সজিনার উপকারিতা। এই বসন্তে ভালো থাকতে সজনে ডাটা ও সজনে পাতা।

ঋতুরাজ বসন্ত সেজেগুজে প্রস্তুত। আমাদের দেশে এই বসন্তে সজিনা সকলের প্রিয় একটি সবজি। সজিনা বলতে লাঠির মতো সজিনা ফলটি যেটি সজিনা ডাটা নামে পরিচিত। সজিনা ডাটা আমরা বেশি খেয়ে থাকলেও অনেক দিক থেকে সজিনা পাতার উপকারিতা সজিনা ডাটার থেকে বেশি।

তাই আমরা সজিনা ডাটা যেমন খাবো তেমনি এর পাতাকেও উপেক্ষা করবো না। দেশি-বিদেশি পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনাকে অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ বা অলৌকিক উদ্ভিদ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আঠারো রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮% আমিষ আছে যা বহু উদ্ভিদেই নেই।

সজিনা সবজির চেয়ে এর পাতার উপকার আরও বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এ গাছকে মায়েদের ‘উত্তম বন্ধু’ এবং পুষ্টির এক অনন্য সহজলভ্য উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

সজিনা বা মোরিংগা গাছটি “অলৌকিক গাছ” হিসাবেও পরিচিত এবং এর পিছনে একটি ভাল কারণ রয়েছে। গাছের পাতাগুলি, ফল, রস, তেল, শিকড়, ছাল, বীজ, শুঁটি এবং ফুলের ঔষধি গুণ রয়েছে।

গাছ থেকে প্রাপ্ত পণ্যগুলির অনেকগুলি ব্যবহার রয়েছে। এটি ‘ড্রামস্টিক ট্রি’ নামেও পরিচিত। এটি বেশিরভাগ এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়।

সজিনা একটি অতি পরিচিত দামি এবং সুস্বাদু সবজি। সজিনার ইংরেজি নাম Drumstick এবং বৈজ্ঞানিক নাম Moringa Oleifera উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ হলেও এ গাছ শীত প্রধান দেশ ব্যতীত সারা পৃথিবীতেই জন্মে।

সজনে ডাঁটা অনেকেরই বেশ পছন্দের একটি সবজি। সজনে ডাঁটা কেবল খেতেই যে সুস্বাদু তা নয় বরং এটি স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজেও বেশ প্রয়োজনীয়। বসন্তের শেষের দিকে সজনে ডাঁটা বাজারে ওঠে। শুধু সজনের ডাঁটাই নয়, সজনের পাতাও শাক হিসেবে খাওয়া যায়।

শীতের পরই চলে আসে বসন্ত। এই সময় নানা রকম অসুখ বিসুখের প্রকোপ বেড়ে যায়। ঠিক তেমনি বসন্তের বাতাসের সঙ্গে ভেসে বেড়ায় নানান রকমের অসুখ। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় সক্রিয় হয়ে ওঠে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া।

দেখে নেওয়া যাক সজনে ডাটা ও পাতার উপকারিতা

বারোমাসি সজিনার জাত প্রায় সারা বছরই বার বার ফলন দেয়। গাছে সব সময় ফুল, কচি পড দেখা যায়। আমাদের দেশে ২-৩ প্রকার সজিনা পাওয়া যায়। বসতবাড়ির জন্য সজিনা একটি আদর্শ সবজি গাছ।

ভিটামিন ও মিনারেলসে পরিপূর্ণ:

বিজ্ঞানীরা পুষ্টির দিক দিয়ে সজিনাকে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ আখ্যায়িত করে বলেন এ গাছটি থেকে পুষ্টি, ঔষধিগুণ ও সারা বছর ফলন পাওয়া যায় বিধায় বাড়ির আঙিনায় এটি একটি মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ। এর পুষ্টিগুণ খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্য শক্তি

মরিঙ্গা বা সজনে পাতাতে ভিটামিন এ, সি, বি 1 (থায়ামিন), বি 2 (রাইবোফ্লাভিন), বি 3 (নিয়াসিন), বি 6 এবং ফোলেট সমৃদ্ধ রয়েছে। এগুলি ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং দস্তাতেও সমৃদ্ধ।

এক কাপ মরিঙ্গা পাতায় 2 গ্রাম প্রোটিন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি 6, আয়রন, রিবোফ্লাভিন এবং ভিটামিন এ।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে:

সজনে ডাটা ও সজনে পাতা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ করে। সজনে পাতায় isothiocyanates থাকায় মানুষের শরীরে চিনির সঠিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সজনে খুবই উপকারী সবজি।

হাড় শক্ত ও মজবুত করে:

সজনে ডাটায় ও পাতায় প্রচুর পরিমাণে আয়রণ, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন থাকে। এটিতে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, আয়রন এবং অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে যা আপনার দেহকে সুস্থ করতে এবং পেশী গঠনে সহায়তা করে। তাই এটি সুস্থ এবং শক্তিশালী হাড়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী এছাড়াও আমাদের শরীরের রক্ত বিশুদ্ধ করতেও সজনের কোন জুড়ি নেই।

কোলেস্টেরল কমায়:

