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য আছে এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিদিন ৩০ মিনিটের হাঁটার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যতার উন্নতি হয়েছে।
খাবার বেশি চিবিয়ে খান:
অনেকের অভ্যাস আছে খাবার দুয়েকবার চিবিয়ে গিলে ফেলা। এতে খাবার হজম হতে খুবই সমস্যা হয়। এই কাজটি হজমের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। তাই খাবার খাওয়ার সময় যতো বেশি চিবিয়ে খাওয়া যায় হজমের জন্য ততই ভালো।
হজম শক্তি বাড়ানোর জন্য এছাড়া আরো কিছু সতর্কতা আমাদের অবলম্বন করতে হবে যেমন –
- সিগারেট, অ্যালকোহল এবং গভীর রাতে খাওয়ার অভ্যাস হজমে সমস্যা হতে পারে। হজম উন্নত করতে, এই ক্ষতিকারক অভ্যাসগুলি এড়াতে চেষ্টা করুন।
- প্রতিদিন সঠিক সময়ে খাবার খান ও নিয়মিত একই সময় অনুসরণ করলে পাচন প্রক্রিয়া ভালো থাকে।