ওট, ফ্লাক্সসিডস এবং বাদাম ছাড়াও মরিঙ্গা পাতা উচ্চ কোলেস্টেরলের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য প্রতিকার।মানুষের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল কোলেস্টেরল এবং মরিঙ্গা পাতা বা সজনে পাতা খাওয়া উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রার বিরুদ্ধে যথেষ্ট উন্নতি দেখায়। মরিঙ্গা ওলিফেরা সেই স্তরগুলি কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:

ভিটামিন, মিনারেলস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট,  অ্যামিনো অ্যাসিড কোনটা রেখে কোনটা বলবো।  যা কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে এবং আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

বসন্ত রোগ প্রতিরোধ করে:

বসন্ত প্রতিরোধে সজনে ডাটার তরকারি বা ডাল রান্না করে খেলে জল বসন্ত ও গুটি বসন্তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।পাতা শাক হিসাবে ও ফুল দিয়ে বড়া ভেজে খেলেও একই উপকার পাওয়া যায়।

উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ করে:

সজনে ডাটা দেহের কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। তাই সজনে ডাঁটা খাওয়া উচ্চ রক্ত চাপের রোগীদের জন্য বেশ উপকারী। এছাড়া উচ্চ রক্ত চাপের চিকিত্‍সায় সজনের পাতাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।পাতায় কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি এবং কলা থেকে ১৫গুণ বেশি পটাসিয়াম রয়েছে।

পেটের সমস্যা সমাধানে:

সজনে হজম সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভাবে কার্যকরী। পেটে গ্যাস হলে, বদহজম হলে এবং পেটে ব্যথা হলে সজনে ডাটার  তৈরি তরকারী খেয়ে নিন।সজনে পাতার রস বা পাতা দিয়ে তৈরি বড়ি কিছু পেটের ব্যাধি যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রাইটিস এবং আলসারেটিভ কোলাইটিস নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে।

মরিঙ্গার অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্যগুলি বিভিন্ন প্যাথোজেনগুলির বৃদ্ধি বাধা দিতে পারে এবং এর উচ্চ ভিটামিন বি উপাদান হজমে সহায়তা করে।

বুকের দুধ বাড়ায়:

ঐতিহ্যবাহী আয়ুর্বেদিক ওষুধে মরিঙ্গা পাতা ব্যবহার হত বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের দুধ বাড়াতে। যেহেতু এগুলি প্রোটিন, গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির সমৃদ্ধ উৎস, তাই মরিঙ্গা পাতা খাওয়া মা এবং শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভাল।

শ্বাসকষ্ট কমায়:

সজনে ডাটা এবং পাতার রস খেলে শ্বাসকষ্ট সারে। সজনে ডাটায় থাকা প্রদাহ-বিরোধী এন্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন সি অ্যালার্জি প্রতিরোধ করে, ফলে অ্যালার্জির কারণে যে শ্বাসকষ্ট হয় তা দূর করে।

ত্বক এবং চুলের জন্য ভাল:

প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পুষ্টির কারণে, সজনে পাতা ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্য এবং চেহারা উন্নত করে। এগুলি ত্বকে কোমলতা যুক্ত করে এবং চুলে চকচকে করে। মরিঙ্গা পাতায় উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টগুলি ত্বকে সূক্ষ্ম রেখা এবং বলিরেখার উপস্থিতি হ্রাস করে।

নার্ভাস সিস্টেমের জন্য ভাল:

ভিটামিন ই এবং সি এর উচ্চ ঘনত্ব নিউরাল অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়তা করে। যাদের মাইগ্রেন রয়েছে বা পুনরাবৃত্তি হওয়া মাথা ব্যথায় ভুগছেন তাদের অবশ্যই মরিঙ্গা পাতা নিয়মিত খাওয়া উচিত।

এই পাতাগুলি মেজাজ ভারসাম্য হিসাবে কাজ করে কারণ এগুলি সেরোটোনিন, ডোপামিন এবং নোরড্রেনালিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের উৎপাদন স্থিতিশীল করে যা স্মৃতি, মেজাজ এবং উদ্দীপনা-প্রতিক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এছাড়াও সজনে ডাটা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, লিভার ও কিডনি সুরক্ষিত রাখে। শরীরের বাড়তি ওজন কমাতে সাহায্য করে সজনে। তাই সজনের এই ভরা মৌসুমে আপনার খাদ্য তালিকায় সজনের তরকারি বা সজনের ডাল রাখতেই পারেন।

মোরিঙ্গাকে আপনার প্রতিদিনের ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করার উপায়: সজনে ফল বা ডাটা আমরা রান্না করে খাই। পাতা শাক হিসাবে বা একটু গরম জলে সিদ্ধ করে সামান্য লেবু এবং মধু মিশ্রিত করে খাওয়া যায়। এটি চা হিসাবে খাওয়া যায়। স্মুডিতে মিশিয়ে নিন। এটি স্যুপে ছিটিয়ে দিন। এটিকে বেক করুন। এটি দিয়ে সালাদ ড্রেসিং করে খান।

সতর্কতাঃ

যা কিছু খাবেন পরিমাণমতো খাবেন। আপনার শরীরের অবস্থা বুঝে খাবেন। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। আপনি যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হন বা নিয়মিত কোনো ডাক্তারের তত্বাবধানে থেকে কোনো ওষুধ গ্রহণ করলে খাওয়ার আগে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন।

সূত্রঃ

Pharmeasy.in, webmd